জননী/সুব্রত ভট্টাচার্য
জননী
সুব্রত ভট্টাচার্য
কবি হুমায়ন আজাদের ‘আমাদের মা’ আমার খুব প্রিয় কবিতা। এ কবিতা পড়তে গিয়ে কখনও আমাদের মায়ের সাথে মিল খুঁজে পাই। চোখ জলে ভরে ওঠে।
আমাদের মা
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মতো দাঁড়াত বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারত না।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাত যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনওদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিল, কিন্তু ছিল আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিল আমাদের শ্রেণীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তাঁর জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম।
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম।
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচণ্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নীচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিল অশ্রুবিন্দু দিনরাত টলমল করত
আমাদের মা ছিল বনফুলের পাপড়ি , সারাদিন ঝরে ঝরে পড়ত,
আমাদের মা ছিল ধান খেত – সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকত।
-------------------------------
আমাদের মা প্রনতি ভট্টাচার্য ভীষণ বিখ্যাত কোনও মানুষ ছিলেন না। অসংখ্য মানুষ তাকে একডাকে চিনতেন এমনও নয়। নিতান্ত এক সাধারন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন কারও মা, কারও কাকিমা, মাসিমা, বৌদি,বা বোন। নিজস্ব পারিবারিক এবং সামাজিক বৃত্তে এক জনপ্রিয়, স্নেহময়ী, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। বাবা যখন তাঁর অফিসের কাজকর্ম নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন, পারিবারিক কাজকর্মে ব্যাস্ত থাকতেন আমাদের মা। অন্যান্য মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েদের মতোই পরিবারের শখ, আনন্দকেই নিজের শখ আনন্দ বলেই ভাবতেন।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশ কয়েকজন। বেশ হিসেব করে চলতে হত। তা বলে আমাদের ভাই বোনেদের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পেতে কোনও অসুবিধা হত না। স্কুলের ফি, গৃহশিক্ষক, ছাত্রবন্ধু, ব্যাকরণ কৌমুদি, রচনা বিচিন্তা, গ্রামার বই অথবা ফুলস্ক্যাপ কাগজ প্রয়োজনের সময় ঠিক পেয়ে যেতাম। বনেদী বাড়ীর ছেলেরা অনেক শখের জিনিষ পেত। আমরা পেতাম না। কিন্তু সে নিয়ে আমাদের কোনও অভিযোগ ছিল না।
পড়ার সময়ের বাইরে খেলাধুলার স্বাধীনতা ছিলো। ঠিক সন্ধের আগেই ফিরতে হত বাড়িতে। বাবার মতোই ছেলেমেয়েদের প্রতিটি কাজে মায়ের থাকত তীক্ষ্ণ নজর।
সকালে আমাদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই মা উঠে পড়তেন। শুরু হয়ে যেত দিনের কাজকর্ম। দুপুরে সামান্য বিশ্রাম। রাতে পরিবারের সকলের খাবার দাবার শেষ হলে তারপরে বিশ্রাম। ভীষণ অসুস্থ না হলে এ নিয়মের ব্যাতিক্রম হতো না। কিছু নিজের কাজ আমরা নিজে করতাম যেটা শিখিয়েছিলেন স্বাবলম্বী হবার জন্য।
ছেলেবেলায় খুব দূরদেশে যাবার সুযোগ আমাদের হয়নি। যেটুকু গিয়েছি শুধু মামাবাড়িতে । গ্রীস্ম বা পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ির গ্রাম্য পরিবেশে এক সপ্তাহ থেকে আবার সতেজ হয়ে আমরা ফিরে আসতাম।
তার চাহিদা ছিলো খুব সামান্য। হাতের কাজ শেষ হলে দু ব্যান্ডের রেডিওটি বড় প্রিয় ছিল তার। আকাশবাণী শিলিগুড়ির গানের অনুষ্ঠান গুলির তিনি ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। সময় পেলে বই পড়তেন। আর কখনও স্থানীয় সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা এলে দুপুরের শো তে যাবার ইচ্ছে থাকত।
ধীরে ধীরে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। স্কুল, কলেজ জীবন পার করে কর্মজীবন। পারিবারিক চিত্র ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে। কর্তব্য কিছুটা হয়তো করতে পেরেছি, পুরোটা নয়। বাবার পর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর হল। তার তীক্ষ্ণ নজরে আমাদের বেড়ে ওঠা।
পৃথিবী জুড়ে মায়েরা সাধারণত এমনই হন। শ্রদ্ধা আমাদের মা এবং পৃথিবীর সকল মাকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴