জননী কুন্তী/শিখা সরকার
জননী কুন্তী
শিখা সরকার
-------------------
রাজা কুন্তীভোজ পালিতা কন্যা কুন্তী।
হস্তিনাপুরের রাজমহিষী হয়েও
সারা জীবন কেটেছে নীরব সংগ্রামে।
অকাল বৈধব্য,সপত্নী বিয়োগের শোক
সয়েছেন একাকী।
নিজের সন্তান, সপত্নী সন্তান বিভেদ করেননি।
নিজের বুদ্ধিমত্তায়,প্রজ্ঞায় পঞ্চ পুত্রকে গড়ে তুলেছেন
ধার্মিক,সৎ, নির্ভীক এবং ক্ষত্রিয় জনোচিত বীর হিসেবে।
ধৈর্য, নিষ্ঠা, একাগ্রতায় ছিলেন স্থির।
বীর কুমারদের শিক্ষা দিয়েছেন নিজ অধিকার দাবি করার।
অন্যায় ভাবে যারা তাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
অধর্মের পথে নয়, ন্যায়ের পথে।
নিজে থেকেছেন অন্তরালে।
এক দুর্বিসহ সুকঠিন যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত ছিলেন সারাজীবন।
কুমারী কালীন ভুলের মাশুল তিলে তিলে দগ্ধ করেছে তাকে।
ভাগ্য বিড়ম্বিত এক পুরুষ,কর্ণ।
জন্মকালীন জননী পরিত্যক্ত।
পবিত্র এই শিশু কি সঙ্গে এনেছিল প্রারব্ধ ফল?
পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে তিনি বারেবারেই হলেন অপমানিত, লাঞ্ছিত।
তিনিও পুরুষ।
গুরুর কাছে বঞ্চিত অস্ত্র শিক্ষালাভে
তিনি যে সূতপুত্র!
অস্ত্র শিক্ষা পরীক্ষাকালে নিষেধ বাণী
তিনি যে সূতপুত্র।
লক্ষ্যভেদ সভায়-ভয়ে, শঙ্কায় পাঞ্চালীর বিদ্রোহ
তিনি যে সূতপুত্র।
দুর্যোধনের দাক্ষিণ্যে হলেন অঙ্গরাজ।
অঙ্গরাজ বসুষেণ যাপন করলেন গ্লানিময়, অধর্ম পূর্ণ জীবন।
হয়ে রইলেন দুর্যোধনের অন্নদাস।
অথচ তিনি ছিলেন-ধর্মপ্রাণ,দাতা,বীর।
যার মস্তকে শোভা পেতে পারত রাজছত্র--
তাঁর শিরোভূষণ ছিল সূতপুত্র।
পালিতা মাতার সম্মানে ছিলেন রাধেয়।
এক অজ্ঞাত টানে নিত্য ঊষাকালে সূর্য বন্দনা
পিতৃ চরণে নিবেদন শেষে দান-দক্ষিণা।
ভাগ্য বিড়ম্বিতা এক নারী কৃষ্ণা।
যজ্ঞ সম্ভূতা এক আশ্চর্য নারী রত্ন।
কার আরব্ধ কর্মের ভূমিকা কৃষ্ণা?
ধর্ম রক্ষার জন্যই কি তাঁর উদ্ভব?
যাজ্ঞসেনী বাধ্য হয়েছিলেন পঞ্চ পতি বরণে।
মাতা কুন্তীর বিধান মেনে নিয়েছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।
সেই পুরুষ সমাজ, কিন্তু রুখতে পারেনি কৃষ্ণার শ্লীলতাহানি।
কৌরব রাজসভায় অক্ষ ক্রীড়ায় পরাজিত যুধিষ্ঠির।
নতশির পঞ্চ স্বামী।
এক অসহায়,অথচ পঞ্চপতি শোভিত পত্নী কৃষ্ণা।
রাজকুলবধূ দাঁড়িয়ে রাজ সভায়।
ঘন মেঘের মতো কেশরাজি--
কলুষিত হল দূঃশাসনের দূঃসহ স্পর্ধায়।
তবুও কি রেহাই পেলেন পাঞ্চালী?
সর্বজন সমুখে হল বস্ত্র হরণ।
হায়,সহস্র চোখ ভূমিতে আনত--
অস্ফুট গুঞ্জন, ধিক্কার ধ্বনি সভাস্থলীতে
করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন অশ্রুমুখী দ্রৌপদী।
তাঁর দীর্ঘ-কৃষ্ণ-আলুলায়িত কুন্তল
আবৃত করে রেখেছিল তাঁর নগ্ন বুক,পিঠ এবং বাহুদ্বয়।
সুভগা কৃষ্ণা,নাথবতী কৃষ্ণা,কৃষ্ণ প্রিয়া কৃষ্ণা।
কর্ণের অধরে ছিল বিষাদ মাখা হাসির রেখা।
কুরুকুল প্রধান মহামতি ভীষ্ম তিনিও নীরব।
মহাত্মা বিদুর তিনিও বাকরুদ্ধ।
তাঁরাও যে দুর্যোধনের অন্নেই প্রতিপালিত।
কর্ণ-কৃষ্ণা দুজনেই সংযুক্ত এক নারীতে।
পৃথা, নিজের কর্মফল আরোপ করেছিলেন এক শিশুর জীবনে।
ভোগ্যবস্তু এবং সূত্র হিসেবে পাঁচ ভাগে,
ভাগ করলেন এক নারীকে।
বরমাল্য অর্জুনকেই দিয়েছিলেন দ্রৌপদী
তবু,ভাগ হতে হল।
পান্ডব জননী কুন্তী--
স্বামীর আজ্ঞায় ক্ষেত্রজ পুত্রের জননী।
মনের গোপন ক্ষোভ ঢাকতেই কি তিনি পাঁচ পুত্রের শয্যা সঙ্গিনী করলেন পুত্রবধূকে?
কানীন মাতা সারা জীবন থেকেছেন
পুত্র শোকাতুরা।
চোখের সামনে পরিত্যক্ত পুত্রকে দেখেও
পারেননি তাকে বুকে টেনে নিতে, স্বীকৃতি দিতে।
সমাজের ভয়,নিজ অবস্থানের ভয়।
গোপনে গিয়েছেন পরিত্যক্ত পুত্রের কাছে
মাতৃত্বের দাবি নিয়ে।
অপমান, দুঃখ, বঞ্চনা আর অভিমানে
দাতা কর্ণ ফিরিয়ে দিয়েছেন মাতা কুন্তীকে।
ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই দুর্লভ সম্মান,পঞ্চ পান্ডবের অগ্রজ
হয়ে যা ছিল তাঁর প্রাপ্য।
আঠারো দিনের যুদ্ধ শেষে
কৌরব বংশ হল নির্বংশ।
হল ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয়।
পান্ডবরাও চায়নি এমন রাজত্ব।
আত্মীয়হীন,স্বজনহীন,প্রজাহীন
শব দেহের স্তুপের রাজত্ব।
শুধু, অলক্ষ্যে ধর্মের ধ্বজা উড়ছিল
রক্ত নদীর মাঝে।
জননী কুন্তী, তুমি সার্থক।
এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিলে
পঞ্চ ভ্রাতাকে।
আর তাই অধর্মী কৌরব বংশের বিনাশ তুমি দেখলে।
মাতা কুন্তী? তোমার ব্রত উদযাপন আজ সফল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴