সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
28-July,2024 - Sunday ✍️ By- মমতা পাল চন্দ 238

জঙ্গুলে জীবন/মমতা পাল চন্দ

জঙ্গুলে জীবন
মমতা পাল চন্দ

অনেকেই অনেকসময় খুব অবলীলায় বলে ওঠেন কি জঙ্গুলে জীবন - কি জঙ্গুলে কথাবার্তা - জঙ্গুলে হাবভাব! কি জংলী মনোভাব রে!
আবার কেউ বলেন 'সেই জঙ্গুলেই রয়ে গেলি রে - আধুনিক আর হলি কৈ ? এই কথাগুলো আকছার শুনতে শুনতে অনেক মানুষ তার জীবন পথ পরিক্রমা করে দেয়। আসলে জঙ্গল যদি এতই খারাপ তাহলে কি করতে শহুরে আধুনিক মানুষেরা জঙ্গলে যায় ? ফ্ল্যাট এর এক চিলতে বারান্দায় একটু ফুল পাতা বাহার লাগিয়ে কৃত্রিম জঙ্গল তৈরি করে কেন ? তাহলে বুঝতে হবে সবুজ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কি করে পারবে ? মানুষ তো জঙ্গলেরই জাতক - আত্মজা। আসলে শহরের ব্যস্ততার ভিড়ের জন জঙ্গলে তো শান্তি নেই। মানুষ তো একা হতে পারে না। তাই দুদ্দার চলে যাওয়া দুদণ্ড শান্তির খোঁজে - প্রাণের আরাম আর মনের প্রশান্তির লোভে। যা শহর মানুষকে দিতে পারে না। জঙ্গলের পরিবেশ তো আসলে মানুষকে সমাহিত হতে শেখায়- যার মধ্যে থাকে অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি।  
যে মানুষ জন্ম থেকে জঙ্গলে বড় হয় সেই তো বেশি জানে বন আসলে বনবাসীদের জন্যই। মনের খেয়ালে বা দুদণ্ড শান্তির খোঁজে যারা লোক দেখানো জঙ্গলে যায় জঙ্গলের সাথে তাদের নাড়ীর টান তো তৈরি হয় না।
ভাবছেন তো কি করে বুঝলাম ? 

ওই যে বললাম জঙ্গলে যাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তারাই শুধু জানে জঙ্গলের কি মায়া ! কি রহস্য ! কি অবদান আর নাড়ীর টান।প্রকৃতির সাথে মানুষের লড়াই যেমন চলে তেমনি যে আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় তা কখনও ভোলা যায় না পরবর্তী জীবনে। জঙ্গলের বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব কি আর শহরের এসি পূরণ করতে পারে ? যদিও শহর আগে জঙ্গলই ছিল। শহরের মানুষও প্রকৃতির কোপে পরে কিন্তু শহরের মানুষ তো গ্রামের মত প্রকৃতির ডাইরেক্ট টাচ এ থাকে না। নিজেদের মত করে বানিয়ে নিয়েছে দুর্যোগ থেকে বাঁচার আরামপ্রিয় আবাস। তাই জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়াটা এযুগের শখ! দুদণ্ডের প্রাণের আরাম।

তাই জঙ্গুলে যাপনের গল্পটা বলি এবার। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কয়েকজন শিক্ষক এবং তিনজন ডাক্তার পরিকল্পনা করে আলিপুরদুয়ার শহরের খুব কাছে কালজানি নদীর উপকন্ঠে জঙ্গলের ধারে বহু একর জমি কেনেন এবং প্রায় প্রত্যেকে 30 বিঘে করে জমি নিয়ে একটি সোসাইটি গড়ে তোলেন। যার নাম দেন 'Birpara Jayanti co-operative Society'.

পরবর্তীতে দেশভাগের সময় আর কয়েকজন বিনিময় করে এদেশে চলে এলে মোট 30/32 টি পরিবার হয়ে যায় ওই সমিতিতে। যার মধ্যে দুটি পরিবার ব্রাহ্মণ আর সকলে কায়স্থ ক্যাটাগরির।ফলে সবার ভাগে 30 বিঘে করে জমি পরে নি। কিন্তু সবাই মিলে মিশে প্রত্যেক টি বাড়ি এমন সুন্দর করে গড়ে তোলেন যে প্রত্যেকের বাড়ির সামনে ফুল ফলের বাগান । পেছনে ফলের ভর্তি বাগান। গ্রামের মাঝখানে বড় খেলার মাঠ , প্রাইমারী স্কুল চারধারে বাড়িগুলো সাজানো ছবির মত ছিল। স্কুলের পাশে আমার জ্যাঠা কাকাদের বাড়ি। কিছু দূরে কাকার নামে সুধীর স্মৃতি গ্রামীণ পাঠাগার। তার কিছু দূরে জয়ন্তী সমবায় সমিতি হাই স্কুল। সারাদিন স্কুল, বিকেলে খেলাধুলা। গ্রামের পাশেই গহীন ফরেস্ট, মস্ত ঝিল, কলজানি নদী। আর ওই খেলাধুলা ফুল তোলা, বন কুল, কাঠ লিচু, মেওয়া,বড় গোলগোল কুল,  ডেউয়া, চালতা ফল কুড়াতে অনায়াসে জঙ্গলে চলে যেতাম আমরা ছোট বাচ্চারা। বাড়িতে প্রচুর ফলের গাছ থাকলেও সবাই মিলে ফরেস্টের ফল তুলে খাওয়ার স্বাদ আজকের বিরিয়ানি মমো চাউমিন এর থেকে ঢের বেশি ছিল। তবে বেলা থাকতে যেতাম। সন্ধ্যে বেলা যাওয়া বারণ। ডাক্তার জ্যেঠু এবং তার ছেলেদের ছাড়া কাউকে তেমন ভয় পেতাম না যদিও। তবুও প্রায়ই নদীর পারে বাঘ বেরিয়েছে বলে চিৎকার  হট্টগোল শোনা যেত। আর নিত্য সোনা যেত শেয়ালের হুকাহুয়া চিৎকার। সুর বেঁধে শেয়ালেরা গান গাইতো সন্ধ্যেবেলা। দিনের বেলা জঙ্গলে শেয়ালের গর্ত দেখতে যেতাম আমরা। মা বাবা দিদির কাছে বাঘের গল্প শুনতাম খুব। কিন্তু কোনো ভয় ডর এর বালাই তো ছিল না। আমি বাড়ির ছোট সদস্য ছিলাম। দেখতাম দিদিরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আলিপুরদুয়ার নিউ টাউন গার্লস হাইস্কুলে পড়তে যেত।  এবং দিদি অনিমা পাল শিক্ষকতার চাকরিও পেয়ে যায় ওই স্কুলে। এবং বিয়ের পর ও সুনিতি একাডেমী তে চলে যায়। আমার বড়দি জয়ন্তী খুব বাঘের গল্প বলতো। কারণ দুই দিদি একদিন উঠোনে খেলছিল তখন বিশাল বাঘ ওদের উপর দিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। তাই দিদি বাঘের কথা বলতো খুব । ভুলতে পারতো না বাঘের কথা কারণ ওর প্রিয় কুকুরকে বাঘ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড টানাটানি চলছিল বাঘ আর কুকুরদের। তখন আমাদের বাড়িতে কাজ করত একজন হিন্দুস্তানি লোক। সে নাকি বাঘকে বাঁশ দিয়ে মেরে দিদির কুকুরকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল সে যাত্রা। কুকুর নাকি ছাড়া পেয়ে এক দৌড়ে পাড়ার ঠাকুর বাড়িতে ঢুকে যায়। অনেক খুঁজে দিদি ওর প্রিয় কুকুরকে ফিরে পেয়েছিল। চিতা বাঘের নাকি প্রচন্ড উৎপাত ছিল তখন। প্রায়শই গোয়াল ঘরে ঢুকে যেত বাঘ। পোষা গরু ছাগল কুকুর নিয়ে চলে যেত। ফলে বাড়িতে সবাই কুকুর পুষত। বাঘ ভাল্লুক গ্রামে ঢুকলে কুকুর আগেই চিৎকার জুড়ে দিত বলে। একবার আমাদের পাশের বাড়ির মানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপক ড. কমল কান্তি নন্দীদের একটি গরুকে গোয়াল ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে পাট ক্ষেতের ভেতরে আরাম করে বাঘেরা খেয়ে যাচ্ছিল। এবার বাবার পরিচিত আলিপুরদুয়ারের বিশিষ্ট উকিল যিনি পশুশিকারে পারদর্শী ছিলেন। তাকে ডেকে আনলেন বাবা। সারাদিন বাড়িতে ভালো রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া হলো। প্রথমে ঘরের চালে উঠে দেখলেন উকিল বাবু। ভাবলেন টিনের চাল থেকে পড়ে যেতে পারেন। তাই সন্ধ্যের দিকে উকিল বাবু মই বেয়ে উঁচু গাছে উঠলেন বাঘ শিকার করবেন বলে। গাছে উঠে এক সাথে চারটি বাঘকে দেখতে পেলেন। তার মধ্যে একটি নাকি ছিল বিশাল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দেখে ভয়ে নাকি উকিলবাবু পড়িমরি করে গাছ থেকে নেমে বাড়িতে এসে রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোটবেলায় এ গল্প শুনে আমরা খুব হাসতাম। এখনো মনে পড়লে খুব হাসি আমরা। সবার বাড়ির পেছন দিকে তো ছিল জঙ্গল। তো একবার আমাদের পাড়ার সুনীল বিশ্বাস নামে এক ভদ্রলোক বেশ পাকাপোক্ত গুণ্ডা টাইপের চেহারা - পাকানো গোঁফ। তার বাড়িতে বাঘ আসে। সে একদিন দেখে তার বাড়ির পেছনের দিকে মা বাঘের পেছন পেছন তিনটে বাচ্চা বাঘ যাচ্ছে। মা বাঘ দুটো বাচ্চা সহ জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ব্যাস আর যায় কোথায় ! সুনীল বাবু বাঘের বাচ্চাকে নিয়ে চলে এলেন পাড়ার ক্লাব ঘরে। সবাই বাঘের বাচ্চাকে আদর করে পুলিশ কে খবর দেয় তারপর ফরেস্ট অফিসের লোক এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে যায়। তবে এর জন্য সুনীল বাবু নাকি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তখন জঙ্গলে অনেক বন মোরগ, ভল্লুক, বাইসন বাদর ছিল। তবে এরা কিন্তু তখন মানুষের ক্ষতি করতো বলে শুনিনি। বাঘেরাও মানুষ খেকো ছিল না। পশুদেরই মেরে খেত। খাবারের অভাব না থাকলে বোধহয় বাঘও মানুষ খেকো হয় না। ভাল্লুক বাদর নিয়ে লোকেরা কেউ খেলা দেখাতে কেউ ভিক্ষে চাইতে আসতো আমাদের ছোট বেলায়। তবে আমি গ্রামে বাঘ দেখিনি সত্যি কোনোদিন। তবে বড় বড় সাপ দেখেছি। বাইসন, ভাল্লুক সজারু ধরা দেখেছি। আর অনেক বড় বড় প্যাঁচা, পাখি ময়ূর শকুন বাজপাখি দেখেছি। কিন্তু ওই এলাকার যারা আগে জমির মালিক ছিলেন মানে যাদের কাছ থেকে বাবা কাকারা জমি কিনেছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন যারা তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাবুদের কাছে জমি বিক্রি করেন নি। তাদের একজন ছিলেন ধীরু সর্দার আর জটা নামের আর এক ব্যক্তি গ্রামের ধারে নদীর কাছাকাছি থাকতেন। আমি ভীষণ ফর্সা জটার গায়ে বাঘের উল্কি আঁকা দেখেছি। জটার চেহারাও ছিল বিশাল। তবে ধীরু সর্দার এর মত এত বিশাল চেহারা আমি কোনো বিদেশীরও দেখিনি। রক্ত লাল চোখ, কালো পেটানো চেহারা ,মাথায় পাগড়ি বিশাল লম্বা লম্বা হাত পা। কাঁধে তীর ধনুক আর হাতে বর্ষা অথবা বল্লম। পশু শিকার করে নিয়ে আসতো বাড়িতে। আমরা ভয়ে ভয়ে দেখতে যেতাম উঁকি ঝুঁকি দিয়ে। ওদের বাড়িতে পশু মেরে উৎসব হতো। উঠোনের মধ্যে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে পশুর মাংস দিয়ে হাঁড়িয়া খেত ওরা। তারপর শুরু করতো ঢোলক মাদল নিয়ে নাচ গান আর চিৎকার। ধীরু সর্দার মাঝে মাঝে বাইরে আসতো। ওকে দেখলে খুব ভয় পেতাম। আমাদের পাড়ায় ওর ডাক না পড়লে  আসতো না। কিন্তু অনেক সময় পাড়ার পাশ দিয়ে যখন যেত। কি অজানা একটা ভয় কাজ করত মনে। লোকটা কিন্তু কারো ক্ষতি করতো না। কিন্তু ওর জমি বা জঙ্গলের ক্ষতি কাউকে করতে দিত না। লোকটা সবাইকে দেখতো কিন্তু কোনো কথা বলতো না। এখন এতকাল পরে খুব মনে হয় যদি আজকের শহর বা গ্রাম জঙ্গলের ধারে যেখানে জমি লুট হয় যদি ধীরু সর্দারের মত বনবাসীরা থাকতো!

এবার আমাদের কথা বলি আমরা যারা জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে বড় হয়েছি। আমাদের বাড়িগুলো তো ছিল গাছপালা ঘেরা আদর্শ গ্রাম। যেখান থেকে হেঁটে শহরের স্কুল কলেজ যাওয়া যেত। গ্রামে সুপারি বাগান, লিচু বাগান, কলা বাগান, বাঁশ বাগান, সবজি বাগান, ফলের বাগান  সবার বাড়িতেই ছিল। আমাদের বাড়িতে 16টি আমগাছ 17টি কাঁঠাল গাছ, সুপারি বাগান, 6 টি লিচু গাছ, লটকা পেয়ারা, কামরাঙা,কালো জাম, গোলাপ জাম, বাতাবিলেবু, আতা এমন কোনো ফল গাছ নেই যা কয়েকটি করে বাড়িতে ছিল না। ফলে গাছের ডালে বসে লাল কামরাঙা , লটকা, গোলাম জাম লালসাদা জামরুল খাওয়া আমাদের যেমন নিত্যদিনের অভ্যেস ছিল। তেমনি শহরের আত্মীয় বন্ধু বান্ধবী এবং পরিচিতরা ফল সবজি নিতে হাজির হতেন আমাদের বাড়িতে নতুবা পাঠিয়ে দেওয়া হতো বাড়ি বাড়িতে সব মরশুমে।
তাই যারা জঙ্গলের কাছে থাকে ,যাদের বাড়ি ঘরেই  গাছপালা ভর্তি তাদের সাথে গাছপালা জঙ্গলের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের মত। গাছের ভেতর যে জারিত রসের সংবহনতন্ত্র তার সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটে। একটা গাছ রোগাক্রান্ত হলেই চলতো নানান পরিচর্যা। বর্ষা বৃষ্টি, কুয়াশায় গাছের পাতায় কি খুশির বার্তা বয়ে যায় তা যারা নিত্যদিন দ্যাখে তারা অবাক হয় না স্বাভাবিক বলে ভাবে।  কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অমলতাস, শিমুল পলাশের সাথে খুশিতে রঙিন হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষও। আবার পাতা ঝরার সময় মন খারাপির বেলা। আবার চৈত্রের শেষে ঝড়ো বৃষ্টির পর কচিপাতা উঁকি দিতেই নতুন জীবনের বার্তা ছড়িয়ে যেত দিক থেকে দিগন্তরে।

তবে জঙ্গল জীবনে মানুষকেই কি দেয় ? কি শেখায় ?  জিজ্ঞেস করলে বলবো জঙ্গল মানুষকে সৎভাবে লড়াই করে বাঁচার শক্তি দেয়। সবাই মিলে একসাথে বাঁচার মন্ত্র শেখায়। জটিলতা কুটিলতাহীন উদার পরিশ্রমী  মানষিকতার জন্ম দেয়। অপর প্রজাতি বা প্রাণীদের প্রতি মমত্ববোধ সহমর্মিতা শেখায়। বনের পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব শেখায় যাদের ওড়ার দৃশ্য মানুষকে তার স্বপ্ন উড়ানের পথ চেনায়। আর চিন্তা চেতনায় বন  জঙ্গল প্রকৃতির সাথে মা সন্তানের সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করে। আমরা যখন গ্রাম থেকে স্কুলে যেতাম আমাদের বলতো ওরা না বীরপাড়া ফরেস্টের মেয়ে। অনেকে ফরেস্টকে বিকৃত করে বলতো ফরাস্টের মেয়ে। কিন্তু আমাদের ভয়ও পেত খুব ওরা। দৌড়ের ট্রাক এ কিংবা ফুটবল মাঠে বলতো এই ফরেস্টের ছেলেমেয়েরা সব প্রাইজ নিয়ে যাবে। ওদের কেউ হারাতে পারবে না। আর স্কুলেও ফরেস্টের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মেধার পরিচয় দিত। ফলে মানুষের মনে হিংসে নয় সমীহ ছিল ফরেস্টের ছেলেমেয়েদের জন্য। শহরের ছেলেমেয়েরা বলতো আমাদের কথায়  নাকি বাংলাদেশী টান আছে। তবুও আমরাই শহরের স্কুল, ক্লাব, যুব উৎসব থেকে সবাইকে হারিয়ে বিতর্ক,গান, আবৃত্তিতে ছিনিয়ে নিয়ে আসতাম পুরস্কারগুলো। এছাড়া জীবনের 26টি বছর আকাশবাণীতে উপস্থাপিকার কাজ করেছি assignment basis এ। উচ্চারণ ছিল সম্পূর্ণ টানহীন বিশুদ্ধ। আর বার বার অবলীলায় চাকরি ছেড়ে চাকরি পেয়ে যাবার শক্তি আর তেজ আর সহ্য শক্তি গ্রামের মাটি আর জঙ্গলই আমাদের দিয়েছে বলে আমি আজও বিশ্বাস করি। কারণ জঙ্গল মানুষকে ফাঁকি দেওয়া শেখায় না। নদীতে বন্যা এলে প্রায়ই যে গ্রাম বানভাসি হত। পলি পরত। তা সত্বেও সব মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে আবার গ্রামকে যে কে সে করে তুলতো। শুধু গাছের পাতা আর গাছের গায়ে থেকে যেত বন্যার স্মৃতি চিহ্ন। জীবনে এ লড়াই যারা শেখে তাদের একে অপরের প্রতি সম্মান এবং এক বিবেচনাবোধ জন্ম নেয় ফলে তারা সহবস্থানে বিশ্বাস করে আর সেখান থেকে জন্ম নেয় ত্যাগ এর নির্লোভ হবার অনুভূতি। আর মানুষ নির্লোভ হতে পারলেই সর্ব শান্তি  হাতের মুঠোয় - মনের গহ্বরে চলে আসে। এবার এই মন নিয়ে চলে যাওয়া যায় বন্য প্রকৃতির কোলে। তখনই আসলে বোঝা যায় জঙ্গল কি সুন্দর ! মনের অশান্তি দুর করতে জঙ্গলের আশ্রয় সোজা নয়। মনের সব জমা জঙ্গল ঝেড়ে জঙ্গলকে ভালবাসতে যেতে হবে। যেমন করে সন্তান যায় মায়ের কাছে ভালোবাসা পেতে তেমনিভাবে। জঙ্গল তখনই শুধু অকৃপণ হাতে মানুষকে প্রশান্তি দেয়।

বীরপাড়া চৌপথি ছিল শহর লাগোয়া। তার থেকে এক কিলোমিটার দূরেই ছিল ছবির মত দেখতে আমাদের গ্রাম। চারধারে ঝিল পুকুর নদী নারকেল সুপারি গাছের সারি। দূর থেকে দেখা যেত গাছের পাতার মাথায় লাল হলুদ পাকা আমার মেলা।
জীবনের কিশোরী বেলা কেটেছে ওই গ্রামে। পরে শিলিগুড়ি শহরে চলে আসি। কত জঙ্গলে ঘুরতেও গেছি পরে। কিন্তু নিজের গ্রামের জঙ্গলের সাথে যে আত্মীয়তা ছিল বা আছে সেটা না ঠিক পাই না। জঙ্গল দেখে খুশি হই খুব। সাথে সাথে নিজের ছোটবেলার সাথী সে জঙ্গলের কথা কি করে যেন মনে চলে আসে। এখনো যখন যাই সে গ্রামে দেখি পুরোনো গ্রামের সেই সৌন্দর্য্য তেমনই আছে আজও। তবে ওই পাড়ার চারধারে এখন অনেক বসতি। বাড়িঘর আরও সুন্দর হয়েছে তবে গাছপালা অনেকই আছে। আগের মত ফরেস্ট যদিও নেই। তবুও মন থেকে জঙ্গল তো আর সরে যায় নি। রাতে ঘুমের ঘোরে প্রায়ই চলে যাই সে গ্রামের গলিপথে, খেলার মাঠে, নদীর ধারে, জঙ্গল লাগোয়া ফলের বাগানে। জামার থলি কোচর ভরে ফল কুড়িয়ে কামড়ে ফল খেতে নিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি শুয়ে আছি শহরের কংক্রিটের জঙ্গলের বিছানায়। তখন লীলা মজুমদারের কথাটি খুব মনে পড়ে " জঙ্গল থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায় কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে জঙ্গল তুলে নেওয়া যায় না। " ঠিক তেমনি তা মানুষের জীবনেও একইরকম ভাবে প্রযোজ্য বলে মনে হয় আমার। জঙ্গলের থেকে মানুষকে শহরে আনা যায় ঠিকই। কিন্তু বনবাসী মানুষের মন থেকে জঙ্গলের অনুভূতি  মুছে ফেলা যায় না।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri