জঙ্গলের সাহিত্য/মাল্যবান মিত্র
জঙ্গলের সাহিত্য
মাল্যবান মিত্র
গজমুক্তার খোঁজে নিরস্ত্র অবস্থায় হাতি ধরতে যাওয়া হোক বা কুমায়ুনের জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘ শিকার ; ঋজুদার কাছ থেকে জঙ্গলের পাঠ নেওয়া হোক কিংবা কাকাবাবু রাজা রায়চৌধুরির সাথে আসামের জঙ্গলে চোরাশিকারি দের বিরুদ্ধে লড়াই, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে জঙ্গল বারংবার এসেছে নানান আঙ্গিকে।
বেদ উপনিষদ থেকে রামায়ন বা মহাভারত, রচয়িতারা বনে জঙ্গলে থেকে নিজেদের সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে আলো আধাঁরের লুকোচুরি খেলার মধ্যে দিয়ে ধুসর মানব মনে অরন্য প্রভাব বিস্তার করেছে নিরলস ভাবে এবং বারবার সাহিত্যচর্চার অন্যতম বিষয় হিসাবে সৃষ্টির অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে।
বিশ্ব সাহিত্যের দিকে চোখ ফেরালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকের মায়াবী বন, ইতালীর বিখ্যাত লেখক দান্তের লেখা ‘দি ডিভাইন কমেডির ‘ নরকযাত্রার বা ইনফার্নোর পথের অরণ্য বা জার্মান লেখক গ্রিম ব্রাদার্সের লেখা ব্ল্যক ফরেস্ট বা আমেরিকার লেখক নাথানিয়েল হথর্নের বিখ্যাত গল্প ‘ইয়ং গুডম্যান ব্রাউন’-এর মতো উপাখ্যানে অলীক কল্পনার মিশেল বা লোকসাহিত্যধর্মী রবিন হুডের গল্প যা পরবর্তীকালে এই ধারার অন্যতম উত্তরসূরী হিসাবে রুডিয়ার্ড কিপলিঙ, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল প্রমুখ লেখকরা নিজেদের সৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের অরণ্যকে তুলে ধরেছেন সুনিপুন ভাবে।
যদিও বাস্তবের অরণ্য ও কল্পনার অরণ্য আলাদা তবু বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রথম সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে যেই কপালকুন্ডলা উপন্যাসের নায়ক নবকুমার সঙ্গীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন,সেই তবে থেকে আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যে অরণ্যের আর্বিভাব। এরপর সন্জীব চাটুজ্জের পালামৌ, বিভূতিভূষণের অপরাজিত, আরণ্যক - চাঁদের পাহাড় হয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের ব্রেজিলের কালোবাঘ বা ফেলুদা সিরিজের রয়েল বেঙ্গল রহস্য সবেতেই জঙ্গল হয়ে উঠেছে সাহিত্যের চরিত্র।
অন্যপ্রান্তে কালকূট সমরেশ বসু নিজের ‘দুই অরণ্য’ উপন্যাসে লিখেছেন নগরজীবন ও আরণ্যক জীবনের দ্বন্দ্বের কথা যে দ্বন্দ্বের আরেকটি বাঙ্ময় বর্ননা লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী নিজের ‘অরণ্যের অধিকার‘ উপন্যাসে। পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা অরণ্যের দিনরাত্রির জঙ্গল ধরা দেয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে।
তবে বাংলা সাহিত্যে অরণ্যের চরম স্ফুরন ঘটিয়েছেন যিনি তিনি হলেন বুদ্ধদেব গুহ, তাঁর লেখায় নায়ক 'বাঘের মতো বাঁচতে চায়'। তাঁর কাহিনীতে নায়ক ঘন জঙ্গলের ঘ্রাণকে ভালবাসে। 'বন জ্যোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে‘ থেকে ‘কোজাগর’, ‘গামহারডুংরী’ থেকে ‘কোয়েলের কাছে' অথবা ঋজুদা সিরিজের ‘বনবিবির বনে’, ‘রুআহা’ বা ‘আ্যলবিনো’ সবেতেই অরণ্য ও তার প্রতি প্রেম ধরা দিয়েছে অনন্য ভাবে। তাঁর জীবন জুড়ে ছিল অরণ্য। প্রকৃতির প্রতি নিখাদ প্রেম। যে প্রেমের ছোঁয়া পেয়েছে তামাম পাঠককুল। বুদ্ধদেব গুহর প্রথম গল্প সংকলন জঙ্গল মহল- ষাটের দশকে প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে একের পর এক উপহার দিয়েছে বুদ্ধদেব গুহর লেখনী।
শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা ট্রিলজি ‘হাতিবোঙ্গার অরণ্য’ ‘ সওদাগর’ ও ‘ রায়মঙ্গল’ অরণ্য নিয়ে লেখা অন্যতম সেরা কাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে থাকা সুন্দরবন নিয়ে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ডমরুচরিত’, শিবনাথ শাস্ত্রীর সুন্দরবনের বাঘের গল্প যোগীন্দ্রনাথ সরকার সংকলিত ‘বনেজঙ্গলে’ অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক। হেমেন্দ্র কুমার রায় একজন বর্ণময় সাহিত্যিক, যাঁর হাতে সুন্দরবন অন্য রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাঁর অমর সৃষ্টি 'সুন্দরবনের রক্ত পাগল', "সুন্দরবনের মানুষ বাঘ'। বিশ্বকবি সমগ্র বিশ্ব ও ভারতে পরিভ্রমণ করেছেন, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা হল ঘরের কাছে সুন্দরবনের মায়াবী অরণ্যের হাতছানি তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি। রবীন্দ্র সাহিত্যে তাই সুন্দরবন একটা অধরা পটভূমি। সুন্দরবনের গোসাবাতে তিনি হ্যামিল্টন সাহেবের আমন্ত্রণে ১৯৩২ সালে গিয়েছিলেন কিন্তু সুন্দরবনের পটভূমিতে একটি গল্পও তিনি লেখেননি। রবীন্দ্রোত্তর শরৎচন্দ্র শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে মেজদার মুখে শুধু “দি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের” কথা বসিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। তবে কথাসাহিত্যিক রাজশেখর বসু সুন্দরবনের দিকে চোখ মেলে তাকিয়েছেন ও লিখেছেন তাঁর ‘দক্ষিণরায়’ সুন্দরবনের পটভূমিকায় লেখা অনবদ্য গল্প। তবে সুন্দরবনের অসামাণ্য রূপকার হলেন মনোজ বসু। তাঁর ‘জলজঙ্গল’, ‘বনকেটে বসত’, উপন্যাস দুটি সুন্দরবনের সংগ্রামী মানুষের জীবন পাঁচালি তথা বৃত্তিকেন্দ্রীক জীবনের বিশ্বস্ত দলিল। কথাসাহিত্যিক মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সুন্দরবন কেন্দ্রীক বিখ্যাত উপন্যাস হল 'হলুদ নদী সবুজ বন'।
ভারতীয় ঐতিহ্যে গাছের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, বলা হয়েছে যে একটি গাছ উদারতার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ কারণ গাছ তাদের যা কিছু আছে যেমন ফল, ফুল, পাতা, শিকড়, ছাল এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বাংশ অন্য জীবকে প্রদান করে। গাছ এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে মানবতাকে জানান দেয় মানুষের উচিত তাদের ভাগ্য এবং গুণাবলী অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়া। সেই জন্যই হয়তো ত্রেতা যুগে রামের বনবাস বা দ্বাপরে পান্ডবদের বনবাসের আখ্যান মহাকাব্যে স্থান পায়, বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যে বর্নিত হয় জঙ্গল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴