জঙ্গলের যন্ত্রণা/অরিন্দিতা বিশ্বাস
জঙ্গলের যন্ত্রণা
অরিন্দিতা বিশ্বাস
পিকনিকের মরশুমে প্রতিবারের মতো সেবারও অফিসের পিকনিক হবে। ছোট ছোট স্কুলের বাচ্চাদের মুক্ত পরিবেশে নিয়ে যাওয়ার এক্সকারসন নাম হলেও আমাদের দায়িত্বের মাঝেও হুল্লোড় করতে ভালোবাসা আমি পিকনিক বলতেই বেশ আনন্দ পাই। ছোটদের সুরক্ষিত ভাবে রেখে প্রকৃতির মাঝে সারাদিন কাটানোর খুব ভেবেচিন্তে সুন্দর প্রকৃতির নিরাপদ জায়গা ঠিক করতে হয়। প্রতিবার নতুন জায়গা কিন্তু খুব দূর না হয়ে এলাকার আশেপাশে যেতেই হবে।এর তার কাছে শুনে নতুন জায়গা প্রতিবারই দেখতে যেতেই হয় এক্সকারশনের নির্ধারিত দিনের আগেই। দুই হাজার পনেরো সালের বারোই জানুয়ারি আজও সেই তারিখ ভুলি না।আমরা চার জন স্টাফ আর স্যার দুপুরের খাবার সেরে বিকেল তিনটে নাগাদ চললাম স্পট দেখতে।
বীরপাড়া থেকে মাদারিহাট ঢোকার আগেই হাইরোড থেকে মেঠো পথে জলদাপাড়া জঙ্গল দিয়ে যেতে হবে এই ভেবেই আনন্দে আছি কারণ এই জলদাপাড়া আমার বড্ড প্ৰিয়। প্রেমের অনেক স্মৃতি যা ধ্রুবতারার মতো জ্বল জ্বল করছে সেই হলং বাংলো পুড়ে আজ তা ইতিহাস কিন্তু তার চারপাশে আমার অবিরাম বিচরণ থাকে স্মৃতির আবরণে। গাড়ি হাইরোড থেকে জঙ্গলের দিকে টার্ন নেবে ঠিক তখনই হটাৎ একটি লোক হাত দেখায় আর চেচিয়ে বলতে থাকে - ঢুকবেন না...ঢুকবেন না... সামনেই গণেশ বাবা দলবল নিয়ে এসেছে, ওদিকে গেলেই বিপদ। গাড়ি থামল। আমি বরাবরই একটু ডানপিটে ভয়ডর খুব কম তাই সবার বারণ না মেনে নেমেই পড়লাম হাতির দল দেখব বলে। রাস্তার ওপারে গিয়ে চশমার কাঁচ মুছে দেখি ঐ তো হাতি ছোট থেকে বড়ো অনেক গুলো মনে হচ্ছে যেন সব প্রজন্মের পরিবার এক সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে। ছোট ছোট ছানাদের যেন গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । খুব উচ্ছসিত হোলাম আর ভাবলাম কলকাতা থেকে কত পরিবার ডুয়ার্স বেড়াতে আসে হাতি দেখবে বলে। আর আমরা যখন তখন দেখতে পেয়ে যাই। আর জঙ্গল লাগোয়া বস্তি গুলোতে যেন ওদেরই রাজত্ব যখন তখন। সেই লোকটি বলেছিলো ২৬ টি আমি গুনতে গিয়ে গুলিয়ে দিয়েছি। স্যার বললেন গাড়ি ভাড়া করে এসেছি আর স্পটে যাওয়া হবে না তা হয়না, ওরা কিছুই করবে না মানুষ যদি ওদের ক্ষতি না করে ওরাও করে না আর সবাই দেখো অনেকটাই দূরে আছে হাতির দল। সত্যিই দেখে যেন কত শান্ত নিষ্পাপ শিশুর মতো। জঙ্গলের ভেতর রাস্তায় ঢুকলাম। বিকেল পোনে চারটে মনে ভয় হচ্ছিল তবুও গাড়ির ভেতর থেকে জঙ্গলের গাছেদের সাথেও যেন কত গল্প শোনাচ্ছিলাম। আর ওখান থেকেই হলং বাংলো আর যেতে পাশে কাঠের ব্রিজের হাতে হাত রেখে হাঁটা স্মৃতির মোড়ানো অতি যত্নের আদুরে গল্প গুলো সব যেন গাছেদের সাথে ভাগ করে নিলাম। আমার মনের নিঃশব্দে যেন কত পাখি গান বাঁধলো। বড়ো বড়ো গাছ তবুও মাঝে মাঝেই গুড়ি কাঁটা গাছ গুলো দেখে বুকটা চিনচিন ব্যাথা অনুভব হলো।ব সূর্যের কিরণের অবাধ উঁকি ঝুকি দেখে জঙ্গলের অতি পরিচিত অন্ধকার হারিয়ে যাওয়ায় বিক্ষোভ মনে হচ্ছিলো । হলদেটে ঝরা পাতাগুলো যেন পরম যত্নে কোনো শিল্পী বিছিয়ে রেখেছে আর সেই ঝরা পাতা গুলো যেন হারিয়ে যাওয়া গাছেদের জন্য উড়ে উড়ে কেঁদেই চলছে । খয়ের বাড়ি উদ্যানে এসে পৌঁছলাম।গেট পাস নিতে গিয়ে সামনে দেখি কত টাঙানো ত্রিপাল দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে। টেবিল পেতে ভাজাভুজি বিক্রি করছেন দম্পতি দোকানি। দোকানের খুটি নেই, ছাওনি নেই, সব ছিন্নভিন্ন। দোকানি বলল কাল রাতে গ্রামের কত ঘর বাড়ি ভেঙে তান্ডব নৃত্য করেছে ওরা! আমাদের কত জনের অনেক ক্ষতি হয়েছে কেও আজ দোকান খুলতে পারিনি শুধুই আমরা। চোখের সামনে তখন সব প্রজন্মের হাতি দেখার আনন্দ কোথাও যেন মিলিয়ে গেল। শুধুই না দেখা ওই ভাঙা ঘরগুলো, জমির মারিয়ে দেওয়া ধান , সব শেষ হওয়া মানুষ আর জঙ্গল কেটে পশুদের আস্তানা শেষ হতে দেখে ওদের ক্ষিদের জ্বালায় সমস্ত বন লাগোয়া গ্রামে ঢুকে যায় মানুষের খাবার খায় ক্ষিদে মেটাতে দুর্বিসহ ধ্বংস স্তুপ চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমাদের পাড়ায় সেরকম হাতি আসে না। গ্রামে আসে বাজির মৃদু আওয়াজ আসে পরদিন নানান তান্ডবের গল্প শুনি। তবে গোপালপুর চা বাগানে আসে ঘর ভাঙে। জমির ধান খায় আবার মাঝে মধ্যেই কাঠ কুড়োনিদের তাঁদের খাদ্য কেটে ফেলার প্রতিশোধ নেয় শুড়ে পেঁচিয়ে মেরে দেয়। গাছ কেটে কেটে কাঠ পাচারী দুই হাতে টাকা গোনে। আর নিঃস্ব হয় জঙ্গল, নিঃস্ব হয় জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের মানুষ, কত পাখি হারিয়ে যায়, কত প্রাণী লুপ্ত হতে থাকে। ক্ষিদের যোগানে বেরিয়ে যায় হাতির দল সপরিবারে, বাঘেরা মানুষের মাংসের স্বাদ পায়। আমি এখানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ঠাকুরের কোনো আশীর্বাদ দেখতে পাইনি ।বাড়ি ফিরে আসি একরাশ আনন্দ কুড়োতে গিয়ে অরণ্য ধ্বংসের এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে।কাঠ মাফিয়ার অত্যাচারে অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিছুই করতে না পেরে এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে আছি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴