জঙ্গলের কথকতা/সমাপ্তি চৌধুরী
জঙ্গলের কথকতা
সমাপ্তি চৌধুরী
ছোটবেলা থেকেই জঙ্গল আমাকে খুব টানে। জঙ্গলের নানারকম গাছপালা, নাম না জানা অদ্ভুত সব রঙবেরঙের পাখি, হরিণ দলের ছুটে চলা, বিভিন্ন জঙ্গুলে পশুদের ক্রিয়াকলাপ,অপরূপ সুন্দর নৃত্যরত ময়ূরের দেখা পাওয়া----- জঙ্গলের সামগ্রিক রূপটাই আমাকে আকর্ষণ করে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা ও একঘেয়েমির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গল ভ্রমণের ছোঁয়া আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত হতে শিখিয়েছে।
ডুয়ার্সের চা বাগানে থাকার সুবাদে জঙ্গুলে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন কখনও কখনও বাড়িতে বসেই হয়ে যায়। হঠাৎ কখনও মধ্যরাতে বাঙলোতে দাঁতাল হাতির কাঁঠাল খাওয়া বা নিস্তব্ধ দুপুরে চা বাগানের রাস্তায় হঠাৎ চিতার শিকার ধরা, আবার কখনও বা ময়ূর দলের কেকারবে মুখরিত সকাল দেখা - ইতিমধ্যে সব অভিজ্ঞতাই মনের ফ্রেমে বন্দী করতে পেরেছি।
বর্তমান বাসস্থান জঙ্গলের কাছাকাছি হওয়ার জন্য, দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে দু- এক দিন ছুটি পেলেই গরুমারা, জলদাপাড়া যেন হাতছানি দেয়। বেশ কয়েকবার এই অভয়ারণ্যগুলো ঘোরা হয়েছে বলে ছেলের আবদারে গতবছর সপরিবারে চলে গেলাম চিলাপাতার জঙ্গলে। উঠলাম এক বনবাংলোতে। দুপুরে লোকাল মাছ দিয়ে মধ্যাহ্ণভোজন সেরে নিয়ে চলে গেলাম জঙ্গল সাফারীতে। ময়ূর ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা না গেলেও ওই নিবিড় জঙ্গলের মাদকতা ও বুনো গন্ধ মনকে যেন আবিষ্ট করে রাখে। মাতাল জঙ্গুলে গন্ধ তীব্র এক পিছুডাক ছড়িয়ে রাখে। মন অজান্তেই বলে ওঠে - " আবার আসিব ফিরে,,,,,,,"
ইতস্তত সবুজ আলোয়ান গায়ে জঙ্গুলে পথে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরিবেশটা আরও মায়াবী করে তোলে। বনবাংলোর বারান্দায় সান্ধ্যকালীন চা- পকোড়ায় যখন মজে আছি, তখনই দূরে হঠাৎ কীসের আওয়াজে ঘোর কাটল। 'অন্ধকার বিদিশার নিশা'য় রাতচড়া পাখিদের ডাক অতিক্রম করে আরও এক ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল। নিকষ কালো অন্ধকারে জোনাকির ইতিউতি আনাগোনা ছাড়া দূর-দূরান্তে কিছুই দেখা গেল না। উৎকণ্ঠায় ভরা কয়েকটা মুহূর্ত কাটানোর পর বনবাংলোর কর্মীদের কাছে জানতে পারলাম ওটা জংলি হাতির আওয়াজ। মাঝে মাঝেই রাত্রে তেনারা আশেপাশের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। সেই রাতে ওখানে লোকজনও কম ছিল। সারা রাত্রি বেশ একটু ভয় ও উত্তেজনায় কাটল। পরের দিন সকাল সকাল বাংলোর আশেপাশে ভাল করে ঘুরে দেখলাম। দেখতে পেলাম তেনাদের পদচিহ্ন। যেন বলে গেছে - এই পথে এসেছিলাম আমি।
এবার ফেরার পালা। আবার দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় ছুটে বেড়াতে হবে। উপলব্ধি করছিলাম জঙ্গলের জীবন অত্যন্ত ধীর গতির এক অদ্ভুত সুন্দর ছন্দে বাঁধা। জঙ্গল পৃথিবীর জীব বৈচিত্রের আধার। বন্যপ্রাণী ও তার বাসস্থান তথা জঙ্গলকে সংরক্ষণের মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের অস্তিত্বের চাবিকাঠি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴