সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
04-August,2024 - Sunday ✍️ By- অমিতাভ গোস্বামী 254

জঙ্গলে অমঙ্গলের ছায়া/অমিতাভ গোস্বামী

জঙ্গলে অমঙ্গলের ছায়া 
অমিতাভ গোস্বামী
----------------------------

রবীন্দ্রনাথের অমোঘ বাণী -'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু' যে কতদূর সত্য তা নিয়ে বোধ করি কারো মনে কোন সন্দেহ নেই। তথাপি আমরা সর্বদাই দূরদেশকেই মোহময় মায়াবী বলে মনে করি আর তার পেছনে ধাবিত হই অথচ ঘরের পাশে আরশিনগর কে বিস্মৃত হই। আমাদের উত্তরবঙ্গে বিশেষত দার্জিলিং জলপাইগুড়ি আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলাতে ঘর থেকে হাত বাড়ালেই প্রকৃতি যে অনুপম সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে আছেন সেটা আমরা নিয়মিত স্বাভাবিকভাবে দেখি বলে এর অসাধারণত্বকে অনুধাবন করতে পারিনা। আর এই পাহাড় বন জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলের পরিবেশে কি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে সে বিষয়ে আমরা অনেকটাই অসচেতন থাকি। অবশেষে হঠাৎ এক ধাক্কায় আমরা চক্ষুষ্মান হই। 
              বেশ কিছুদিন থেকেই মেয়েরা বলছিল-'চলোনা বাবা, দুদিন ডুয়ার্সে থেকে আসি।'কিন্তু যাচ্ছি যাবো করে, আর হয়ে উঠছিল না। অবশেষে এক শনিবার সকালে বেরিয়ে পড়লাম। জলপাইগুড়ি শহর থেকে পাহাড়পুর মোড় অতিক্রম করে তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ হাতে দোমহনীর রাস্তা ধরলাম। বাহন আমার আদ্যিকালের অযান্ত্রিক অল্টো আর সঙ্গী স্ত্রী ও কন্যাদ্বয় এবং স্টিয়ারিং এ বিশ্বস্ত সুব্রতদা। দোমহনী এলেই আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। একসময়ের বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ের জমজমাট হেডকোয়ার্টার জংশন আজ ভগ্ন দেহে অতীতের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহাকালের গর্ভে আজ সবকিছুই বিস্মৃত প্রায়। এককালের বিখ্যাত পল হোয়েল স্কুলকে পাশে রেখে গাড়ি এগিয়ে চলল। আমি মেয়েদের বলে চললাম অতীত গৌরবের কথা। ওদের প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছেলেবেলা এই দোমহনীতেই কেটেছে। তাঁর  লেখা সব অদ্ভুতুড়ে গল্প উপন্যাসের বীজ রয়ে গেছে এখানকার মাটিতে সেটা আমি তাঁর নিজের মুখেই শুনেছি। মৌলানি পেরিয়ে লাটাগুড়ি ঢুকেই গাড়ি উঠে পড়ল ঝাঁ চকচকে ফ্লাইওভারে। মেয়েরা সমস্বরে বলে উঠলো-'এ রাম! এটা আবার কে কবে বানালো! কি বিচ্ছিরি হয়ে গেছে আমাদের সুন্দর লাটাগুড়িটা।' বুকটা টনটন করে উঠলো। মনে পড়লো চাকরি জীবনের প্রথম দিকের কথা। সে প্রায় 35 বছর আগের কথা। জলপাইগুড়ি থেকে মালবাজার অফিসে প্রতিদিন এই পথেই যাতায়াত করতাম। এই লাটাগুড়ি জঙ্গল হয়েই। তখন কত সুন্দর গভীর অরণ্য ছিল। দিনের বেলাই গা ছমছম করত।এখনকার মত এত দোকানপাট বা মানুষজন ছিল না। ছিল প্রকৃতি তার  অকৃপণ সৌন্দর্যের পশরা নিয়ে। প্রায়ই হাতির দলের সঙ্গে দেখা হতো আমাদের। গাড়ি স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যেত। আমরা মনে মনে মহাকালকে স্মরণ করতাম যতক্ষণ না তেনারা সদলবলে রাস্তা অতিক্রম করে জঙ্গলে প্রবেশ করতেন। অনেক সময় দেখেছি এক বা একাধিক বাইসন হরিণ ময়ূর ইত্যাদি। একবার তো ফেরার পথে চিতাবাঘ ও দর্শন হলো। তিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকিয়ে এক লাফে রাস্তা অতিক্রম করে চলে গেলেন। সে সবই এখন স্মৃতি। আড় চোখে তাকিয়ে দেখি মেয়েদের চোখ ছল ছল করছে। ওরা বির বির করে বলে চলেছে- কেন এটা বানাল ! কি করে ওদের বোঝাই আমি নিজেই তো নিশ্চিত নই কয়েক হাজার বৃক্ষচ্ছেদ করে ফ্লাইওভার বানানোর যৌক্তিকতা নিয়ে! আজ যেখানে সমগ্র বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদরা আমাদের পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সেখানে যোগাযোগ ও নগরায়নের নামে এদেশে চলছে অবাধে বৃক্ষচ্ছেদন। শুনেছি উন্নত দেশে প্রয়োজনে গাছকে মূলসহ তুলে অন্যত্র স্থাপন করা হয়। হাজার হাজার গাছকে কেটে ফেলার কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। পশ্চাদপদ দেশ বলে কি আমরা চিন্তা চেতনার জগতেও পিছিয়ে আছি! অধিকন্তু এখানে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে রেললাইন। ভিস্তাডোম কোচে বসে শহুরে বাবুরা প্রকৃতি দর্শন করতে আসেন আর নিরীহ অবলা বন্যপ্রাণীরা রেললাইন পার হতে গিয়ে কাটা পড়ে। অরণ্যের ভেতরে ধীর বেগে গাড়ি চালানোর নিয়ম থাকলেও তাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ বেগে গাড়ি ও ট্রেন ছুটছে। দেখার কেউ নেই। যে দেশে মানুষের জীবনেরই দাম নেই সেখানে বন্যপ্রাণীদের জীবন যে মূল্যহীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাড়ি এগিয়ে চলল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। মধ্য দুপুরেও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে এ অঞ্চলকে। মাঝে মাঝে ঝিঝির ঝংকার, অচেনা পাখির ডাক আর গাড়ির আওয়াজ সেই নীরবতাকে ভঙ্গ করছে। গাড়ি ধীরে ধীরে জঙ্গল অতিক্রম করে ডান হাতে মূর্তির রাস্তা ধরল। আমাদের গন্তব্য মূর্তি নদীর ধারে জঙ্গল ঘেরা এক হোটেল বা রিসোর্ট।

হোটেলের ঘরে জিনিসপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতেই বিকেল গড়িয়ে গেল। আমরা সবাই নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। বর্ষার জলে টুইটম্বুর নদী যেন চঞ্চলা কিশোরী। নদীর অপর পাশে সাল সেগুন শিরিষ ঘেরা ঘন জঙ্গল। দূরে পাহাড় আবছায়ার মত। এই নির্জন জঙ্গলের পাশে নদীর ধারে বসে কথা বলতে ভালো লাগছিল না। আমরা এক মনে নদীর কথকতাই শুনে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্রতিদিনকার চেনা জগতের বাইরে এ যেন এক অপার্থিব জগত। ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার ক্রমশ ঘনীভূত হল। হোটেলের লোক তাড়া দিতে লাগলো যে এখন বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। আগত্যা আমরা হোটেল কম্পাউন্ডের মধ্যে প্রবেশ করে ঘরের বারান্দায় বসলাম। চা জলখাবার শেষে একসময় সবাই নিজেদের ঘরে প্রবেশ করল। আমি এক ফাঁকে সবার অলক্ষে আবার বেরিয়ে পড়লাম।

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। জোৎস্নালোকিত নদীর ধারে অজানা ফুলের গন্ধ সুবাসিত বনপথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এই পরমা প্রকৃতির কাছে পৃথিবীর সব সম্পদ ই তুচ্ছ। জঙ্গলের মধ্যে মিটিমিটি জোনাকি জ্বলছে। ঝিঝিঁ পোকার চিৎকার আর মাঝে মাঝে অজানা বণ্য প্রাণীর ডাক সেই নৈঃশব্দ কে খান খান করছে। মনে হয় এ যেন এক স্বপ্নময় কল্পনার জগত। স্ত্রী ও মেয়েরা চিন্তা করবে বলে এক সময় ফিরে এলাম হোটেলের ঘরে।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে মশাল জ্বালিয়ে হল আদিবাসী নৃত্য। তারপর যে যার ঘরে ঢুকে গেল। আমি বসে রইলাম বারান্দায় একা। স্ত্রী ও মেয়েরা দু চারবার ডেকে রণে ভঙ্গ দিল। রিসোর্টের প্রহরী একবার এসে সতর্ক করে গেল কোন অবস্থাতেই যেন গেটের বাইরে না যাই। গেটের বাইরে হাতি আর চিতাবাঘের আনাগোনা প্রতিনিয়ত লেগেই আছে। আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। দূরে অন্ধকারের চাদরে মোড়া জঙ্গলকে মনে হচ্ছিল এক রহস্যময় জগত। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানিনা আকস্মাৎ রাত্রের নীরবতাকে বিদীর্ণ করে পরপর দুবার গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম তার সঙ্গে বন্যপ্রাণীর চিৎকার। প্রহরী এসে বলল- 'সাব বাইরে থাকবেন না ।ঘরের ভেতরে ঢুকে যান। বিপদ হতে পারে।' আমি ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু বাকি রাত আর ঘুম প্রায় হলোই না। সকালে উঠে চা খেয়ে স্ত্রীকে বললাম- 'আমি একটু বনবস্তির দিক থেকে হেঁটে আসি।'

বনবস্তির ভেতরে প্রবেশ করে কিছুটা অগ্রসর হতেই দেখি এক চায়ের দোকান। সামনে মাচায় বসে এক বৃদ্ধ এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আমি অবাক। আরে     তিরকিদা না! বৃদ্ধ এক গাল হেসে বলল -'চিনতে পেরেছিস তাহলে!' আমি লজ্জিত সুরে বললাম ,'কি যে বল তিরকি দা। তোমাকে আমি চিনব না। কতদিন কত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি।'বৃদ্ধ বলল-'চল তাহলে আমার বাড়িতে। তুই তো আর এদিকে আসিসই না।' আমি বললাম -'সত্যি অনেক বছর বাদে এলাম। তবে আজ তোমার বাড়িতে যাব না ।সঙ্গে মেয়েরা আর স্ত্রী আছে। একদিন সবাই মিলে একসঙ্গে যাব। আজ এখানে বসেই দুটো কথা বলি। তারপর বল তুমি এখন কেমন আছ? শরীর স্বাস্থ্য বাড়ির সব খবর ভালো তো?' তিরকিদার মুখে যন্ত্রণা চিহ্ন ফুটে উঠলো। বলল ,'নারে সেসব ঠিকই আছে কিন্তু সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই।' আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। বৃদ্ধ বলে চলল,'চারপাশে সব কিছু খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বুঝলি। এত লোকজন হোটেল রিসোর্ট আমার আর ভালো লাগে না বুঝলি।' আমি বললাম - 'কেন এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। বেচাকেনা বাড়ছে ।ভালোই তো।' বৃদ্ধ যন্ত্রনাকাতর স্বরে বলল ,'শুধু সেটাই দেখলি। কিভাবে সরকারি খাস জমি দখল করে, গরিব আদিবাসীদের জমি লোভ দেখিয়ে বেআইনিভাবে দখল করে রিসোর্ট হচ্ছে সেসব দেখলি না। এখানে যারা বেড়াতে আসে তাদের অধিকাংশই আসে নির্জনে মদ খেয়ে ফুর্তি করতে। তাদের লোভের ফাঁদে পড়ে এলাকার মা-বোনেদের ইজ্জত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তারা না ভালোবাসে প্রকৃতিকে না ভালোবাসে পশুপাখি বা এলাকার গরিব আদিবাসী মানুষদের। জানিস কি গরুমারার জঙ্গল ঘেঁসে এক বড় নামকরা কোম্পানি ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। কিনবে শহরের কোটিপতিরা। এই বন জংগল আর প্রকৃতি কিছু থাকবে ভেবেছিস! এলাকার কত মেয়েরা জলজ্যান্ত হারিয়ে গেছে। শুনেছি তাদের নাকি বাইরে কোথাও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এর উপর জুটেছে আবার চোরা শিকারির দল। কাল রাতে গুলির আওয়াজ শুনেছিস? হয়তো খবর পাবি জঙ্গলের ভেতরে কোথাও গন্ডার মেরে খর্গ কেটে নিয়ে গেছে। খবরের কাগজে উঠবে ।দু চারদিন কথা বার্তা হবে। তারপর আবার চুপচাপ যে কে সেই। আমরা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছি রে। শুধু সামনে রাস্তার ধারে ফেসওয়াশ মাখা জঙ্গল দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে সব ফাঁকা।' বৃদ্ধের কথায় ছিল এক তীব্র হাহাকার। আমি বিষন্ন হয়ে পড়লাম। কোন কথাই আর মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদে ধাতস্থ হয়ে বৃদ্ধ বলল-বুকের ভেতরে খুব কষ্ট হয় রে। অনেক দুঃখ থেকে কথাগুলো বলে ফেললাম। তুই ভালো মানুষ তুই আমাদের কষ্টের কথা তোর মত মানুষদের বলিস। সরকার কিছু করবে কিনা জানিনা তবু যদি কিছু পাল্টায়।' হঠাৎ তাকিয়ে ঘড়িতে দেখি কখন একটা বেজে গেছে। আমি বললাম, 'আজ বেলা হয়ে গেছে। অনুমতি দাও যাই।' বৃদ্ধ বলল , 'যাবি যা ।আবার আসিস কিন্তু। সবাই মিলেই আসিস।' ছল ছল চোখে বিদায় নিয়ে রিসোর্টে ফিরে এলাম। মনটা বিষণ্ণ হয়ে রইল। 

 দুপুরে স্নানাহার শেষে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে। মনটা উদাস হয়ে আছে। লাটাগুড়ি ঢুকতেই দেখি ফ্লাইওভারের মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালদেহী দাঁতাল গজরাজ। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যেন প্রতিবাদ করছে -এই এলাকা, এই জঙ্গল আমাদের। এখানে এইসব নির্মাণ অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত। আমরা কিছুতেই মানবো না। দূরে দাঁড়িয়ে জোড় হাতে প্রণাম জানালাম। গজরাজ ধীরে ধীরে পাশের জঙ্গলে চলে গেল। আমরাও গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। মনে মনে বললাম সত্যি ই জঙ্গল ঘিরে এই অমঙ্গলের ছায়া আমরা কিছুতেই মানবো না। একে বাঁচাতেই হবে। তবেই পৃথিবীটা সুন্দর বাসযোগ্য হবে। মনে মনে গেয়ে উঠলাম-'এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়- নাহি চায়।'            

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri