ছায়াসঙ্গী/ঋতুপর্ণা ধর
ছায়াসঙ্গী
ঋতুপর্ণা ধর
অশীতিপর জীবেশবাবুর দিনগুলো কেটে যায় নিঃশব্দে। একসময় যিনি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সুনামের শিখরে উঠেছিলেন জ্ঞানে, বাচনে, আজ তিনি এক ধুলোমলিন বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দেন আর শুনে যান পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের হেসেখেলে বেড়ানো।
বাড়ির কোণায় স্ত্রীর ছবি, ধুলোমোছা একটুকরো ফ্রেমে—চোখে অপূরণীয় শূন্যতা।
পুত্র ক্যালিফোর্নিয়ায়, কন্যা কাতারে—দুজনেই চাকরি সূত্রে প্রবাসী। বছরে একবার, নিয়ম করে তিনি সন্তানদের কাছে যান। বিদেশি মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে, ট্রেনে-বাসে চড়ে, বা পার্কের বেঞ্চে বসে—
তাঁর সংগ্রহে জমে ওঠে নতুন নতুন মুখ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন স্বভাব, ভিন্ন সংস্কৃতি। ফিরে এসে সেই মুখগুলিই তার সঙ্গী হয়ে ওঠে মোবাইল ফোনের পর্দায়।ফেসবুক, হোয়াটস্যাপে প্রতিদিন কুশলবার্তা, ভিডিও, ছবি, মজার মিম ঘুরে বেড়ায়। কখনো চেরি ব্লসমের ছবি, কখনো ঘরোয়া চিকেন স্যুপের রেসিপি, আবার কখনো-কখনো কেউ বলে—"জীবেশ, তুমি একদম দাদুর মতো! মনে হয় তোমায় চিনি অনেককাল!" এই বন্ধুত্বের মধ্যেই একদিন জোরালো হয়ে উঠল একজন—ডোনাল্ড। মার্কিন মুলুকের নিউ জার্সির এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বছর পঁচিশ বয়স।
সুদর্শন, সদাহাস্য, মিষ্টভাষী - একবার কথা বললেই হৃদয় জিতে নেবে এমনই এক তরুণ। প্রথমে শুভেচ্ছা বিনিময়, তারপর গল্প—কখনো কর্মজীবনের, কখনো প্রেমভাঙার। ধীরে ধীরে জীবেশবাবুর দিনগুলো ডোনাল্ডময় হয়ে উঠল। ডোনাল্ড সকাল হলে বলে উঠত, "গুড মর্নিং, দাদু!" আর জীবেশবাবু লিখতেন, “ভোরের আলোয় আজ টগর ফুল ফুটেছে। কী সুন্দর, জানো?”
এই বন্ধুত্বে বয়সের ব্যবধান গলে যায়। ভাষার বাধা পেরিয়ে গড়ে ওঠে এক অন্তরঙ্গ সেতু। এভাবে বছরখানেক কেটে যায়।
একদিন হঠাৎ এক সন্ধ্যায়,
ডোনাল্ডের বার্তা:
“দাদু, খুব বিপদে পড়েছি! gpay কাজ করছে না, আমার কাছে এখন ৫০০ ডলার দরকার। একটা গ্রসারি বিল দিতে হবে। কাল বিকেলেই টাকাটা তোমার অ্যাকাউন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেব।”
জীবেশবাবু থমকে যান।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, এমন আন্তরিক, এমন নির্ভরযোগ্য একজন মানুষ কি ঠকাতে পারে?
পরক্ষণেই ভিতর থেকে আরেকটি কণ্ঠ বলে—"সে কি আমার নিজের ছেলের চেয়েও কম আপন?"
তিনি বিশ্বাস করেন। অতি সন্তর্পণে তুলে আনেন নিজের ব্যাংক কার্ড, দেন অ্যাকাউন্ট ডিটেলস, পাঠিয়ে দেন অর্থ।
তারপর...
সন্ধ্যা নামে।
রাত গাঢ় হয়।
পরদিন সকালে মোবাইল খুলতেই বার্তা—“লগ ইন ফেল্ড। ইউজার নট ফাউন্ড।” জীবেশবাবুর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে গেছে।
অ্যাকাউন্টে মাত্র ক'শো টাকা অবশিষ্ট। ডোনাল্ড—তার কথা, হাসি, ছবি—সব মুছে গেছে অনন্ত জালে।
সেই থেকে মোবাইল ফোনটা আর আগের মতো ব্যবহার করেন না জীবেশবাবু। তবে বারান্দায় বসে মাঝে মাঝে হাতে ছুঁয়ে দেখেন মোবাইলটা—
একসময় এটিই ছিল তাঁর সঙ্গী, তাঁর ‘ছায়াসঙ্গী’।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴