চোখদুটো পিছু ডাকে
চোখদুটো পিছু ডাকে
ভাস্বতী রায়
--------------------------
রোজকার মতোই দিনটা শুরু হয়েছিল। তবে বড়িতে একটা খুশির আমেজ চলছে। কারণটা আমাদের পরিবারে বহুবছর পর একটা পুচকু এসেছে । ছুটি
থাকলেও একটা বিশেষ ডিউটি পরে যাওয়ায় কেউ পুচকুকে দেখতে যেতে পারিনি। তাই সকালে উঠেই জল্পনা চলছে ওকে দেখতে যাওয়ার। আমি লিষ্ট
বানাতে ব্যস্ত পুচকুর জন্য কি কি কিনব। আমি এক সন্তানের মা। তাই এই সময়ে বাচ্চার কি কি লাগে যা নিজের সময় পরে জেনেছি সেগুলো সব লিষ্ট করছি। এমনিতে কেনাকাটি করতে আমার পাগলের মতো ভালো লাগে। হঠাৎই একটা খবর এলো আর আমাদের হাসি মুখগুলো নোনা জলে ভেসে গেল।
হ্যাঁ, আমার বড় জা দীর্ঘ পনেরো বছর পর একটা ফুটফুটে পুচকুকে উপহার দিয়েছে। এতদূর পর্যন্ত খুব ভালো ছিল। ঘড়িতে ঠিক ন'টা বড়ো ভাসুরের ফোন "তোমরা শিলিগুড়ির কোন খবর পেয়েছ?" না বলাতে
বললেন হেনার হার্ট এটাক। হেনা আমার মেজো জা।এতদূর পর্যন্ত ঠিক ছিল। ভাবলাম হতেই পারে।কর্তার স্কুলে কি পরীক্ষা আছে, আমার অফিস খানিকটা হালকা আছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বললাম আমি
শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছি। কিন্তু পরের খবরটা বোধহয় আমাকে দিতে চাচ্ছিলেন না। ভাইকে বললেন। ওদের
কথোপকথনে বুঝলাম আমার জা সবাইকে ফাঁকি দিয়েছে। ও না ফেরার দেশে চলে গেছে। সত্যি
এই খবরটার জন্য কোনওভাবেই তৈরি ছিলাম না।খবরটা যাচাই করতে সাহস করে ছোট ভাসুরকে ফোন করলাম।
আনন্দে ঝলমল করা বাড়িটা দুম করে বিষাদের কালো ছায়ায় ভরে গেল। বাড়ির সব সদস্যকে জরো করে যখন শিলিগুড়ি পৌঁছলাম, গোটা নার্সিং হোম পুলিশ আর পরিবারের বাকি লোকজনের ভিড়ে গিজগিজ করছে
নার্সিং হোম অথোরিটি ,ডাক্তার ,নার্স কারো টিকিটি দেখা পেলাম না। আর নার্সিং হোমের একটা বেডে জায়ের নিথর দেহটা পরে আছে। এ দৃশ্য কখনো দেখতে হবে কল্পনার অতীত ছিল। আমার চোখ তখন পুচকুকে খুঁজছে।জানতে পারলাম ওকে অন্য নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওখানে ICUএ আছে। কেউ এলাউড নয়। সেদিন জায়ের
শ্মশানের কাজ সেরে কোচবিহার পৌঁছতে পৌঁছতে রাত একটা। আমার কর্তা থেকে গেলেন শিলিগুড়িতে। পুচকুকে আর সেদিন দেখা হল না।
তিন চারদিন পর পুচকুকে ঘরে আনা হল। আর শনি রবিবার পরে যাওয়ায় আমি দৌড়ালাম পুচকুর কাছে। জানেন দুদিনের স্পর্শ আর এতটা কাছের হওয়া, অনুভব করলাম নিজের মাঝে এক নতুন মাকে। আমার কোলে এলেই ওর হা করা মুখটা আর
নিস্পাপ চাহুনি কিছু যেন খুঁজে বেরায়। ওর মায়াবী চোখ দুটো দেখলে আমার চোখ নোনা জলে ভরে ওঠে। রবিবার বাড়ি ফিরে সারারাত কেঁদে ভাসালাম। পরদিন কিছুতেই অফিসের কাজে মন দিতে পারছিলাম না, অপেক্ষা করছিলাম শুক্রবারের। কারণ সেদিন থেকে চারদিন পুচকুর সঙ্গে থাকতে পারব। চারদিন যেন চার সেকেন্ডে শেষ হয়ে গেল।
আজ ভারী মজা হচ্ছে আসলে কাল দেখা হত ওর সঙ্গে। কিন্তু রাতে কর্তার ফোন তুমি শুক্রবার ছুটি নাও।
আমাকে আর পায় কে! তল্পিতল্পা গুটিয়ে চললাম পুচকুর কাছে। আজ থেকে আরো চারদিন পুচকুর সঙ্গে থাকতে পারব। একটা ছোট্ট প্রাণ আমাকে নতুন করে আর একবার মা হওয়ার সুযোগ করে দিল।
ওর ছোট্ট মায়াবী চোখ দুটো যে বড্ড পিছু ডাকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴