চৈত্রের অবসানে ফিরে এসো নতুন পল্লবের মতো/শ্রাবণী ভট্টাচার্য
চৈত্রের অবসানে ফিরে এসো নতুন পল্লবের মতো
শ্রাবণী ভট্টাচার্য
প্রিয় অন্তরাদি,
বড় বেদনা নিয়ে তোমাকে চিঠিখানি লিখছি। তুমি আমার কৈশোর, প্রথম তারুন্যের নায়িকা। কী অপূর্ব লাগত তোমাকে! বিশ্বভারতী থেকে বাংলায় এম এ করেছ তুমি। কী অসাধারণ গান গাইতে তুমি!! জানো, স্কুলের অনুষ্ঠানে তোমার গান শোনবার জন্য বসে থাকতাম। কী অপূর্ব গান। রবি ঠাকুরের গানই বেশি গাইতে তুমি। নজরুলের গানও গাইতে অসাধারণ। তোমার কন্ঠ যেন খাজুরাহের মন্দির। শিল্পীর দক্ষতার ছাপ ফেলে দেওয়া সর্বাঙ্গ। ঐ যে গো যেবার স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে চিত্রাঙ্গদা হল, তুমি চিত্রাঙ্গদার কন্ঠের গানগুলি গেয়েছিলে। আহা! কী সেই গান, "বধূ কোন আলো লাগলো চোখে". আর তোমার সেই কন্ঠে "আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্রনন্দিনী'!! আহা! সত্যিই তুমি রাজেন্দ্রনন্দিনী ছিলে! কী সুন্দর করে সাজতে তুমি। ওমন করে কাউকে এ তল্লাটে সাজতে দেখিনি। সেজেছ, অথচ সাজোনি!কি অপরূপ স্নিগ্ধতা আর লাবন্য। অমন করে সাজতে তোমাকে কে শিখিয়েছিল? রবি ঠাকুর নিজে?
তোমাকে সেদিন শপিং মলে দেখে চমকে উঠেছিলাম। তুমিই কী ছিলে আমার সেই অন্তরা দি? ওমন অযত্নের চেহারা। পোশাকের পারিপাট্য নেই একেবারেই।তোমার সাথে দুজন কিশোর, কিশোরী ছিল। তোমার ছেলে,মেয়ে বোধহয়। মেয়েটি বোধহয় পোশাক র্নিবাচন নিয়ে তোমার সাথে খুব তর্ক করছিল। বুঝতে পারছিলাম দূর থেকে, কেমন দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছিলে। এমনই হয় গো। আসলে সন্তান যে আমাদের ভিন্নতর সত্বা তা আমরা মানতে চাই না। সন্তান যতদিন মাতৃজঠরে থাকে ততদিন মা আর সন্তান অভিন্ন। কিন্তু তারপর! নাড়ি কেটে দিলেই দুজন পৃথক মানুষ। আমাদের বুঝে নিতে হবে এই সত্যিটা। ওদের জন্য নিজস্ব যা কিছু আছে ত্যাগ করেছ।
শ্বশুরবাড়ির লোক তোমার গান গাওয়া পছন্দ করত না। এমনকি তোমার স্বামীও নয়। ওরা নাকি বলত ফরিদপুরের বনেদী বাড়ির লোকেরা বাড়ির বউদের রাস্তার মেয়েদের মতো গান গাওয়া পছন্দ করত না। তাই শুধু স্কুলটুকু করতে দিত আর কি!! ওটা তো টাকা পয়সার ব্যপার। ওখানে কী চট্ করে না বলা যায়! হায় কোথায় বাংলাদেশ! কোথায় ফরিদপুর! আর কোথায় বনেদিয়ানা! প্রথম যৌবনে সব মেনে নিয়েছিলে। ভালোবাসার জন্য। পেলে কী সেই কাঙ্খিত ভালোবাসা। যার পায়ে নিজের সবটুকু ভালোলাগা উজাড় করে দেওয়া যায়? আচ্ছা, যে অন্তরাকে ভালোবাসবে সে অন্তরার গান ভালোবাসবে না তাও কি হয়! কি যে সব ভালোবাসার হিসেব!
আমি বিশ্বাস করি না অন্তরাদি, গান ছাড়া তুমি ভালো আছ। তুমি ফিরে এসো অন্তরাদি। চৈত্রের অবসানে নতুন পল্লবের মতো তুমিও ফিরে এসো এই নববর্ষের সূচনায়। তোমার কন্ঠে আবার তুলে নাও গান। নিজস্ব একটা জগৎ গড়ে তোল। যেই জগতে তুমিই একমাত্র অধিশ্বরী। নহ মাতা, নহ কন্যা। তুমি অনন্যা হও নিজের মৌলিকতায়। প্রতিটি মেয়ের এই নিজের পৃথিবী থাকা খুব দরকার। নইলে একটা বয়সের পর প্রবল একাকীত্ব গ্রাস করে তাকে। কিছু না করতে পারার হতাশা। কী লাভ জীবন সায়াহ্নে এসে কাউকে দোষারোপ করার! র্নিমাণ কর আরেকবার তোমার নিজস্ব পৃথিবী। যে পৃথিবীতে অর্জুনের বিরহ নেই, কুরূপার শোক নেই। নিজের অস্তিত্বকে ছাড়িয়ে অন্য কিছু করার তাগিদ নেই। যেখানে শুধুই আছে সৃষ্টি সুখের উল্লাস। ফিরে এসো অন্তরা দি। এই বৈশাখে, রবি কবির আলোয় স্নান করে অভিষিক্তা হও। তোমার পথ চেয়ে থাকব রবীন্দ্রভবনে, পঁচিশে বৈশাখের দিন।
ইতি -
শ্রাবণী
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴