চিরস্থায়ী/সৌগত ভট্টাচার্য
চিরস্থায়ী
সৌগত ভট্টাচার্য
স্কুল বেলায় বাংলা পরীক্ষা। কবিতার একটা লাইন তুলে প্রশ্ন এসেছে — “কবি কে? কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত? এই পংক্তির দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?”
প্রথম প্রশ্নের উত্তর অবধারিতভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! উত্তর ঠিক হলেও তিনি, ভুল হলেও তিনিই।
ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ নামটার সাথেই কবি হিসাবে পরিচয় হয় সব বাচ্চার, আমারও তেমন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ও কবি সমর্থক। যত উঁচু ক্লাস হয় ততই তিনি গীতিকার সুরকার গল্পকার নাট্যকার ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি হয়ে ওঠেন।
আমার স্কুলজীবন জুড়ে ছোট বড় মাঝারি এক দুই পাঁচ দশ নম্বরের প্রশ্ন হয়ে থেকে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। আর প্রশ্ন অনুসারে সবসময়ই তিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে কিছু একটা নাকি বোঝাতে চাইলেন, যা আমি কোনোদিন বুঝে উঠতে পারলাম না! আরেকটু উঁচু ক্লাসে উঠলাম, শুরু হল “রবীন্দ্রনাথ” রচনা লেখা — মাতার নাম পিতার নাম, শিলাইদহ-জোড়াসাঁকো নাইট উপাধি… মুখস্ত করেও যখন হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় নম্বর পেলাম না, ক্লাসে বন্ধুদের সামনে তিরস্কার শুনলাম, সে বছর রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে তিরস্কারের কারণ হিসেবে এলেন। কোনো একটা ক্লাসের পরীক্ষার প্রশ্নে কোথা থেকে কী সব লাইন তুলে বলল, ভাব সম্প্রসারণ করো, সে বছর তিনি হয়ে গেলেন ভাব সম্প্রসারণ। এমনই একদিন অনেক চেষ্টা করেও মনের ভাবকে অনেক টেনে টুনেও সম্প্রসারিত করতে পারিনি, স্যার আমাদের কয়েকজনকে ঘরের বাইরে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এমন সময় পাশের স্কুলের মেয়েরা এসেছে আমাদের স্কুলে সরস্বতী পূজার নিমন্ত্রণ করতে, আমাদের পাশ দিয়ে তারা চলে গেল… ওরা চলে যাওয়ার পর জেনেছিলাম ভাবসম্প্রসারণ এর লাইনগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখা!
শীতকাল। ফোর্থ পিরিয়ড। শংকরবাবু সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে মন্দ্রস্বরে কর্ন কুন্তি সংবাদ পড়াচ্ছেন। খুব যে মনোযোগ দিয়ে শুনছি এমন না, কিন্তু শুনছি এই ভানটা দেখানোর চেষ্টা করছি। শ্রবণ আর আত্মীকরনের মধ্যে বারবার বিস্তর দূরত্ব। আমাদের ক্লাসরুম থেকে অফিস ঘরটা দেখা যেত। জানলা দিয়ে এক ভাবে বাইরে তাকিয়ে আছি। সুরেনদা কখন টিফিনের ঘণ্টা বাজাবে। শংকরবাবু প্রতিটি লাইন ধরে কুন্তীর আর্তির কথা পড়াচ্ছেন। আমার সব আর্তি ঘণ্টার শব্দের দিকে। সেই শব্দের পর একটা শীত-সবুজ মাঠ একটা টিফিন বেলা। কিছুক্ষণ পর সুরেনদা ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গেছে, শংকরবাবু পড়িয়েই যাচ্ছেন। অন্য সেকশনের বন্ধুরা সব মাঠে বেরিয়ে ক্রিকেট খেলছে, গল্প করছে, বল ছুঁড়ে দিচ্ছে আকাশের দিকে, শীতের রোদ্দুর তখন কৃষ্ণচূড়া গাছের মগডালে বসে পা নাচাচ্ছে। আর আমি? ক্লাসরুমে বন্দি, একমাত্র রবীন্দ্রনাথের জন্য, এত বড় কবিতা লেখার কোনো অর্থ হয়! যে কবিতার দৈর্ঘ্য আমাকে টিফিন বেলায় খেলতে যেতে দেয় না, ক্লাস রুমে বন্দি করে রাখে, সে কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা।
সেই সময় আমার বিপুল এক রং বেরঙের জগতের হাতছানি। সাইকেল, বরফ, পাশে মেয়েদের স্কুল, ইউনিফর্ম, স্যারদের গোপন নামে ডেকে নিষ্পাপ আনন্দ, সিনেমা হলের পোস্টার, সরস্বতী পূজার নিমন্ত্রণ, বিকেলে ক্রিকেট, রাতে চিত্রহার, রবিবারে অন্য পাড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ, আর কত সব নিষিদ্ধ যাওয়া আসা… সেখানে আমার জীবনে আর যাই থাকুক রবীন্দ্রনাথ কখনোই ছিলেন না। তিনি শুধু পঁচিশে বৈশাখ ধুপধুনো একটা ছবিতে চন্দনের টিপ। আর? আর রবীন্দ্রনাথ অতটুকুই ছিলেন যিনি গল্প নাটক বা কবিতার মধ্যে দিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চেয়েছেন আজীবন, যেটা পরীক্ষায় লিখতে হয়, নইলে নম্বর পাওয়া যায় না।
তিনি যতই শিশু কিশোর স্কুল পাঠ্য লিখুন না কেন। ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ তিনি তাড়া করছেন পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে। যদিও নোট বই স্যারের নোট আছে, যেখানে গুছিয়ে এক দুই পাঁচ দশ সব নম্বরের প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে। মাষ্টারমশাই বা নোট বইয়ের লেখক তো লিখেই রেখেছেন আমার জন্য, রবীন্দ্রনাথ আদতে কি বলতে চেয়েছেন! সেটাই আমার মনে হওয়া!
যথারীতি, তিনি যা বলতে চেয়েছেন আর নোট পড়ে আমি যা পরীক্ষার খাতায় লিখেছি সেটার মধ্যে জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহের দূরত্ব থেকে বেশি। নম্বর কাটা গেল। বাড়িতে বকা খেলাম ফেল করার জন্য। সব বকার পেছনে তিনি থেকে গেলেন। বাংলায় ফেলের জন্য আবার দায়ী করলাম তাকেই।
স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হচ্ছে। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে উচু ক্লাসের দাদাদের আঁকা রবি ঠাকুরের মুখ। তার সামনে একটা ফ্রেম বাঁধানো রবি ঠাকুরের ছবি, যার কপালে চন্দন সামনে টগর আর চাপা ফুল। যারা গান জানে কবিতা জানে তারা গাইছে আবৃত্তি করছে আমরা বসে শুনছি। যে গান গুলো ক্লাস ওয়ান থেকে গোটা স্কুল জীবন শুনে এসেছি, বলা ভালো বাধ্য হয়েছি শুনতে। এইসব শুনতে শুনতে ভাবি কখন ছুটি হবে এই উৎসব থেকে। বৈশাখের গরমে ভালো লাগত না, বাইরে তখন অনেকটা খোলা হাওয়া। রবীন্দ্রনাথ আমার স্কুল জীবনে এতটা জায়গা জুড়ে থাকবেন সেটা কখনও কল্পনা করি নাই। রাস্তায় মাঠে ঘাটে বাড়িতে সব জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বাজছে। প্রাণে আছেন কী না সেই বয়েস বুঝি নাই, কানে একটা রবীন্দ্রনাথ বাসা বাঁধে আমার অজান্তে। প্রেয়ার লাইন থেকে জাতীয় সঙ্গীত সব জায়গায় তিনি উপস্থিত। স্কুল জীবনে আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একপ্রকার সিলেবাসের বাধ্যবাধকতা। যাকে না পড়লে নম্বর কাটা যায়।
মাঝে বেশ অনেক কয়টা দশক কেটে গেল। ভূমিকা বদল হল। শংকর বাবুর মতো আমিও এখন চেয়ার টেবিলে বসে ক্লাস নিই। জলিওওয়ালাবাগ পড়াই, বঙ্গভঙ্গ পড়াই, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গান্ধী কেন বারবার ছুটে আসছেন শান্তিনিকেতনে সেটা বলার চেষ্টা করি, আফ্রিকা কবিতাটি লেখার সময়কাল বোঝানোর চেষ্টা করি, রাশিয়ার চিঠির কথা বলি — আসলে ওই যে বললাম ভূমিকা বদল হয়, কোনো কোনো ছাত্র আমার মতো জানলার বাইরে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে …আমার শংকরবাবুর মুখটি মনে পড়ে, কুন্তীর আর্তির কথা মনে পড়ে।
এবছর পরীক্ষার খাতা দেখছি। প্রশ্ন এসেছে, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কে চালু করেন?” এক ছাত্র উত্তর দেয়,
“কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
উত্তরটি পড়ে প্রথমে খুব হাসলাম। তারপর অনেকক্ষণ খাতাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে। না জানা সব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বসে আছেন জীবন জুড়ে, কোথাও যেন শূন্যস্থান রাখেননি। মনে পড়ে গেল প্রশ্নপত্রে লেখা থাকত, “এর দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?”
এই মধ্য বয়সে এসে তাঁর সাথে বোঝাপড়ার কথা যেটুকু বুঝি, আজীবনের এক অপার বিস্ময় রেখে গেছেন ক্লাসরুমের বাইরে, যেখানে সবুজ মাঠে তখন রোদ-মেঘ-বৃষ্টি বা কুয়াশা… মনের জমিদারিতে এই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴