চিরসবুজ বনানী :চিলাপাতার জঙ্গল/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
চিরসবুজ বনানী :চিলাপাতার জঙ্গল
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
গাঢ় সবুজ, বেশ ঘোর কালচে সবুজ চিলাপাতায় অনেক চোখ যেমন আমাদের দেখে গেল, তেমনি আমরা দেখলাম ধুসর গন্ডারের দল। যারা প্রতিদিন দুপুরে লবন খেতে আসে এই বনাঞ্চলে। এই মন ভোলানো অপরুপ দৃশ্য দেখলেই মনে পড়ে যায় তাদের নিরিহ রূপ, তাদের অসহায়তার নানা কাহিনি। আসামের ব্রহ্মপুত্রের বন্যায়। এবারের বন্যাতেও একটা গন্ডার ভাসতে ভাসতে একটা চালাঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিল। তার ক্লান্ত অবসন্নতার চিত্র, চিত্রকরের তুলিতে উঠে এসেছিল, সামাজিক মাধ্যমে। জঙ্গলের নীরবতায় তার কাতর কন্ঠস্বর এখানেও শোনা যায়। এখানে ওখানে কুকুরের ডাক এটম বোমা ফাটায়। নীরবতা ভঙ্গ করে।
জেলা ভাগ হবার পর চিলাপাতা বনাঞ্চল এখন আলিপুরদুয়ার জেলায়। ডুয়ার্সের জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের কাছে এই গভীর বনের মধ্যে আছে হাতির করিডর। চারিদিকেই বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। আগে এখানে প্রচুর গন্ডারের আনাগোনা ছিল। দুর্গাপূজার আগে এখানে পরিবেশ থাকে অত্যন্ত মনোরম। কিন্তু বরষার জঙ্গলের যে ব্যাপারটাই আলাদা। শরৎ কালের পরিবেশ, যেমন বর্ষায় পাওয়া যাবে না, তেমনি বর্ষার দুপুরে শীতের বেগুন পোড়া পাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
মোট ২৩ টি প্রজাতির তৃণভোজী এবং মাংসাশী প্রাণী দের আবাসস্থল এই চিলাপাতা। জলদাপাড়া এবং চিলাপাতার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে তোর্সা নদী। নদী পেরিয়ে এপারের পশুপাখি যেমন ওপারে চলে যাচ্ছে, তেমনি কখনো ওপারের পশুপাখিও এপারে চলে আসছে। এই রাস্তায় কখনো পেখম মেলে থাকে ময়ুর। সেই শোভা দেখে ময়ুরীর দল। লায়লা মজনুদের সেই বিরল দৃশ্য দেখা সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। এখানে একটা ওয়াচ টাওয়ারও আছে। ময়ুরের নাচ দেখা অবশ্য এবার আমাদের ভাগ্যে ঘটে নি। এই বিরল চিরসবুজ এই বনানীতে ২২ টি প্রজাতির সরীসৃপের বিচরণ ভূমি। আছে ১৮০ টি প্রজাতির পাখি। তারা এখনো গাছের এডালে সেডালে মগডালে উড়ে বেড়ায়। এই চিলাপাতা বনাঞ্চলকে কোচ রাজাদের মৃগয়া ক্ষেত্রেও বলাহয়।
দিগন্ত জোড়া চা বাগানে আমরা উন্মুখ হয়ে আছি অজানা প্রাণীদের হঠাৎ আগমনের আশঙ্কায়। একটু ভালো করে অসহায় পাতাঝরা ছায়াগাছের ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় নীল আকাশ জুড়ে কোনো অজানা চিত্রকরের তুলিতে আঁকা উদাস চোখে চাওয়া গন্ডারের ছবি। মেন্দাবাড়ির জঙ্গলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভেসে আসে বুনো গন্ধ, অজানা সরীসৃপের আওয়াজ। ডুয়ার্সে যত জঙ্গল রয়েছে তার মধ্যে চিলাপাতাকে সবচেয়ে গভীর বন বললে একটুও ভুল বলা হবে না। খুব বেশি ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড় এখানে দেখা যায় না। তাই এখানে এক অদ্ভুত চিরশান্তি বিরাজ করে।
চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে মিঠি ঝোরা। পোষমানা হাতির পিঠে বসে অবসন্ন পথিক ধিরে ধিরে এগিয়ে চলেছে আপন গন্তব্যে। দূরে রাস্তায় এক গাড়িতে সেই গাড়ির চালক পাঁচ লিটার জলের ড্রাম ভর্তি করে তুলে নিল গাড়ির ডিকিতে। আমরা গাড়ি থামিয়ে জানতে পারলাম এই জলে মুখ ধুলে নাকি মুখ সুন্দর হয়। সেবক পাহাড়ের কাছে মংপং এর আগে অনেক গাড়ির চালক পাহাড়ি জলে স্নান করে। কেউ কেউ বিসলেরির বোতল থেকে মিনারেল ওয়াটার ফেলে দিয়ে, বোতলে ভরে নিয়ে যায় পাহাড়ি ঝর্ণার জল। নিজের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির আশায়। ছোটো বেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম দূর্গা পুজোর দশমী পুজোর সময় যে মালসার জলে দর্পন বিসর্জন হয়, সেই জলে হাত চুবিয়ে রাখলে নাকি মেয়েদের হাতের রান্না ভালো হয়। আজ আবারও কানে ভেসে এল মায়ের বলে যাওয়া কথা, "বিশ্বাসেই জগৎ চলছে, বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর মেলে।" আমরা গাড়ি থামিয়ে সবাই এক আঁচলা করে মিঠিঝোরার জল জল দুহাত দিয়ে চোখে - মুখে ছিটিয়ে নিলাম। এ যাত্রায় তখন আমাদের সবাইকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। সেবার সহজ উঠোন এর সাহিত্যের চড়ুইভাতিতে গিয়ে "মনের মানুষ" স্পট দেখিয়েছিলেন কবি অমিত কুমার দে। সাথে ছিলেন অরণ্যদেব বিমল দেবনাথ, কবি শিশির রায়নাথ। সেই "মনের মানুষ" সিনেমার টংঘর। যেখানে নদীর ধারে দুর্গম রাস্তায় সিঁড়ি বেয়ে টং ঘরে উঠে গেল কবি কৃষ্ণ দাস (বড়ো)। গভীর রাতে বিমল দা, শিশির দা, মনোজ, প্রশান্তদা একটা অজানা, অনামি সাঁকোর ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চখাচখির আর্তনাদ শুনেছিলাম। মনের মাঝে ভেসে উঠেছিল নানা কাহিনি । সেই কাহিনি শুনে বাচিক মীনাক্ষী ঘোষের চোখের পাতা ভিজে উঠেছিল। সে সব কাহিনি মনের আনাচে কানাচে ঘুরপাক খেতে থাকল।
জঙ্গলের আসল মজা হল এন্টিসিপেশন।ভুটান - বাংলাদেশের এই রাস্তার একটু ভেতরে গেলেই গ্রাসল্যান্ড। সেখানেই গন্ডারের বিচরণভূমি। সদাই এন্টিসিপেশন, এই বুঝি সামনে হাতি চলে এল। চিলাপাতা রিসর্টে আমরা "আকর" পত্রিকার উদ্বোধন করেছিলাম। সরীসৃপের আওয়াজে কবিতা পাঠের ফাঁকে চা দিতে আসা রিসর্ট কর্মীটির নাম "বুড়া ভাতা"র তালিকায় ওঠেনি। সেকথা জানাতে ভোলেনি নিসার ভাই। সেই রাতটা রিসর্টে থেকে আদিবাসী নৃত্য উপভোগ করে, পরদিন জঙ্গল সাফারি করে ফিরতে পারলে সে যাত্রায় ষোলো কলা পূর্ণ হতো একথা বলাই বাহুল্য। আজও ওই পথে যাওয়ার সময় নিসারের আকুতি মনে পড়ে। তার স্ত্রী হয়তো লক্ষীর ভান্ডার পাচ্ছে, কিন্তু তার "বুড়া ভাতা" সে পাচ্ছে কি না আজও জানা হল না। কিছুই করা হল না, নিসারের জন্য।
চিলাপাতার জঙ্গলে নল রাজার গড়ের রাস্তায় কতরকম পাখি তা গুনে শেষ করা যাবে না। চার থেকে পাঁচশো বছরের পুরনো এই দূর্গ এই নল রাজার গড়। কোচবিহারের বীর চিলা রায় এই দূর্গে মধ্যে থাকতেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতেন বলে কথিত আছে। এই দূর্গের রাস্তা বানানোর জন্য অনেক দামী বৃক্ষছেদন করা হয়েছিল। শোনা যায় এখানে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। গোপনে শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করাও এই দূর্গ তৈরির অন্যতম কারণ ছিল। এখানে একরের পর একর জমিতে স্বর্গছেঁড়া চায়ের বাগান। এই অপরুপ চা বাগানের পিছনে ছায়াগাছের সাথে একান্ত আপনজনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সার সার সুপুরির বাগান। আমরা কবি কৃষ্ণ দাসের (ছোটো) মাটির দাওয়ার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা গোটা পাঁচেক সুপুরির চারা নিয়ে এসেছিলাম। আকর পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক চক্রবর্তী, চিত্র পরিচালক সুশান্ত দাস, গাড়ির চালক সহ সবার ভাগে দুটো করে সুপুরি গাছের চারা নিয়ে এসেছিলাম স্করপিয়ন গাড়ির ডিকিতে করে। বাচিক শিল্পী প্রমীলা চক্রবর্তী একটু মজা করেই বলেছিলেন এই সুপুরি গাছে ফলন আসলে বাবুরহাটের মাটির দাওয়ার কথা মনে পড়বে। সত্যিই এখন সেই সুপুরি গাছে ফল ধরেছে। বাড়ি থেকে বের হবার মুখে সেই গাছের হলুদ সুপুরির ঝাঁক দেখে বাবুর হাটের কবি কৃষ্ণ দাসের (ছোটো) মাটির দাওয়া থেকে অস্তগামী সূর্যের হলুদ আভা আর মাতাল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া নাম না জানা দিকশূন্যপুরের যাত্রী পাখিদের কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴