চিন্তাহরণের চিন্তানাশ/দেবাশীষ বক্সী
চিন্তাহরণের চিন্তানাশ
দেবাশীষ বক্সী
পাঁচ পাঁচটি কন্যাসন্তানের জন্মের পর চিন্তাহরণ যখন পুত্র সন্তানের আশায় পুনরায় খান্তমণিকে অনুরোধ করেন, আপাত নিরীহ খান্তমণি তখন রান্নাঘরে ছোট কন্যা দুটির খাদ্যের যাতে টান না পড়ে সেই কারণে জ্বাল দেওয়া সাবু সেবনে ব্যস্ত ছিলেন। চিন্তাহরণের অনুরোধে খান্তমনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মুটে ঝাঁটা হাতে স্বামীর পিছনে দৌঁড় দেন। শোনা যায়, তারপর থেকেই নাকি চিন্তাহরণের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্যের তারতম্য ঘটে। একদা বলিয়ে কইয়ে চিন্তাহরণ এই ঘটনার পর হতে মানুষজনের কাছে বড় একটা ঘেষতে চান না। দিনের বেশিরভাগ সময়ে অবলা পশু পাখিদের সান্নিধ্যে থাকতেই বেশী পছন্দ করেন। এবং সদা সর্বদা আকাশের পানে ডান হস্ত তুলে কড় গুনে বিড়বিড় করে বোধহয় কোন কিছুর হিসেবে কষেন।
এদিকে মেয়েরাও বড় হয়েছে। বিয়ের বয়স হতে লেগেছে। এই চিন্তায় চিন্তাহরণের রাতের ঘুম উবে গিয়েছে। প্রত্যহ রাতে ব্যাগপত্তর খুলে জমা টাকা বিছানায় ঢেলে হিসেব কষেন। অংক আঁকেন, এক মেয়ের বিয়েতে এত খরচ হলে পাঁচ মেয়ের বিয়েতে কত খরচ হবে। খাতার পর খাতার পাতা নষ্ট করেন। অংক না মিললেই সদর দরজা খুলে গোয়াল ঘরে গিয়ে ধবলীর সাথে সুখ দ়ুঃখের কথা বলেন। এখন পর্যন্ত অংক না মেলায় প্রতিদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। প্রতি রাতে রাত জাগায় ধবলীও আজকাল বড্ড কম দুধ দেয়।
চিন্তাহরণের এই অদ্ভুত কর্মকান্ড রক্তস্বল্পতা রোগে অবষন্ন খান্তমণির প্রত্যহ চাক্ষুস করা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তিনি একদিন অতীব নিম্নশ্রেণীর শব্দ দ্বারা বাক্য গঠন করে স্বামীর উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করতে থাকেন। চিন্তাহরণ বিকারহীনভাবে তা গ্রহণও করছিলেন কিন্তু খান্তমণি যখন ত্যাজ্য স্বামী করার কথা উচ্চারণ করেন তখন তাঁর বুক খানা অভিমানে উদাস হয়ে পড়ে। বলহীন অলস শরীরটাকে টেনে টেনে পুকুর পাড়ে নিয়ে যান। ভাবলেশহীন নয়নে পুকুর পাড়ে বসে মাছেদের জলক্রীড়া দেখতে থাকেন। অদুরে গোয়ালঘর হতে বাসি গোবড়ের গন্ধ ও পুকুরের জলে পচা পাটের সুগন্ধে মাতাল হয়ে শরীর ও মন নির্বিকল্প সমাধির রূপ ধারন করে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চিন্তাহরণের চোখে ভেসে ওঠে - কোন এক তেপান্তরের মাঠে হাজার গরুর পাল নিয়ে মহানন্দে বাঁশিতে ফু দিচ্ছেন। সুন্দরী সখিগন তাঁকে আশ্লেষে জড়িয়ে মহানন্দে কৃষ্ণরূপে সোহাগ করছেন। বেশ চলছিল। হঠাৎ চিন্তাহরণের অতি অল্প বেঁচে থাকা চেতন মন, অনুভব করে কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন। প্রথমে ধীরে পরবর্তী কালে বেশ জোরে। পরিশেষে বীভৎস এক রাম চিমটি। স্বপ্নাতুর চোখে চিন্তাহরণ সামনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত অমায়িক হাসি মুখে এক বুড়োকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মটকা গরম হয়ে ওঠে। বুড়ো বেশ শান্ত গলায় বলেন—
বুড়ো: চিন্তাহরণ, কিসের তোমার এতো চিন্তা ?
চিন্তা: আঃ, দিলেন ত স্বপ্নের মায়াজাল ছিড়ে ?
বুড়ো: ওরে বোকা স্বপ্ন দেখে অলসে। আমি তোমায় জাগাতে এসেছি । সংসার কর্মে মন দাও, হরণ ।
চিন্তা: এখন আমি সংসারের কোন পোষ্টে নেই । আমি ত্যাজ্য । উপদেশ বন্ধ করুন ।
বুড়ো: খান্তমণি অনেক ধৈর্য্যশীলা। খুবই ভালো মেয়ে। তোমার পাঁচটি মেয়েও বড্ড সুশীলা। মায়ের গুণ পেয়েছে। খান্তমণি ভালো বলেই ত্যাজ্য হতে তোমার সময় লাগল।
চিন্তা: হু আর ইউ? বিরোধী দলের কোন সদস্যের সাথে কোন কথা নয়। গেট লস্ ।
বুড়ো: কথা নাই বললে, শুনতে আপত্তি আছে ?
চিন্তা: মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল, আপনি কে মশাই ?
বুড়ো: তোমার ত হুসই নেই, আমায় চিনবে কেমন করে? তবে অংকের স্যার হরগোপাল এবং ভূগোলের মাষ্টারমশাই ষষ্ঠীচরনকে নিশ্চই চেনো?
চিন্তা: হুম ।
বুড়ো: ওনাদের ছেলেদুটো চমৎকার। সোনার টুকরো। দুইজনেই সরকারি চাকরি করে।
চিন্তা: তাতে কি এসে গেল?
বুড়ো: শিক্ষিত পরিবার। মাষ্টারমশাইদ্বয় বড় সজ্জন ব্যক্তি। পাল্টি ঘর। তোমার বড় দুই মেয়ের সাথে ছেলে দুটোর ভাব ভালোবাসা রয়েছে।
চিন্তা: স্টপ। খবরদার। আমার মেয়েদের চরিত্র নিয়ে কথা? অশালীন বাক্য শুনতে না চাইলে কেটে পড়ুন।
বুড়ো: চুপ রহো কুলাঙ্গার। চরিত্রবান! অল্প বয়সে পাশের বাড়ির বুল্টির সাথে তোমার ফষ্টিনষ্টির কথা মনে নেই ? বুল্টির শরীর খানা ত লাঙল চালিয়ে ফালা ফালা করে তুলেছিলে, মনে পড়ে? খান্তমণিকে দিব বলে?
চিন্তা: না-মানে-ইয়ে-হল-কি ,আপনি কে মেসোমশাই? আপনার সৌম্য দর্শনরূপ ঈশ্বরতুল্য ।
বুড়ো: সাচ্চা প্রেম বড় পবিত্র। তাতে ঈশ্বরেরও সায় থাকে। মাস্টারদের পরিবারও তোর গুণবতী মেয়েদের পুত্রবধূ করতে আগ্রহী। বিকেল গাঢ় হল, যা বাড়ি যা। খান্তমণিকে একটু শান্তি দিস। আর শোন, হরগোপাল ও ষষ্ঠীচরণ এলে একটু আদর যত্ন করিস।
খান্তমণি সন্ধ্যাবেলায় ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতে এসে দেখেন, স্বামী দেওয়ালে টাঙ্গানো শ্বশুর মশাইয়ের ফটোর দিকে একমনে চেয়ে রয়েছেন। খান্তমনি প্রচন্ড রেগে বলেন, এতক্ষণে বাড়ীর কথা মনে পড়ল ?
চিন্তাহরণ বেশ ভাবুক হয়ে ফটোটার দিকে আঙুলি নির্দেশ করে বলেন, এটা কার ছবি? খুব চেনা চেনা লাগছে। সম্প্রতি কোথায় যেন দেখেছি। খান্তমণি আরও রেগে গলা চড়িয়ে বলেন, চমৎকার। এতটা অধঃপতন ।
খান্তমণি চমৎকার বলার সঙ্গে সঙ্গে অনবদ্য তাল ঠুকে হাততালি দেওয়ার গুনেই হোক অথবা চুড়ান্ত বিদ্রুপ মাখা বাক্যের শৈল্পিক গুণের কারণেই হোক, সহসা চিন্তাহরণের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের অসম ভারসাম্যে সমতা ফিরে আসে। কিছুক্ষণ অবাক নয়নে বাবার ফটোর দিকে চেয়ে থেকে ভেজা গলায় বলেন, এতদিনের বাশি ফুলের মালা কেন? কাল কমলা, অমলাকে বোল বেলি ফুলের মালা করে দিতে। কাল প্রত্যুষে স্নান সেরে বাবার পুজো দেব।
ঠিক এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। চিন্তাহরণ ও খান্তমণি দৌঁড়ে দরজা খুলে দেখেন সামনে হাসি মুখে হরগোপাল ও ষষ্ঠীচরণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতে দুই হাড়ি মিষ্টি ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴