চলে যাওয়া দিনগুলো/চিত্রা পাল
চলে যাওয়া দিনগুলো
চিত্রা পাল
-----------------------------
এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন বাইরে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ, ঘরের ভেতরেও তার আভাস। পাখার হাওয়াতেও সেই গরম, তবে একটু কম ।মোটা পর্দার আড়ালে আধ ছায়া ঘরে ভেসে আসে ফেলে আসা সময় এর ছবি। অতীতে পৌঁছে দিতে এই আলো আধাঁরি আবহের জুড়ি মেলা ভার।
এখন সেই ভ্রমণের দিনগুলো মনেপড়ছে, আমার দেশ থেকে বহু বহু দূর সেই দেশের কথা, সেই উত্তর গোলার্ধের নরওয়ে দেশের বার্গেন শহরের কথা। যেখানে খাঁড়ির ধারে আজও রয়েছে সারিবদ্ধ প্রাচীন বাড়ি। আমরা গিয়েছিলাম আগষ্টমাসে। ওখানকার অধিবাসীদের কাছে তখন মনোরম আবহাওয়া, আর আমাদের কাছে শীতকাল। রাতে ডিনার টেবিলে বসে আগামীকালের বেড়ানোর বিষয় শুনলাম। শুনলাম সেই অসাধারণ ট্রিপ হবে আগামীকাল।আমরা কল্পলোকের মায়াজালে জড়িয়ে নিলাম নিজেদের।
ওয়েকিং বেল শুনেই তড়াক লাফ দিয়ে বিছানা ত্যাগ করে চটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমরা ট্রেনে করে ঘুরে বেড়াবো সেই স্বপ্নলোকে।টুরিষ্ট কোচে করে আমরা এলাম ভস (Voss) রেলস্টেশনে। এখানে একটু বলে রাখি নরওয়ে রাজ্যের এই ভস শহর বোতলজাত জলের জন্য বিখ্যাত। ভস রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো ঠিক সকাল দশটায়। পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলেছি। একেবারে পাশে নীচ দিয়ে চলেছে রাস্তা সাইকেলারোহীদের জন্য। পথের ধারে ছোট ছোট কাঠের বাড়ী।সামনে পাহাড়ের গায়ে লেপটে আছে মেঘ সাবানের ফেনার মতো। এ পথের সৌন্দর্য অসাধারণ। দূরে পর্বতরাজি, গায়ে হিমানীসম্প্রপাত। নীচের সমুদ্রখাঁড়ি থেকে মেঘেরা দল বেঁধে উঠছে পাহাড়ের গায়ে,উঠতে উঠতে এ ওর গায়ে মিশে যাচ্ছে হাসতে হাসতে মিলে যাওয়া সখীদের মতো। ট্রেনে আমরা যাচ্ছি ভস (Voss) থেকে মিরডাল (Myrdal) মিরডাল নরওয়ে রাজ্যের অন্যতম পাহাড়ি রেলওয়ে জংশন স্টেশন। এখান থেকে অন্য ট্রেনে যাব ফ্লা। এ এক আশ্চর্য বনপথে গমন। দু নয়ন ভরে শুধু দেখার শুধু দেখার। যাবার পথে এক ঝর্ণার ধারে ক্ষণিক বিরতি দিলো ট্রেন ওই ঝর্ণা দেখার জন্য। আমরা ট্রেন থেকে ঝুলতে ঝুলতে নেমে লোহার পাটাতন দেওয়া রেলিং দিয়ে ঘেরা (যেটা শুধুমাত্র এই ঝর্ণা দেখার জন্যই করা) স্পটে দেখলাম ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণাকে।নানাভাবে ঝর্ণা লেন্স বন্দী হলে আবার সবাই এর ট্রেনে উঠে পড়া। ট্রেন চলছে তার আপন আনন্দে, আপন ছন্দে। এজন্যেই সাধারণে এ জার্নির নাম দিয়েছে beautiful Train journey।
এসে গেলাম ফ্লা। একেবারে ফিয়র্ডের ধারে এই ফ্লা। ফ্লা তে এসে উঠে পড়লাম লঞ্চে ফিয়র্ড ঘুরে বেড়াবো বলে। লঞ্চেই হলো চা খাওয়া, ফ্লা থেকে অনেকে ওখানকার বিখ্যাত বেকারির কিছু নমুনা নিয়ে এসেছিলো সেইসব সহযোগে। ফিয়র্ড থেকে চারপাশের সৌন্দর্য একেবারে মনোমুগ্ধকর। এবার আমরা চলেছি বাসে হ্যামার। বাস চলেছে মসৃণ গতিতে,সামনে পথ খুলে যাচ্ছে কাল ফিতের মতো। পথের পাশে ফ্রকের ঝালরের মত আঁকাবাঁকা ফিয়র্ড। তার ওপারে তুষারমাখা পর্বতশ্রেণী, যেন ওড়নার ঘোমটায় ঢাকা এক লাবণ্যময়ী তার অপার সরলতা নিয়ে চেয়ে আছে কোন সুদূরে।সবুজ বনপথে যেতে যেতে এক বাঁকে এসে বিরতি পাওয়া গেল খানিক। সেখানে ছোট স্রোতস্বিনী , তার ওপরে একখানা সরু ব্রীজ।ব্রীজের ওপর থেকে দেখলাম একজন নদীর জলে ছিপ ফেলে বসে আছে মাছের আশায়। তীরে অনাবিল পরিচ্ছন্ন সবুজ। নদীতীরে দুদিকে দুটো কাঠের বেঞ্চ আর মাঝখানে টেবিল এমন দু চারটে সেট রাখা। যে কেউ ইচ্ছে করলে বসে থাকতে পারে এ বিহ্বল নির্জনতায়। সৌন্দর্য উপভোগের এমন ব্যবস্থা বোধ হয় এদেশেই সম্ভব।
আসলে কোনও দেশ তার পরিবেশ তার প্রকৃতি নিয়েই সে নিজের মত। তার সমস্ত আয়োজনের মধ্যে গিয়ে না দাঁড়ালে,ছবি দেখে তাকে বোঝা যায় না ভেতর থেকে। নিজের দেশ থেকে বহু দূরে ওই ছোট্ট স্রোতস্বিনীর ধারে অফুরাণ সবুজের মাঝে ওই বিরলতায় নিশ্চিন্তে বসে থাকার আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আজ আবার সেই সবুজ বনভূমি দেখতে পাচ্ছি, এই ঘোর ঘোর গ্রীষ্মে সেই ভাবনাতেও কি আরাম।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴