ঘূণ/সুদীপা দেব
ঘূণ
সুদীপা দেব
বেশ কয়েকদিন ধরে দেবাশীষ তনুশ্রীর মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করছে। দৈনন্দিন কাজকর্মগুলো গুছিয়ে ঠিক সময় মতোই করে নিচ্ছে। তবু যেন ওর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত চঞ্চলতাটুকু হারিয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকালে বেশ বোঝা যায় কিছু একটা সমস্যায় ও তোলপাড় হচ্ছে। মনের ছাপ চোখ দুটোতে স্পষ্ট। দেবাশীষ ভাবছে জিজ্ঞেস করবে কিন্তু নিজের ব্যস্ততা আর সঠিক সময়ের সুযোগটুকু হয়ে উঠছে না। কুড়ি বছর ধরে ওর সাথে ঘর করছে। সে জানে যখন তখন জিজ্ঞেস করলে তনুশ্রী কিছু হয়নি বলে এড়িয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের সামনে বেশি জোড়াজুড়ি করলে প্রচন্ড বিরক্তিসহ অপ্রাসঙ্গিক কিছু একটা উত্তর দেবে।
অফিস যাবার সময় খাবার টেবিলে বসে তনুশ্রীকে জিজ্ঞেস করে
―তোমার শরীর ঠিক আছে?
প্রত্যাশিত মতোই উত্তর এলো।
―তাহলে? মন খারাপ না অন্য কিছু?
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে
―অনেকদিন কোথাও যাইনি, এই উইকেন্ডে বেরোবে?
একটু বিরক্তি নিয়ে তনুশ্রী বলে
―যখন যা মনে হয় বলে বসো। ছেলে ক্লাস টুয়েলভ মেয়ে ক্লাস নাইন, সে খেয়াল আছে তোমার! তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যাও আমি পারবো না।
―একঘেয়ে পড়ার মাঝে ওদেরও রিলাক্সেশন দরকার। ভাবো। ফিরে এসে কথা হবে।
তনুশ্রী কোন উত্তর দেয় না।
দেবাশীষ এটাও খেয়াল করেছে তনুশ্রী মোবাইল হাতে একটু বেশি সময় নিচ্ছে। কখনো টাইপ করছে, কখনো হেডফোন গুঁজে নিয়ে কিছু দেখছে। ফেসবুকে অদ্ভুত সব পোস্ট শেয়ার করছে প্রায় রোজই। বেশিরভাগ সময় ঠাকুর, দেব-দেবতার ছবি। কোন কোন ছবির নিচে লেখা 'এড়িয়ে যাবি না। দশজনকে শেয়ার কর তাহলে এক ঘন্টার মধ্যেই সুখবর পাবি।'
দেবাশীষ বুঝতে পারছে না তনুশ্রী এসব কি করছে! ঠিক কি ভাবছে বা চাইছে ও! এ নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে অশোভন মনে হয়েছে। কিভাবে প্রসঙ্গ তুলবে তাই ভাবছে।
তবে ছেলে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তনুশ্রীর কথা
―আমার ইচ্ছে হয়েছে করেছি। ক্ষতি তো কিছু নেই।
―মা, এসব বোকা বোকা পোস্ট তুমি আর করবে না।
― ঠাকুর দেবতা নিয়ে ওসব বলিস না বাবা। মায়ের যে কি চিন্তা তা তুই বুঝবি না! দুদিন বাদে আমাদের ছেড়ে তোকে বাইরে চলে যেতে হবে...…
ঠাকুর....
বিড়বিড় করে কি যে বললো শেষটুকু আর কানে গেল না। তনুশ্রী গলার স্বর এবং চোখ ভিজে উঠেছে। ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে
―আমার পাগলী মা তুমি বেশি চিন্তা করো না তো!
আজও রাতে বিছানায় শুয়ে তনুশ্রী হেডফোন কানে লাগিয়ে ফেসবুকে নিউজ পোর্টাল চালিয়ে রেখেছে। ওর চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে। দেবাশীষের বড্ড ঘুম পেয়ে গেছে। তনুশ্রীর ঐ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে কি হলো কাঁদছো কেন?
আলতো করে তনুশ্রীর থুতনি ছুঁয়ে বলে
―রাজা হরিশচন্দ্র শৈব্যা নাকি বাবা তারক নাথ? কি দেখলে?
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে উত্তর দেয়
আমি বাবুকে কিছুতেই বাইরে পড়তে যেতে দিতে পারব না। যে কোন সাবজেক্ট হোক, তুমি ওকে এখানেই কলেজে ভর্তি করবে বলো, প্লিজ।
দেবাশীষ এবার সব বুঝতে পারে। পোকাধরা সমাজের চিত্রপট ওর সামনে পরিষ্কার ভেসে ওঠে। কোথায় এর সমাপ্তি তা জানা নেই কারো। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস দেবাশীষের বুক ফেটে বেরিয়ে আসে মাটির দিকে। কাঁদতে ইচ্ছা করে তারও।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴