আমার প্রিয়
ছন্দবীথি ভোর,
গতকাল শেষরাত থেকে জেগে আছি। ঘুমোতে ভয় হয়, পাছে হঠাৎ কোকিলের সেই একমুহূর্তের মধুমাখা বোল শুনতে না পাই! ক্ষণিকের অন্যমনে আর হারাতে চাইনা কিছু। তুমি জানো, আমের মুকুলের গন্ধে এ'সময় জুড়ে পুরো ক্যাম্পাসটা কেমন ম - ম করে? বিকেলের দিকে কোনো কোনো দিন কাজে একদম মন বসে না। কী-প্যাডের হলদে - গোলাপী আলো বুকে, কোণে পড়ে থাকে, একলা ল্যাপটপ। পড়ন্ত - বেলায় ছুটে বেড়াই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রং তুলি তো ছুঁয়ে দেখতে পারি না, তাই আপনি বুকে ক'রে রাখি হারানো ছবিমাখা ইজেলের শৈশব। তোমায় খানিক শোনাই সে ছবিকথা -----
"কিশোরী বেলার গাছের পাতায় ফুল ফুটত
ঝির্ - ঝির্ - ঝির্ ঝরণা হয়ে সুর ছুটত,
ছোট্ট পায়ে দৌড়ে পথে শুনত বাঁশি,
বকুল ফুলের মালার সাজে খুশির হাসি।
ঝিলিক দেওয়া বুকের ভেতর সজীব ব্যথা
হাওয়ায় হাওয়ায় গান শুনিয়ে বাজত কথা
পাহাড়প্রমাণ ঝড়ের ভেতর আগুন রেখা
অনেক ভিড়েও একলা কথন ছবি - লেখা।
দল বেঁধে ঠিক পৌঁছে যাব বকুল তলে
সাঁঝবেলাতে ফুটবে মালা বৃষ্টিজলে।
আকাশ ঘিরে মেঘের ভেলায় ঝড়ের কাঁপন
বুকের ভেতর ঝরণা রঙে তুলবে মাতন
কান্না তখন বাঁধনছাড়া আঁধার রাতে
একক আলোর ঝলকানিতে বনের পথে
মায়ার ভেতর এগিয়ে চলে দিনের বাণী
ঘুমহারা ভোর, আগুন রাতের অশ্রুখনি।"
বৃষ্টি ঝরে দু'চোখে বছরভর। কভার ফোটোর সবুজ আভায় আজও পাশাপাশি বসে থাকে, লাজুক দু'টি নরম ওম। চশমা চোখে উজ্জ্বল - উচ্ছ্বল খুশীর হাসিতে মাখামাখি। সেই যে কবে একছুটে এলে আমার কাছে, তিরতিরিয়ে, ঝরণা হয়ে, বোগেইনভিলিয়া - গোলাপী মেখে, আঁকাবাঁকা পথ ধরে, ঠিক যেন বনহরিণীর ছন্দে, মাতন জাগানো নদী। শঙ্খ - সাদা স্বপ্ন চোখে মুক্ত ঝরানো সুর ভরা কল্লোল, সত্যিই স্রোতস্বিনী। শুকনো পাতায় পাতায় শিমূল - পলাশ - কাঞ্চন বুকে, আজও বেজে যায় প্রতিধ্বনি। সে সুর শুনেছে জ্যোৎস্নামাখা কাশবন, শুনেছে তিস্তা। অনুভবে বেজেছে বাদামী রাজবাড়ীর ভাঙা দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে উঁকি দেওয়া, চিরদিনের চিরকালের একইভাবে "মাথায় লয়ে জট", অটুট, ঋজু বটগাছটার শেকড় থেকে শেকড়ে। ঘনমেঘ লিখেছিল কত না গভীর বাণী। ফাগুনের আবীর - গোলাপীর শুভ্র - কথন মিশে যায় চৈত্রের ঝরে যাওয়া কাগজ ফুলের গোলাপী ঘ্রাণে। ল্যাবরেটরীর একলা ল্যাপটপের বুকে আঁকে গোলাপী আভার ক্ষত।
এখনও বড় বড় কাচের ওপর রঙবেরঙের ছবি আঁক? নাকি নিত্যদিনের নতুন নতুন যন্ত্রের কারসাজিতে কিংবা কলকবজার ভীড়ে, গ্লাস পেইন্টিং এখন আর তেমন টানে না তোমায়? ডার্ক - চকোলেটের খালি বাক্সটা আজও যত্নে থাকে আমার সবুজ ঘরের বুক শেলফে। আদর - ধরণে এত দীর্ঘ বিবর্তনের ছাপ, আগে এ'ভাবে কখনও লক্ষ্যই করিনি। নীল শাড়িতে সেদিন কী যে মায়াবী লাগছিল তোমায়! কি উজ্জ্বল! যেন কোন্ সাগরপাড়ের হাওয়া এসে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে চিরাচরিত সৌন্দর্য্যের সব প্রতীকি অলিগলি, ভাবালুতার সবটুকু আনাচকানাচ। শ্বেতচন্দন রঙের বেড়ালছানা দুটো এখন শুধুই মুঠোফোনে। হারা উদ্দেশ্যে।
স্বপ্ন দেখি, কখনও বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে খেলা করবে বুকের ভেতর। নিজেদের টুকরো আশ্রয়ে, ভরিয়ে তুলবে পড়ার ঘর, বিছানা, বালিশ। এখনও কত রং খুঁজে পাই; কালো, হলদে, সাদা ........ তবু সেই শ্বেতচন্দন গন্ধ - রঙ আর ফেরে না। সব গল্প - কথারা ফুরিয়ে যায়, মুছে যায় রাজবাড়ীর ছবি, ছিঁড়ে যায় বটের ঝুড়ি, হলদে বাড়ী থেকে খসে যায় পলেস্তারা, ধুয়ে যায় লালমন্দির, শুকিয়ে যায় অদেখা অশ্রু, ভিজে যায় লেখার খাতা; লাল - নীল - সবুজ কাচের ঘরে ধূসর মেশামেশি স্মৃতির ভার। কভার দেওয়ালের সবুজ আভা চিরে একদিন এই ভারও মিলিয়ে যাবে গদ্য - অধঃক্ষেপে। কাগজের নৌকো কেটে সময় - দলিল লিখবে তোমায়, এক নতুন আরম্ভ ----------
"পুড়তে পুড়তে সোনা হয়ে ওঠো মন
দৃপ্ত ফুলে মালা গেঁথে কুহু গায়
ছেঁড়া ছেঁড়া ভোরের একলা কোকিল,
ঘুম ভাঙা ভোর নিস্তেজ নিঃসাড়
তার চেয়ে বরং রাতজাগা ভোরে
মনের দরজা খুলে যায় অবলীলায়
হাত বাড়ালেই দোকানঘর
একের পর এক ব্যথা মনের মলম
জোগান শেষে চিহ্ন আঁকি
কাটাকুটি কাগজের নৌকোয়
মৃত্যুঘরের উড়োজাহাজ অপেক্ষায়
ভালোবাসাবাসি হুড়মুড়িয়ে হানা দেবে
বহুক্রোশের দ্বীপান্তরে।"
ভালো থেকো বকুল ফুল।
ভালো রেখো জুঁই - বনবীথি গন্ধ।
ইতি
তোমার কাগজফুল - সই