গল্প হলেও সত্যি/অমিতাভ দাস
গল্প হলেও সত্যি
অমিতাভ দাস
সময় যেখানে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। গাছ-গাছালীর ডালপালা ছড়িয়ে থাকে, পাখিদের কিচির মিচির আর কখন কখনও সেখানে একরকম নির্জনতা। অদ্ভুত প্রশান্তি।তোজোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ধীমান ব্যাক্তিগত সুখ দুঃখগুলোকে বিসর্জন দিয়ে এক বন্ধুর বাগান বাড়িতে। অবশ্য বন্ধু এখন সেখানে থাকেন না। বন্ধু বার বার বলেছে তাকে বাগান বাড়ি যেতে। যখনই তার মন খারাপ লাগবে সে যেন চলে আসে। সে আসলেই বন্ধু বলেছে সেও আসবে দু চার দিন এখানে থাকবে। কিন্ত অনেক চেষ্টা করেও বন্ধু শেষ পর্যন্ত আসতে পারল না বিশেষ কাজে আটকে পড়বার জন্য। তার জন্য অনেক ক্ষমা ও সে চেয়ে নিয়েছে। তবে এসে যখন পড়েছে মনে হলো ভুল করেনি। এখানে মায়ের মন্দির রয়েছে। আর ধীমান তো মায়ের টানেই এখানে এসেছে। মা খুব জাগ্রত। গোটা বাগান বাড়ি একা পাহারা দেন। বাগানবাড়িতে ঢুকে ধীমান উপলব্ধি করেছে তা। মন্দিরের আসপাশ ছমছম।ধীমান তোজো কে সঙ্গে করে এনেছে। বাগান বাড়িতে এক বয়স্ক পুরোহিত থাকেন। তিনি বাগানবাড়ির গাছ-গাছালির যত্ন করেন। মায়ের মন্দিরে নিত্য পুজো দেন। মাটির ঘর লেপে মুছে রাখেন।ধীমানের বন্ধু সময় করে কিছু টাকা পাঠায়, তাছাড়া উনি ব্রাহ্মণ মানুষ। চন্ডীপাঠ, যজ্ঞ, পুজো করে যা কিছু পান সব মায়ের সেবায় লাগিয়ে দেন। তবে এখানে মায়ের ভক্ত সংখ্যা কম। হয়তো অনেকে জানে না বা প্রচার হয়নি। মা দক্ষিনাকালিকা। সর্বজান্তা, মমতাময়ী। মায়ের মুখ দেখলে সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়। মায়ের মন্দিরে বসলে শান্তি পাওয়া যায়। আত্মা শুদ্ধ হয়ে যায়। এখানে মায়ের একচালা মাটির মন্দির। সাধারণ মায়ের বেশভূষা। সাদা লালপাড়ের শাড়ি। গলায় রুপোর হার। রুপোর টিকলি। রুপোর চুড়ি। শাখা পলা। কপালে সিঁদুর। ধীমান কতবার স্বপ্নে মাকে এই রূপে দেখেছে। মা তার অনেক পরিচিত। রাতে শোবার আগে দুর্গার অষ্টোত্তর শতনাম পাঠ করা তার বহু বছরের প্রতিদিনের অভ্যাস।ধীমানের ঘরে আসবাব বলতে একটি শিশু কাঠের চৌকি আর একটি কাঠের টেবিল। চৌকি তে তোষক পাতা, তার উপরে বিছানার চাদর আর দুটি বালিশ। বালিশের পাশে ভাঁজ করা ধুতি পাঞ্জাবী। ঠাকুরের বই, পঞ্জিকা, শ্যামা সংগীত এর গানের খাতা।ধীমান বরাবরই নিরামিষ আহার করেন। সাত্বিক জীবন যাপন করেন। খুব সাধারণ ভাবে জীবন কাটান, অনাড়ম্বর। সব কিছুতেই বৈরাগ্য। গলায় রুদ্রাক্ষর মালা। তবুও কিছুতেই তার মনে শান্তি নেই। এক অশান্তি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে। তাই অশান্ত মনে মাকে স্মরণ করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।আর স্বপ্নে মায়ের দর্শন। মায়ের দর্শন পেতেই মাকে জিজ্ঞেস করল 'মা '। মাগো...তোজো কে যে বড্ড বেশি ভালোবাসি। ও যে আমার প্রাণ। আমার সাধ্য নেই। তুমিই ফিরিয়ে আনো মা। তুমিই পারো। তুমি সর্বজান্তা। আমার কষ্ট তোমার অজানা নয়। একমাত্র তাকে নিয়ে তো বেঁচে আছি। আর কত অপেক্ষা করবো মা। কত পরীক্ষা দেব। মা ধীমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন এতো কষ্ট পাচ্ছিস?মা তোজো যে আমার অপেক্ষায় আছে। আমি যাবো মা , তাকে নিয়ে আসবো আমার কাছে।সেদিন ধীমান খুব কেঁদেছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়েছে। বিপত্নীক ধীমান। বউ এর মৃত্যু তে চোখ দিয়ে জল পড়েনি তার। একমাত্র অবাধ্য মেয়ে যখন বাবার অমতে একটা বাজে গুন্ডা ছেলে কে বিয়ে করল সেদিন ও না।বিয়ের চারমাস যেতে না যেতে সে মেয়ে আবার শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বাচ্ছা পেটে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়িতে। মা মরা মেয়েকে ক্ষমা করে দেন বাবা। জন্ম হয় তোজোর। অবাধ্য মেয়ের একটুও পরিবর্তন হয়নি।সে শুধু জন্ম দিল তোজোকে।তোজো কে নিজের হাতে যত্ন করে বড় করে তোলেন ধীমান।কত রাত ঘুমায় নি, অসুখে যত্ন করেছে, নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়েছে, গায়েত্রী মন্ত্র, সূর্য স্নান,যোগাসন, লেখা পড়া,গান, ছবি আঁকা সব একা শিখিয়েছে। তোজো খুব ভালো ছেলে হয়েছে। মা -বাবার বিপরীত। মেয়েকে যা করতে পারেনি তা তোজোর মধ্যে পূরণ করতে চায় ধীমান। তোজোর যখন চার বছর পাঁচ মাস ঠিক তখনই আবার সে মেয়ে ফিরে যায় তার স্বামীর ঘরে। অপরাধী করেন বাবাকে। শ্বশুরবাড়িতে বাবাকে দোষারোপ করে বলে বাবা বারবার সংসার ভেঙেছে, কুমন্ত্রনা দিয়েছে। আর তারপর থেকে তার গুন্ডা, বদমাস নেতা স্বামী তাকে এই বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছে। তবুও অনেক অপমান সয়ে গিয়েছিলো দুবার। দুবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন জামাই। মেয়ে প্রতিবাদ করেনি। তোজোকে চোখের দেখা ও দেখায় নি ওরা। পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন, উকিল ধরেছেন। কিছুই হলোনা। বড়োবাবু বললেন মেয়েসুখে সংসার করছে করুক না। মেয়ে সংসারী হয়েছে। এতে আপনি খুশি হবেন। আর তা না হয়ে... যান তো মশাই। রোজ রোজ বিরক্ত করবেন নাতো।কিন্তু তিনি তো জানেন তোজো ভালো নেই। কি করে ভালো থাকবে তোজো। আধো আধো বুলিতে দাদান দাদান বললেই প্রাণ জুড়িয়ে যেত। ছোট ছোট হাত, পা।সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ছোটাছুটি করে। বাড়ি টি কখন জানি স্বর্গ হয়ে গেছিল।গোপালের মত মুখ। তার শোবার ঘরে যে গোপালের ছবি আছে আর তোজোর ছবি হুবুহু এক।কাকে বোঝাবে তার কষ্ট, যন্ত্রনা। বড় কথা এখানে তোজো কত অসহায়। ও শিশু। ওর সাধ্যি কত টুকু। হায় ভগবান। কি পাপ করেছি যার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছি। তোজো কি পাপ করেছে, ওকে কেন কষ্ট দিচ্ছ প্রভু। আমি তো নিজের মেয়েকে চিনি, জানি। ও তোজোর কোনো যত্ন করবে না। নিজের স্বার্থের জন্য সন্তান কে কষ্ট দেয় সে মা না। মায়ে রা এমন হয় না।এমন মা-বাবার ঘরে এমন নিষ্পাপ গোপাল কেন দিলে ঠাকুর? কি দোষ তার, কি অপরাধ? তোজো ছাড়া তার জীবন অর্থহীন, মূল্যহীন।
ধীমানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে...। ধীমান বাগান বাড়িতে একা এসেছে। তোজোর স্মৃতি নিয়ে। সে মনে করে তোজো তার সাথে আছে, তার সাথে চলছে। সে মন্দিরে বসলে তোজো বসে। তোজো মাকে ফুল দেয়, চন্দন বেটে দেয়। সে তোজো কে আদর করে, স্নেহ চুম্বন এঁকে দেয় কপালে। তোজো ধীমানের হাত ধরে থাকে।তার এই স্বভাবে পুরোহিত মশাই বললেন আপনি শান্ত হন। স্থির থাকুন। দেখুন সূর্য ডুবছে। এর পর সন্ধ্যা বাতি দিবো মায়ের মন্দিরে। আরতি হবে।
ধীমান -সূর্য ডুবুক।
বৃদ্ধ পুরোহিত বললেন, ঠান্ডা লাগবে আপনার।
ধীমান -লাগলে লাগুক।
বৃদ্ধ পুরোহিত মশাই আবার বললেন, শরীর খারাপ হলে চলবে?
অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে ধীমান বললেন,-"আচ্ছা সব কি সত্যি যায়? না ফুরিয়ে যাওয়া ভালো!?
পুরোহিত মশাই সে কথার উত্তর না দিয়ে হাসলেন।
তারপর বললেন 'জয় মা কালী '। সবার কল্যাণ করো মা। ধীমান বিড়বিড় করে বললেন, মা সবাই কে ভালো রেখো, সুস্থ রেখো, তোজো কে দীর্ঘায়ু দিও মা। মানুষের মত মানুষ করো। তাকে মন্দ কিছু যেন না ছোঁয়। সর্বদা তোমার আশীর্বাদ তোমার কৃপাদৃষ্টি যেন থাকে। সবার মঙ্গল করো। তারপর বললেন - "সর্বমঙ্গল মঙ্গলে শিবের সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়নি নমস্তুতে... "। পুরোহিত মশাই প্রদীপ জ্বালালেন। ধুনো দিলেন। সারা বাগান বাড়ি ধুনোর গন্ধে ছেয়ে গেল। একটু পরেই চন্ডীপাঠ করবেন পুরোহিত মশাই।
মা..মা..মা... চমৎকার। এসো ধীমান। মন্দিরে এসো। মা তোমায় আশীর্বাদ দিয়েছেন। দেখো ঘটের থেকে জবা ফুল নিজের থেকে পড়ে গেল। এটা মায়ের আশীর্বাদ। বিশ্বাস রেখো। আস্থা রেখো মায়ের প্রতি। তোমার মনোকামনা পূরণ হবে বাবা।ধীমানের অশ্রু সজল নয়ন। স্থির দৃষ্টি। মলিন বস্ত্র। সুখনো মুখ। ধীমানের পাশে তোজো (ধীমানের ভাবনা )।তার স্পর্শ তার সুগন্ধ। মন্দিরে ধুনোর সুগন্ধ,মায়ের উজ্জ্বল মুখ সব কিছু মিলে মিশে একাকার। ধীমান অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
স্বপ্নের মধ্যে ধীমান এক বনপথ পেরোয়। বনপাহাড় তোজো আর ধীমানের পথ রুদ্ধ করে। তবুও সে অনেক কষ্টে পাহাড়ের সিঁড়ি টপকে চূড়ায় পৌছায়। সেখানে মেঘের দেশে মায়ের মন্দির। সেখান থেকেই স্বর্গ ছোঁয়া যায়।তোজো ধীমানের হাত ধরে টানে......... দাদান দাদান.... উঠো দাদান।।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴