গরু ও গণতন্ত্র /রণজিৎ কুমার মিত্র
গরু ও গণতন্ত্র
('কমলাকান্ত'র অক্ষম অনুকরণ)
রণজিৎ কুমার মিত্র
প্রসন্ন গয়লানী গরু হারিয়ে বড় অসুবিধের মধ্যে আছে। এখনো পর্যন্ত সে কোন সরকারি অনুদান পায়নি, ওই গরুর দুধ-ঘি-দই বেচেই তার সংসার চলে,খাওয়া-পরা জোটে। তাদের বাতাবাড়ি গ্রামের অনেকেরই নাকি গরু হারিয়ে যাচ্ছে। গাঁয়ের লোকেরা বলাবলি করে, ইদানিং নাকি গরু চোরের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। গরু চোরদের নিয়ে নাকি রোজ খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে, টিভিতে তক্কাতক্কি হচ্ছে। প্রসন্ন গয়লানী খবরের কাগজ পড়তে পারে না, তার ঘরে ও টিভি নেই। এ বারও তাদের গাঁয়ের বাবু কমলাকান্ত চক্রবর্তী ভোটে জিতে অঞ্চল প্রধান হয়েছেন। কমলাকান্ত ছিল প্রসন্ন অনেক দিনের বাঁধা কাস্টমার। দু চারজন কাস্টমার বাতাবাড়ি তে আরো ছিল ,কিন্তু কমলাকান্ত প্রসন্নকে বিশেষ খাতির করত, সে দুধে জল মেশায় না বলে। কমলাকান্ত প্রসন্নকে কবুল করিয়ে নিয়েছিল তাকে দেয়া দুধে সে কখনো জল মেশাবে না। প্রসন্ন সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের আগে কমলাকান্ত প্রসন্নকে আড়ালে ডেকে নিয়ে নগদ করকরে ৫০০ টাকা, তিন কেজি চাল , আর একখানা শাড়ি দিয়ে বললে "তোর আর কষ্ট করে ভোট দিতে যেতে হবে না রে প্রসন্ন। তোর ভোট আমার লোক দিয়ে দেবে।" প্রসন্ন মনে মনে একটু কষ্টই পেয়েছিল ইদানীং কমলাকান্তকে প্রসন্ন গয়লানীর বিশেষ পছন্দ হচ্ছিল না। 'ধেনুরত্ন' উপাধি পাবার পর কমলাকান্তর রকম-সকম বদলে গেছে। তিন তলা বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে। হাইওয়ের পাশে হোটেল হয়েছে। কমলাকান্তের বউ এখন আর প্রসন্নর সঙ্গে কথা বলে না, দুধ দিতে গেলে, ওদের ঝি-চাকররা বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেয় না। দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে দুধ নেয়। কমলাকান্তকে এখন সব দুধ দিতে হয়। প্রসন্ন র গাই কবে বিয়োবে? গেরামের কার গরু, কত লিটার দুধ দেয়? কার ঘরে কটা বকনা বাছুর! এঁড়ে-বাছুর! সব কমলাকান্তর নখদর্পণে। কমলাকান্তর খাঁটি দুধ-ঘি- দই খাওয়া অভ্যেস অনেক দিনের। তার পরিবারের লোকজনদেরও এখন নাকি খাঁটি দুধ-ঘি-দই -ছাড়া আর চলে না। তাই গ্রামের সব দুধেল গাই এখন কমলাকান্ত আর তার দলবলদের দখলে। ভোটে কমলাকান্তের প্রতিদ্বন্দ্বী মুচিরাম গুড়, ভীষ্মলোচন খাসনবীস প্রসন্নকে আড়ালে ডেকে বলেছিল "খুব সাবধানে থাকিস প্রসন্ন। তাদের এই গণতান্ত্রিক গেরামে খুব গরু চুরি হচ্ছে, ভোট চুরি হচ্ছে। তুই যদি এবার আমাকে এবার ভোট দিস, তোকে বিধবা ভাতা দিব, ১০০দিনের কাজের আটকে থাকা টাকার ব্যবস্থা কইরে দিব, তোর গরুর বীমা কইরে দিব, তুই শুধু সাহস করে কমলাকান্তকে ভোট না দিয়া, আমাকে দে।" মুচিরামের সাথে প্রসন্নর কথা বলার খবর কমলাকান্তের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সেই থেকে প্রসন্নর উপর বেজায় চটে আছে কমলাকান্ত। গয়লানীকে সোজা করতে হবে।
গরু হারানোর শোকে প্রসন্নর যখন পাগল- পাগল অবস্থা, তখন মুচিরাম গুড়ের ছেলেরা প্রসন্নকে ক্ষেপিয়ে তুলে বলল, "কমলাকান্তের সালিশি দপ্তরে গিয়ে নালিশ করো, তার ছেলেরা তোমার গরু চুরি করেছে।" প্রসন্ন দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে কমলাকান্তের কাছে গরু চুরির অভিযোগ করলো। কমলাকান্ত প্রসন্ন খাঁটি দুধের সাথে আফিম খেয়ে মৌতাত করছিল ,বেশ ঢুলুঢুলু অবস্থা তখন। এতদিনকার চেনা প্রসন্ন কে জিজ্ঞাসা করে বসলো, "তুই কে রে?"
প্রসন্ন রেগে বলল, "আমার দুধ, দই চেনো আর আমাকে চিনতে পারছ না?" কমলাকান্ত বলল, "ও গরু কি তোর? এ গাঁয়ের সব গরু এখন আমার।" প্রসন্ন ভুলে যায় কমলাকান্ত এখন আর গায়ের সেই আদি 'নিষ্কর্মা' অবতার নয়। সে এখন 'ধেনুরত্ন- বাবু কমলাকান্ত'। রাগে দুঃখে প্রসন্নর মাথা ঠিক থাকে না সেও তেড়ে-ফুরে বলে উঠলো "আমার গরুর দুধ -ঘি খেয়ে বড় হলি, এখন বলছিস গরু তোর। বদমাশ! শয়তান! মিথ্যুক কোথাকার!" কমলাকান্তের সাগরেদরা রে রে করে উঠে বলল, "এখান থেকে চলে যাও মাসি, নইলে গ্রাম ছাড়া করব।" প্রসন্ন গয়লানী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, গরু আর তার নাই। কমলাকান্ত তার ভোট কেড়ে নিয়েছে, এখন গরু কেড়ে নিল। গরু এখন আর তার নয়, "যে দুধ খায় তার।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴