গরম চা ও এক টুকরো উষ্ণ জীবন/শ্রুতি দত্ত রায়
গরম চা ও এক টুকরো উষ্ণ জীবন
শ্রুতি দত্ত রায়
এক অদ্ভূত ধূসর সময়ের নিরিখে ইদানীং যাপিত হচ্ছে আমাদের সবার জীবন। এক গভীর মন্দ লাগা প্রতিদিন একটু একটু করে ছত্রাকের মত যেন ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শিরায়, ধমনীতে, মননে, চিন্তনে। নিদারুণ অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা, অবিশ্বাসের ঘন কালো ধোঁয়া যেন ভারী করে তুলেছে আমাদের চারপাশ। বিপন্ন করে তুলেছে সকলের নৈতিক সত্তা। আমি মানুষটাও এর ব্যতিক্রম নই। ফলস্বরূপ শরতের সোনাঝরা রোদ্দুর, আকাশের নির্মেঘ মেদুরতা, শিউলির গন্ধ কিংবা ঢাকের বাদ্যি কোন কিছুই যেন সেই মন খারাপের কুয়াশার আস্তরণকে ভেদ করে এই বছর আমার মনকে আকুল করে তুলতে পারেনি। আর ঠিক সেই কারণেই বুঝি এবার শহরের দুর্গোৎসবের মুখরতাকে উপেক্ষা করে আমরা পাড়ি জমিয়েছিলাম এক পাহাড়িয়া গ্রামে। গ্রাম্য প্রকৃতির মাঝে একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে। কারণ একমাত্র প্রকৃতিই বোধহয় আজও পারে সমস্ত কৃত্তিমতার ঊর্ধ্বে উঠে অস্থির অন্তরকে স্থির করতে, দিতে পারে নির্ভেজাল প্রশান্তি।
এবার আমাদের গন্তব্য ছিল পাহাড়ের কোলে রাম্মাম নামক একটি ছোট্ট জনপদে। যাওয়ার দিন নানা কারণে রওনা দিতে আমাদের একটু দেরি হয়েছিল। দার্জিলিঙ যখন পৌঁছলাম, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সেখান থেকে বিজনবাড়ি হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাদের গাড়ি চলছিল পাহাড়ী পথ ধরে। তবে সে রাস্তা ছিল বড়ই বন্ধুর। বর্ষার বৃষ্টির জলে ভূমিধ্বসের কারণে পাকা সড়ক নিজে থেকেই রূপান্তরিত হয়েছিল আদিম পাথুরে জমিতে। রাতের ঘোর আঁধারে এমন বিপজ্জনক পথে আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল গাড়ির হেডলাইট। আর ছিল দিগন্ত বিস্তৃত কালো ক্যানভাসে ভেসে থাকা অসংখ্য জোনাকীর মত দূরের পাহাড়ের ঢাল বরাবর অদৃশ্য বাড়িগুলোর বিন্দু বিন্দু আলোগুলো। এভাবেই নানান চড়াই উৎরাই পার করে বেশ খানিকটা রাত করেই অবশেষে আমরা পৌঁছালাম আমাদের সেদিনের রাত্রিযাপনের ঠিকানা রাম্মাম আইবি-তে। ঘন্টা সাতেকের পথশ্রম ও টেনশনের পরে শরীর মন তখনও হয়েছিল বড্ড নিস্তেজ ও ক্লান্ত। তাই রাতের খাবার খেয়ে সরাসরি আশ্রয় নিলাম বিছানায়।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলার ঘর লাগোয়া বারান্দাতে যেতেই একটা হাল্কা শীতল বাতাসে আমার শরীর মন পুরো তরতাজা হয়ে উঠল। কানে আসছিল নীচ থেকে ভেসে আসা অদেখা 'লোধামা' নদীর বয়ে চলার একটানা ঝর্ ঝর্ আওয়াজ। আর তারই সাথে উপযুক্ত সঙ্গত দিচ্ছিল অসংখ্য নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির। দেখতে পেলাম দিগন্ত বিস্তৃত নীলচে সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। যে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে রংবেরঙের থোকা থোকা ফুল। বারান্দায় রাখা টেবিলের ওপর থেকে ভেসে আসছিল টি পটে সদ্য ভেজানো দার্জিলিঙ চায়ের টাটকা সুবাস। সেই সোনালী পানীয়তে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালাম। সবকিছু মিলিয়ে মুহূর্তেই যেন পঞ্চ ইন্দ্রিয় জুড়ে এক আশ্চর্য সুখানুভূতি,,, এক অসাধারণ ভাল লাগা আমাকে ঘিরে ধরল। দীর্ঘকালীন বিপন্নতা, নেতিবাচক চিন্তা, সামাজিক বিষাদের জীর্ণ খোলস ছেড়ে আরও একবার নতুন করে জীবনকে যেন ভালবেসে আলিঙ্গন করলাম। অন্ধকারাচ্ছন, কষ্ট ও বিপদসঙ্কুল রাতের পথ চলার শেষে এভাবেই হয়তো কমলা রঙের রোদ মাখা উজ্জ্বল দিন অপেক্ষা করে থাকে। এভাবেই হয়তো জীবন তার প্রতিটি "হেয়ার পিন" বাঁকে নানা অজানা চমক সাজিয়ে রাখে। অনেক খারাপ লাগার ভীড়ে হীরের কুচির মত জ্বল জ্বল করে সেই ভাল লাগা ছোট্ট মুহূর্তটুকু,,,,চিরকাল,,,,অমলিন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴