গভীরে সব তারাদের বাস/সুনীতা দত্ত
গভীরে সব তারাদের বাস
সুনীতা দত্ত
আমার রবীন্দ্রনাথ ভারিক্কি মানুষটা নন,তিনি আমার প্রাণপ্রিয়,বন্ধু,সখা আমার সুখ দুঃখের চিরসাথী। তাঁর জীবনস্মৃতি আমায় ভাবনার গভীরে ডুব দিতে শেখায়। তাঁকে ভালবাসতে আমায় কেউ বলে দেয়নি - কেউ শেখায়নি,অনেক বড় হয়ে উপলব্ধি করেছি "সহজ পাঠ" শিশু জীবনের কতটা জুড়ে থাকে।একটা সময় ছিল যখন সারাদিন প্রায় রেডিও শুনতাম - নাটক "গোরা" শুনলাম তারপর "ঘরেবাইরে"। চিত্রায়ন দেখলাম 'চারুলতা", "তিনকন্যা"। হাল আমলের কিছু চলচ্চিত্র ও দেখেছি - তাদের আবেদন ভিন্নস্তরের কিন্তু ইচ্ছে একটাই - রবি প্রণাম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
ছোটবেলায় ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় একবার বিষয় ছিল "কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি,বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি।"আঁকলাম ঠিক মনের মতো হলো না - কিভাবে যে এমন করেই রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনের সাথে মিশে যেতে লাগল তা এখন বোঝাতেও পারি না।
আমার রবি একটু ভিন্ন মাত্রার। সে বড় বিচিত্র - তবু সে খণ্ডিত নয়, অন্তরের স্তরে স্তরে তাঁর অবাধ যাতায়াত। কোনো এক সন্ধ্যায় আলোচনা সভায় কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন - "মেয়ে এখন কেমন আছে?" রবি কবি উত্তর দিলেন, "আজ সকালে সে মারা গেছে!" ছেলের শবদাহ করে এসে কাজে ডুব দিলেন। এসবের মাঝে মনে হয় আমার রবি আরেকটু সংবেদনশীল হলে ভালো লাগত, ছেলে মেয়ের মৃত্যুদিনে তিনি কাজ করেই চলেছেন! কোথায় যেন একটু অভিমান জমে ওঠে। এই রবীন্দ্রনাথ বড় কঠিন কঠোর সেই সাথে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার তীব্র সাধনায় মগ্ন। তিনি একটা যুগকে সাথে নিয়ে চলেছেন হয়ে উঠছেন একটা শক্তি, দুর্নিবার অপরাজেয় এক অখণ্ড রূপ। আবার তিনি যখন রাস্তায় নেমে জাত ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে রাখী পড়াচ্ছেন, সে রবির কিরণ আমার অহংকার - আমার রোল মডেল।
রবীন্দ্রনাথ আরো আমার মর্মে জেগে উঠলেন শান্তিনিকেতনের মাটিতে। শান্তিনিকেতন ঘুরে আসার পর খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার দোল উৎসবে যাই।কিন্তু আজও সেই সুযোগ আসেনি।
যেদিন আমি সঠিক সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছতে পারছিলাম না শুধু তাকে ডেকেছি। জানি না সে ডাক তার কাছে পৌঁছেছে কিনা কিন্তু রাষ্ট্রপতি মহাশয়ের সাথে দেখা হবার সময় কখন যেন উনি পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছেন যা হল না তার জন্য দুঃখ থাক - যা হচ্ছে তার জন্য আনন্দ তোলা থাক। কবির বাণী আমার জীবনে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।প্রতিবাদী সত্তা যখন গর্জে ওঠে তখন যাই হয়ে যাক মন বলে ওঠে - "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।"
এত সখ্যতার পরেও তাঁর সাথে মনোমালিন্য হয়।পরিবারের টাকায় মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চল ছিল ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথও আর পাঁচটা বাবার মতো মেয়েদের অনেক কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন।এই রবির সাথে আমার আড়ি। আবার কখন যেন ভাব হয়ে যায়। কবির বজ্রমন ঘোষণা আমার বিপদে আমাকে জানান দেয় -"বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,বিপদে আমি না যেন করি ভয়"।
আমার অনুভবে বয়ে বেড়াই অসহায় রবীন্দ্রনাথকে।সন্তান হারানোর যন্ত্রনা, পিতৃহারা ছেলে, স্ত্রী হারা স্বামী তবুও তিনি অজেয়। হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেন যখন তিনি নোবেল জয়ের খবর শুনে বলেন, যাক নর্দমা সারাইয়ের টাকার জোগাড় হল!
কখনও মনে হয় তাকে নিয়ে লেখা ছোট্ট বেলার কবিতা পড়ে বলেছেন, শুধু আমি নয় সব কবি লেখক কে চেতনায় উপলব্ধি কর - তবেই তো আমি থাকব।
সেই রবি আমার চিরসখা যে লেখে - "ভালোবাসি, ভালোবাসি, সেই সুরে কাছে দূরে, জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি।" এই ভালোবাসায় ভর করে মনের ডালি সেজে ওঠে। আমার হৃদয়ে তার নিত্য আসা যাওয়া। তার সমস্ত প্রতিভার এক স্থিতিস্থাপক অবয়ব হল গান। তার সাথে নিত্য নতুন করে নিজেকে পাই, তাই আমার ভিতর আর বাহির সবটা জুড়েই রবিকিরণ। ঘুমের ঘোরে জেগে উঠি যখন কষ্টের দিন আর যায় না - হঠাৎ দেখা মনে করিয়ে দেন "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে!"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴