গন্ডার গ্রামের সেই দেবী/তপেন্দু নারায়ণ রায়
গন্ডার গ্রামের সেই দেবী
তপেন্দু নারায়ণ রায়
১
রাঁশি থেকে গন্ডার গ্রাম পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমেছিল।যাব পঞ্চকেদারের তৃতীয় কেদার মদমহেশ্বর। মাঝের রাতটুকু গন্ডারে কাটিয়ে সকালে রওয়ানা দেওয়া হবে মদমহেশ্বরের উদ্দেশে। গন্ডারে সেই সময় হাতে গোনা তিনটি হোমস্টে। প্রথম দুটো হোমস্টেতে জায়গা নেই।দ্বিতীয় হোমস্টের এক দিদি তৃতীয় হোমস্টের ঠিকানা দেখিয়ে দিলেন। এই গ্রামে ইলেক্ট্রসিটি নেই। সবাই সোলার ব্যবহার করে বলে প্রয়োজন ছাড়া বিদ্যুৎ খরচ করে না। গ্রামের রাস্তা জঙ্গলের পাশ দিয়ে। আলো প্রায় নেই বললেই চলে। প্রাচীন বাংলার সন্ধ্যার মতন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝিঁঝিঁ আর পাখির ডাক তৈরি করেছে জঙ্গলের সান্ধ্যকালীন আবহ। তার মাঝেই দিদির দেখানো ঠিকানার দিকে এগোতে থাকলাম।কিছুদূর এসে মূল রাস্তা থেকে বেরনো গলি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম। দুএকটি বাড়ির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার পরই একজনের সাথে দেখা।জিজ্ঞেস করলাম তৃতীয় হোমস্টের কথা। তিনি বললেন,চলুন। রাস্তা ভুল করেছেন।আবার ওপরে উঠে মূল রাস্তায় এলাম।দুপা বাড়াতেই হোমস্টে খুঁজে পেলাম।আসলে ওই ভদ্রলোকেরই হোমস্টে। ঘর দেখিয়ে ভদ্রলোক চা-র কথা জিজ্ঞেস করলেন।ফ্রেশ হয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে যাচ্ছি বলতেই ভদ্রলোক কিচেনের ঠিকানা বলে দিলেন-আপ নীচে আ যানা।
থাকার ঘর ওপরে। ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এলাম। পাখি আর ঝিঁঝিঁ তখনও সঙ্গীতময়। জঙ্গলের পাশে গাঢ় অন্ধকার। অক্টোবর মাসের শীত। কনকনে হাওয়া বইছে।চায়ের উপযুক্ত পরিবেশ। কিচেনে আলো জ্বলছে। চা পান করতে করতে কিচেনের গরমে কিছুক্ষণ কাটাব বলে মনস্থির করে পা বাড়ালাম।কিচেনের দরজায় এসে গেলাম থমকে। অবাক চোখে তাকালো একজোড়া চোখ। ইয়ে সুকেশজীকা (নাম পরিবর্তিত) হোমস্টে হ্যায় না। উত্তর এলো হ্যাঁ। উনি নেই? জিজ্ঞেস করতেই বললেন না উনি পাশের বাড়ির কাকুর সাথে এই সময় আড্ডা মারেন।তারপরেই আধো হিন্দিতে বললেন -আন্দর আ যাও।একরাশ সঙ্কোচ নিয়ে ভেতরে ঢুকেই বললাম -হাম, কথা শেষ না হতেই বসার আহ্বান পেলাম।বসতে বসতেই বলে নিলাম - কিছুক্ষণ আগেই এই হোমস্টেতে এসে উঠলাম। তারপর উত্তর এলো-ও, বাবা তো কিছু বলল না। সঙ্কোচ তখনও কাটেনি। বরং একটা ভয় ঘিরে ধরেছে। গোটা গ্রাম নিশ্চুপ।কোথাও আলো নেই বললেই চলে। শুধু এই রান্নাঘরেই খড়ির আগুনের আলো। বাইরে থেকে হাওয়া আসে বলে রান্না ঘরের দরজাও বন্ধ। আর যার সাথে কথা বলছি তার বয়স উনিশ-কুড়ি।আর সে ওই ভদ্রলোকের মেয়ে। মনে মনে ভাবছি-কোনো বিপদ হবে না তো! এইসব ভাবতে ভাবতেই বলে উঠলাম-আসলে সুকেশজী চা খাওয়ার জন্য এই ঘরে আসতে বলেছিলেন, তাই এলাম।
-বাবা হয়ত ভুলে গেছে আমাকে বলতে। বসুন, চা করছি।
-আচ্ছা, চা হোক। মিনিট পনেরো পরে আসছি।
-মনে হচ্ছে আপনার ঠান্ডা লেগেছে। এখানে বসুন গরম পাবেন। ঘরে তো ঠান্ডা।
গলায় আদেশের ভাব। এদিকে অস্বস্তি কাটছে না আমার। কিছু বিপদ হবে না তো। আড় চোখে মেয়েটির মনস্তত্ত্ব পড়বার চেষ্টা করি। একেবারে নির্বিকার। ওই মুখ দেখলে বিপদের কথা মাথায় আসে না। এতক্ষণ সঙ্কোচ ছিল। এবার কোথা থেকে যেন একগাদা সাহস ঠাসাঠাসি করে ভিড় জমালো। ভালো করে দেখে নিলাম তাকে। মনের ভয়টা নিমেষে কেটে গেল। এমন পবিত্র মুখে কোনো শয়তানি থাকতে পারে না। সুতরাং রান্নাঘরেই থেকে গেলাম।
ততক্ষণে জঙ্গল একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। বাইরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। উনুনের আলো তখন বড্ড বেশি রোমান্টিক। আমার চিরচেনা সভ্যতার থেকে অনেক যোজন দূরে এসে মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার দেশ। ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছি আমি। মন তুলোর মতো হাল্কা হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অমন নির্জন পাহাড়ি পরিবেশের সন্ধ্যায় আমি বসে আছি যার সাথে তার মুখে গ্রাম্য সারল্য। কোনো কালি তাতে স্পর্শ করেনি। এই প্রথম বিশুদ্ধ সৌন্দর্য চাক্ষুষ করল মন! সৌন্দর্যের এই নির্মলতায় আমার মনও পবিত্র হয়ে উঠেছে। আমি নির্ভার বোধ করছি। স্বর্গ কী এমনই হয়! মনে প্রশ্ন জাগছে। আর আমি ভেসে যাচ্ছি দেবী প্রতিমার অমন রূপে। কথা বিশেষ এগোচ্ছে না।কখনও একে অপরকে দেখার কাজ চলছে। কী নিঃসঙ্কোচ চাহনি দুজনার। সময় বয়ে যাচ্ছে এমন করে। কত দ্রুত সুন্দর সব চিন্তা মাথায় খেলে যাচ্ছে!মনে রেখে দিচ্ছি সব। এমন করেই অনেকটা সময় কাটার পর সুকেশজী এলেন। তার সাথে গল্প জমল ঘন্টাখানেক। গল্পের স্রোতা হয়ে রয়ে গেল সেই দেবী।
পরদিন সকালে প্রাত:রাশ সেরে বিদায় নিলাম। হাত নাড়ল দেবী প্রতিমাও। মনে একখণ্ড বিষাদ জমিয়ে চলতে শুরু করলাম মদমহেশ্বরের উদ্দেশে। আর মনে চলতে লাগল অনন্য সৌন্দর্যের সেই রাতের স্মৃতি।পথের রূপ আর গতরাতের মধুর স্মৃতি মাখামাখি করে পৌঁছে গেলাম মদমহেশ্বর।
২
তখন বেলা পড়ে আসছে। ফেরার তাড়া। দুমুঠো বৃষ্টির হঠাৎ আগমনে থেমে গেলাম গন্ডার গ্রামে। কয়েক মিনিটের বৃষ্টি শেষে পাহাড়ের মাথায় রোমান্টিক রামধনু আধখানা চাঁদের মতন সেজে উঠেছে। হঠাৎ বৃষ্টির পর অপ্রত্যাশিত রোদের সৌজন্যে রামধনু তখন ষোড়শী বালিকার মতন সুন্দর। রোদের মাঝেই টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে দুএকটি বৃষ্টির ফোঁটা।এখনই বেরিয়ে পড়া ঠিক হবে কিনা এই নিয়ে মনে দোলাচল, যদি বেরোনোর পর মাঝরাস্তায় বৃষ্টি নামে! দাঁড়ানোর কোনো আশ্রয় পাওয়া যাবে না। রাঁশি গ্রাম সেই অনেক দূর। এইসব চিন্তাস্রোতকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছি পাহাড়ের গায়ে হেলে পড়া সেই রামধনু, টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা আর বৃষ্টির মাঝেই দৈনন্দিন কাজে মেতে থাকা গ্রামের নরনারীদের। আর মনে মনে খোঁজ চলছে একজনের। একবার দেখা পাওয়ার জন্য দুচোখ ঘুরে চলেছে গ্রামের আনাচকানাচ। মনে হচ্ছে যাওয়ার আগে আর একবার যদি তার দেখা পাওয়া যেত! এই তো পনেরো কুড়ি মিনিট আগেই মন ভোলানো হাসি দিয়ে বিদায় জানাল। আর ঠিক তারপরেই বৃষ্টি নামল। আটকে গেলাম গন্ডার গ্রামে। এই অল্প সময়ের মধ্যেই হারিয়ে গেল!
আরো মিনিট দশেক পরে রওয়ানা দেওয়াই স্থির হল। এক দু’পা ফেলতেই এক্কেবারে সামনে দেবীর দেখা মিলল।এক্কেবারে চোখে চোখ। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হল জীবন ধন্য। দেবী হাত নেড়ে আবার বিদায় জানালেন। সময়ের ওই পলেই আমার দুপা আরো এগিয়ে গেল গন্ডার গ্রাম থেকে। আর দেবীর দুপা এগোল আমার বিপরীতে। পরস্পরকে অতিক্রম করলাম আমরা। দুজনেই শেষবারের মতো মাথা বেঁকিয়ে দেখে নিলাম দুজনকেই। ছেড়ে আসার মুহূর্তে দেখা মিলল ঝলমলে দুটি চোখ আর তাতে অপার বিস্ময়! এতক্ষণ গ্রামে পড়েছিল মানুষটা। রাঁশি পৌঁছনোর আগেই তো সন্ধ্যা নামবে! তার চোখের বিস্ময়টুকু পড়তে পড়তে আর আরো ছাইপাশ অবাস্তব কল্পনা মাথায় নিয়ে এগিয়ে চললাম। আর দুকিমি যেতে না যেতেই সন্ধ্যা নামল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴