খোলা চিঠি/মৌসুমী রায় (সেনগুপ্ত)
খোলা চিঠি
মৌসুমী রায় (সেনগুপ্ত)
পার্থ, তোর প্রিয় গানটার মতো কোনো 'ঝড়ের মুখে' ঠিকানা রেখে যে হারিয়ে গেলি, কোথাও তো তোকে খুঁজে পাচ্ছি না ভাই। আজ যখন "উঠোন" জুড়ে শুধুই তুই, এখানেই আমার চিঠিটা রাখলাম।
তোকে নিয়ে যে এভাবে লিখব, কখনও তো ভাবিনি। তুই নিজেও তো চাইতিস না, বলতিস "স্বজন পোষণ করবে দিদি?" কিন্তু আজ তো আমি লিখতেই পারি বল? আজ তো তুই আর মুষ্টিমেয় কয়েকজনের না... আজ তুই সবার আদরের শ্রদ্ধার ভালোবাসার স্নেহের এক দেবতুল্য মানুষ "অনিন্দ্য সেনগুপ্ত"। বিশ্বাস কর এ চিঠি লিখতে বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে.... পৃথিবীর কোনো দিদিকে যেন এমন চিঠি লিখতে না হয়।
মেধাবী ছাত্র, ভালো খেলোয়াড়, ভালো সংগঠক আর সুসাহিত্য এবং সুস্থ সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তোর। সবসময়ই আড়াল থেকে নেতৃত্ব দেওয়া পছন্দ করতিস। কত সংগঠনের সঙ্গে যে যুক্ত হয়ে পড়েছিলি, বলা ভালো দিনে দিনে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলি। ইদানিং বলতিস "বড্ড চাপ যাচ্ছে গো দিদি "। মনে আছে তোর, একদিন রাগ করে বলেছিলাম "আমাকে দুর্গা দিদি বললেও তুই ভালো করেই জানিস, ঈশ্বর যেমন আমাকে দশটা হাত দেননি তোকেও কিন্তু দশটা মাথা দেননি"। একটু চুপ করে থেকে বললি "দিলে বড় ভালো হত গো"।
নিজের সম্বন্ধে ছিলি প্রচন্ড উদাসীন। ডাক্তার দেখানোতেও ছিল ঘোর অনীহা।আর আজ কী হল? তোর সব স্বপ্ন, তোর সংগঠন, বড় আদরের বড় যত্নের ছোট্ট সংসার সব পড়ে রইল, একবারও ভাবলি না তাঁদের কথা.... সন্ধ্যা হলেই যে দুজন মানুষ চেয়ে থাকতেন তোর ফিরে আসার পথের দিকে, বোন সোমা, বড় আদরের ভাগ্নে, যাদের তুই তুলোয় মুড়ে বড় করে তুলেছিস, ভাবলি না কারো কথা। তাঁরা নিজেদের সামলাবে কী করে পার্থ। এটা তো তুই পারিস না.... তুই তো কাউকে কষ্ট দিতে পারিস না।
প্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ক'টা লাইন শুনিয়ে বলতিস.... "এটা আমারও মনের কথা"
"আমি এমন ভাবে পা ফেলি / যেন মাটির বুকেও আঘাত না লাগে / আমার তো কাউকে দুঃখ দেবার কথা নয়..."
জানি আড়াল থেকে আগের মতোই বলছিস, "তোমার তো কষ্ট পাওয়ার কথা নয় দিদি, তোমার সঙ্গে যে তোমার রবিঠাকুর আছেন"। ...পাচ্ছি না রে, কোথাও শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না, বড় আঘাত দিয়ে গেলি তুই....।
বই অন্ত প্রাণ ছিল তোর। কাউকে উপহার দেওয়ার সময় বইই সব থেকে পছন্দের ছিল তোর। আবার কারও কাছ থেকে বই উপহার পেলেও শিশুর মতো হাসি ফুটে উঠত তোর মুখে.... গত বছরের বই মেলাতেই শেষ এসেছিলি কোলকাতায়.... এবারও তো আসার কথা ছিল....।
"মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও" -এটাই যে ছিল তোর জীবনের মূল মন্ত্র। তোর দীর্ঘ হাত দুটো সুদীর্ঘ হতে হতে নীরবে কত মানুষের কাঁধে আস্থার হাত রেখেছিল, কত মানুষের মাথার ছাতা হয়ে উঠেছিল.... সবটা আমরাও হয়ত জেনে উঠতে পারিনি।নিজের ছোট্ট সংসারটার পাশাপাশি আরও এক বৃহত্তর সংসারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলি তুই।
ছিলি একজন আদ্যন্ত সংগীত প্রিয় মানুষ। শোনার কান ছিল মারাত্মক। সমস্ত ধারার গানের ভক্ত ছিলি তুই। মনে আছে, একবার একজনের গানের সমালোচনা করায় বলেছিলাম "এত খুঁত ধরলে হবে? আমরা তো সবাই শিল্পী নই"। বলেছিলি "গান আর লেখা এদুটোর কোনোটাই যে আমার কমে সয় না গো"।
আসলে গান, লেখাপড়া খেলাধুলা যা কিছুই আত্মস্থ করতিস সবটাই নিখুঁত ভাবে করতিস, কোনো ফাঁকি ছিল না সেখানে। তোর আরো একটি অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল ছবি তোলা। প্রকৃতি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা প্রান্তিক মানুষই ছিল বেশি পছন্দের। নিজেই একদিন বলেছিলি "ছবির সঙ্গে কথা বলা আমার অন্যতম নেশা"....।কল্পনা আর বাস্তবের মিশেলে আর তোর অসামান্য লেখনীর গুণে ছবিগুলো আমাদের চোখে গল্প হয়ে ধরা দিত। এই ছবি আর লেখাগুলো নিয়ে একটা কাজ করবার ইচ্ছে ছিল তোর.... কতদূর এগিয়েছিলি, জানা হল না। জানা হল না তোর সব ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলোকে যে এক জায়গায় করবার কথা ভেবেছিলি কতদূর এগিয়ে ছিল সেই কাজ। কেন এত তাড়া ছিল তোর? তোর অবচেতন মন কী কিছু জানান দিচ্ছিল পার্থ? সেদিনও তো দুপুরে একটা লেখা পাঠিয়ে বলেছিলি "একটু দেখে দিও তো.... রাতেই ঠিক ঠাক করে পাঠিয়ে দেব"। বিকেল চারটের পর ফোনও তো করলি... তখন তো কিছু বললি না ভাই, নাকি বলেছিলি আমিই বুঝতে পারিনি...। হ্যাঁ বলেছিলি তো.... তুই নিজে কেমন আছিস জানতে চাওয়াতে বলেছিলি "আমি ঠিক"। অন্য দিনের মতো তো একবারও বললি না "বিন্দাস আছি", "ফার্স্ট ক্লাস আছি"। কেন বললি না? বড় আপশোস থেকে গেল জীবনে। আমার এবারের 'চিকরাশি' সহ আরো কিছু পত্রিকা তোর কাছে ছিল .... বলেছিলাম মার্চ বা এপ্রিল -এ গিয়ে নেব। কিন্তু কী আশ্চর্য ১৪ই ফেব্রুয়ারি ব্যারাকপুরের এক ডাক কর্মী ভাই আমাদের বাড়ি এসে সব পত্রিকা দিয়ে বলে গেল "দাদা পাঁচ তারিখে বিকেলে ফোন করে বলেছিল কতগুলো বই পাঠালাম, তুই নিজে গিয়ে
দিদির বাড়ি দিয়ে আসবি".....। এত তাড়া ছিল তোর? কেন?.... ক'দিন আগে কথায় কথায় স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার কথাও বলেছিলি..... তারপর বকুনি দিতেই বললি "আসলে মাথার মধ্যে অনেক লেখার প্লট এসেছে সেগুলো নামাতে হবে, অনেক ভালো ভালো বই পড়া বাকি আছে সেগুলো শেষ করতে হবে" ...। বলেছিলাম "সত্যি অবসরের দিনগুলো কী করবি তবে"? তার পর এ নিয়ে আর কথা হয়নি... সব কিছুতেই এত তাড়া? কেন? ছিলি কবীর সুমনের অন্ধ ভক্ত.... তাঁর গানের কটি লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে....
"সে চলে গিয়েছে তবুও যায়নি যেমন যায় না আসলে কেউ / ষ্টিমার দিয়েছে দিগন্তে পাড়ি তীরে ফিরে এল অনেক ঢেউ"..... ঢেউয়ের মতো কত কথা কত স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে.... মনে আছে একদিন বৃক্ষ রোপন নিয়ে কথা হচ্ছিল, বড় গাছ লাগানোর জায়গার অভাবের কথাও হয়েছিল... বলেছিলাম তোর বাড়ির পিছনে চা বাগানের ধারে কিছু গাছ তো লাগাতেই পারিস, বললি "লাগিয়ে ছিলাম গো, কিছু বোগেন ভেলিয়া...কিন্তু আগাছাগুলো এমন চেপে দিয়েছে একটাও বোধহয় বাঁচেনি"। এর ঠিক ক'মাস পরেই একটা ছবি পাঠিয়ে বলছিলি "ছবিটা জুম করে দেখ দিদি"..। ও মা!!! দেখি একটা লম্বা রেন ট্রির মাথায় থোকা থোকা গোলাপী বোগেন ভেলিয়া ফুটে আছে....তারপরই তোর উচ্ছ্বসিত ফোন... "আগাছার সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় গাছটাকে অবলম্বন করে কেমন ফুল ফুটিয়েছে দেখ..... প্রকৃতি পারে আমরা কেন কোনো দূর্বল মানুষের অবলম্বন হতে পারিনা"? অবাক হয়ে গেছিলাম সেদিন। আজ আর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে তুই শিক্ষা নিতিস প্রকৃতির থেকে আর আমি তোর থেকে....।
শ্রদ্ধেয় ভূপেন হাজারিকা মহাশয়ের এই গানের লাইনগুলো বড্ড প্রিয় ছিল তোর.... কোনো এক লেখায় ব্যবহার ও করেছিলি, "বল কী তোমার ক্ষতি / জীবনের অথৈ নদী / পার হয় তোমাকে ধরে / দূর্বল মানুষ যদি "
তোকে নিয়ে কলম ধরলে সেটা যে আর থামে না রে... কত লিখব? নিজেকে সবসময় রবিঠাকুরের "তারাপদ" ভাবতিস তুই। একদিন বকুনি দিয়ে বলেছিলাম "ফের যদি নিজেকে তারাপদ বলিস আমার সামনে..."। কথাটা রেখেছিলি, দিদি বলতিস যে....! কিন্তু যার সমস্ত মন প্রাণ সত্তা জুড়ে শুধুই 'তারাপদ' আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাধ্য কি তাঁর নাগাল পাই? তাঁকে বেঁধে রাখি মায়ার বাঁধনে? কিন্তু তুই আছিস, তুই থাকবি আমাদের সমস্ত হৃদয় জুড়ে.... শুধু আমরা তোকে দেখতে পাচ্ছি না। যেদিন দেখা হবে আমার সমস্ত অভিমান আর কেনর উত্তর নিয়ে অপেক্ষা করিস......।
- দিদি
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴