সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
07-May,2023 - Sunday ✍️ By- দেবর্ষি সরকার 427

কড়িকাঠের রবি/দেবর্ষি সরকার

কড়িকাঠের রবি
দেবর্ষি সরকার
-----------------------
আজকেও আমাকে মনে রাখেনি। তাই হয়তো কেবল বিভিন্ন পর্যটকেরা যখন ঘুরতে আসে এই লাল ইট বাঁধানো গাড়ি থেকে আমার দিকে তাকিয়ে প্রহসনের ছলে কেবল বলে চলে এই খড়িকার গুলো দেখেই না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত গান কবিতা গল্প লিখে গেছেন। সবগুলোই যুগশ্রেষ্ঠ তকমা পাওয়ার অধিকারী। হ্যাঁ আমি ৬ নং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দার ছাদের একটি সামান্য করিকাঠ। আজ রবি ঠাকুরকে নিয়ে দু এক কথা বলবার ফুসরত পাওয়াতে নিজের মনের ভালোলাগাগুলো উজাড় করে দিয়ে যাবো পাঠক ও শ্রোতার কাছে। আমি নিতান্তই এক সামান্য ক্ষুদ্র কড়িকাঠ।

আমার জন্ম কলকাতা থেকে সুদূর উত্তরে দার্জিলিং এর সরলবর্গীয় বনভূমির এক গভীর সান্দ্রো অরণ্যে। ওখানে কৈশোর ও যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য অবস্থায় পদার্পণ করবার আগেই আমাকে মাটির সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে চলে আসতে হয় ৬ নং লেনের এই তিনতলা এই বাড়িটিতে।
মানুষ আজকাল গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড পরিমাণে সোচ্চার হয়েছেন কিন্তু আমি এই ভেবে গর্ববোধ করতে পারি যে আমি নিজের চোখে দেখেছি ,কানে শুনেছি যুগের কত ইতিহাসের মহাকালের নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আজ অনেক তাবড় তাবড় গবেষকরা নানা গবেষণা করে চলেছেন কিন্তু আমাদের মতো সামান্য কড়িকাঠ গুলোর বুকের ইতিহাস কেউ শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করে না কিন্তু আমরাও অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছি। সেটা আজ বলব।

প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এসেছিলাম সেদিন দেখতে পেয়েছিলাম ঘেয়া ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে তার তিলককাটা। তারপর জানতে পেরেছিলাম সে আর কেউ নন আমাদের সুপরিচিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব প্রিন্স দ্বারকানাথ। হ্যাঁ আমার কথার সাথে আপনারা অনেকেই দ্বারকানাথের চেহারার বর্ণনা মেলাতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যেই সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজকের মতন একেবারেই নয়। তারপর কর্তার তত্ত্বাবধানে যত্ন করে কাঠমিস্ত্রি গুলো আমাকে ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দার ছাদে লাগিয়ে দিল। তখনো আমি জানতে পারিনি যে আমার নীচে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখে চলবে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস "চোখের বালি।"  কি অদ্ভুত! 

প্রত্যেক সন্ধেতে গিন্নিমা যখন ঠাকুর ঘর থেকে বের হয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে ঘুরে ধুপের ধোঁয়া পৌঁছে দিত ঠিক সেই সময় শূন্যের দিকে ধাবিত ধুপের ধোঁয়া গুলো আমার শরীর ছুঁয়ে যেত। সে আশ্চর্য অনুভব কেবল মনে মনে কল্পনা করে চলবার বিষয়। প্রথমে প্রিন্স দ্বারকানাথ তার স্ত্রী দ্বিগম্বরী দেবী ও দাস দাসীদের নিয়ে একাই থাকতেন এই বিশাল বাড়িতে। প্রথমে দেখতে পেতাম এদের বাড়িতে যথাবিধি নিয়ম মেনে তিন বেলা নারায়ণ শিলা পুজিত হয়। এমনকি প্রথমের দিকে এরা এতটাই রক্ষণশীল ও গোরা বৈষ্ণব হয়ে পড়েছিলেন যে "কুটনোকোটার" বদলে এনারা বলতেন "সবজি বানানো"। কিন্তু হঠাৎ এক কালবৈশাখী সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গেল। ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেক সদস্যের মতন আমিও তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। হঠাৎ একদিন দ্বারকানাথ রাত্রে বাড়িতে ফিরে এলেন না। দিগম্বরী দেবী চিন্তায় উদগ্ৰিব হয়ে লোক পাঠালেন তাকে খুঁজে আনবার জন্য। সেই পেয়াদারা ভোরবেলা এসে খবর দিল বাবু সারারাত ইংরেজদের সাথে মদ খেয়ে বিলাসনে মত্ত হয়েছিল তাই ঘুমের ঘোরে বাড়ির কথা ভুলেই গেছে। এই কথায় দ্বিগম্বরী দেবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি ভাবতেই পারেননি যে বাড়িতে মাছ, মাংস পর্যন্ত ঢোকে না সেই বাড়ির বৈষ্ণব কর্তা মুসলমানের হাতে রান্না করা মাংস খাবে। কিন্তু তিনি তখনো বুঝে উঠতে পারেননি যে এই সব কিছুই ছিল ইংরেজ সাহেবদের মন রাখার চেষ্টা। যাতে সাহেবরা দ্বারকানাথ কে তৎকালীন জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। দিগম্বরী তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন সেই আসরে। স্বামীর পা ধরে বললেও তিনি কিছুতেই তাকে মদ্যপান থেকে বিরত করতে পারলেন না । তারপর একদিন দেখতে পেলাম দিগম্বরী তাদের কুলপুরোহিত কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন স্বামীকে ছেড়ে দিলে তার কোন পাপ হবে কিনা। কিন্তু কুলপুরোহিতের কোনো উত্তরই আমার কানে এসে পৌঁছল না। শুধু দেখতে পেলাম তারপর থেকে মাতাল দ্বারকানাথ যেটুকু সময় বাড়িতে থাকতেন দিগম্বরী দেবী তার যত্ন আত্তির কোনো ত্রুটি রাখতেন না। কিন্তু স্বামীর থেকে অকারণেই দূরত্ব রেখে চলাফেরা করতেন। তখন থেকেই দেখতে পেলাম দিগম্বরী ও দ্বারকানাথ সম্পূর্ণ আলাদা ঘরে থাকতেন। ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুযায়ী রাতের বেলা গলায় বেলি ফুলের মালা পড়ে শুতে যাওয়ার প্রথা সেখানেই বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ আরেকদিন শুনতে পেলাম দিগম্বরী দেবী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তবে তিনি ছিলেন প্রচন্ড সাহসী, বীর্যে বীর পুরুষের সমান।

হঠাৎ এক কুয়াশামাখা শীতের জড়তা ভেদ করে এই বাড়ির উঠোনে এসে থামল তোমাদের বিশ্বকবির মায়ের পালকি। তখন তিনি নববিবাহিত সামান্য এক কন্যা। সদ্য বারো বছর বয়স। সরলা দেবীর সাথে পদ্মার ওপার থেকে আসলো প্রিন্সের পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর যতদিন সামনে এগিয়ে চলল সময় ও মহাকালের রথের চাকাও এগিয়ে গেল। সাহিত্য চিত্রকলা সংগীতকলার ইতিহাসে নব নব যুগের, নব নব চিন্তা ভাবনার, মূর্ত দৃষ্টান্ত এই বাড়ি। মানুষ অমর হয়ে রইল তাদের শিল্পকর্মে। প্রথমে জন্মালো রবীন্দ্রনাথের সবথেকে বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপরেই সারদা সুন্দরীর কোল আলো করে জন্মালেন প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে আমরা তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে দেখতে পাবো তৎকালীন নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে। তারপর একে একে সারদার কোল আলো করে জন্মালো হেমেন্দ্রনাথ ,বীরেন্দ্রনাথ, সৌদামিনী, সুকুমারী, শরৎকুমারী, পুন্যেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারি, সোমেন্দ্রনাথ, বুধেন্দ্রনাথ ও সর্বকনিষ্ঠ যিনি বাংলার মুখ দেখলেন তিনি অমর করে রেখে গেলেন বাংলা সাহিত্যেকে বিশ্বের দরবারে।  তিনি আর কেউ নন মৃণানিণি দেবীর স্বামী ও সারদা দেবীর চতুর্দশ সন্তান আজকের সকলের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিনও এইরকম বৈশাখের সন্ধ্যায় ওই ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচের হাত ধরে শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের নতুন এক যুগের জয়গান, রবীন্দ্রযুগ। আমি তার বাস্তব সাক্ষী।

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে সত্যি খুব হাসি পায়। ছোট রবি মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাড়িতে এসে পৌঁছলেই দাস-দাসীরা তাকে  ঘরের অন্দরমহলে নিয়ে যেতেন। তারপর পোশাক-আশাক ছাড়িয়ে হাত পা ধুলেই শুরু হত ছোট রবির বায়নার পালা। তার কতই আবদার! বৃদ্ধ ভৃত্য যখন চক দিয়ে চারিদিকে গোল করে গোন্ডি কেটে তাকে লক্ষণরেখার ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যেতেন তখন বাচ্চা ছেলের কান্নার আওয়াজে সমস্ত ঠাকুর বাড়ির লোক বিব্রত হয়ে পড়তো। সারদা দেবী তখন আর বেঁচে নেই। তাই ছোট থেকেই মাতৃঅভাব রবীন্দ্রনাথের মনে বিস্তার লাভ করেছিল। প্রথম থেকেই অতি প্রবল ভাবে সেই মন খারাপ গুলি হয়তোবা পরে আকৃতি পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের "ছুটি ", "অতিথি" ইত্যাদি গল্পগুলোতে।  যখন তার জ্যোতিদাদার সদ্যবিবাহিত এগারো বছরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী নিজের হাতে করে পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ ভাজা এনে রবিকে খাইয়ে দিতেন তখন তার মনের আগুন পান্তায় ঠান্ডায় শীতল হয়ে যেত। এই ঠাকুরবাড়িতে কাদম্বরী দেবীই ছিল রবির একমাত্র খেলার সঙ্গী। আমাদের রবির ও তার "নতুন বৌঠাকরুনের" সুখ, দুঃখ ,ভালোবাসার, সাক্ষী হয়ে আছি আমি। নিজের চোখে কত কিছুই না দেখেছি! যখন বাড়ির ছাদে রবি ও কাদম্বরী দেবী গড়ে তুললেন নন্দনকানন নামের ফুলের বাগান তখন দিনরাত রজনীগন্ধার সুবাসে আমার মাকড়সার ঝুল ধরে থাকা কাঠগুলোও যেন সজীব হয়ে উঠতো। ঠাকুরবাড়ি রীতি অনুযায়ী বিকেলবেলা প্রত্যেক মহিলা যখন স্নানেসেরে মুক্তোর গয়নায় সেজে এসে বসতেন সেই নন্দনকাননের সাহিত্য আসরে ছাদের নিচে থেকেও আমি ঠিক শুনতে পেতাম তাদের সারদামঙ্গল পাঠের নির্ভুল উচ্চারণ ও হাসি মাজা ঠাট্টার মাধ্যমে কাদম্বরী দেবীর দ্বারা তার ছোট রবির ভর্ৎসনা। সেই ভর্ৎসনা গুলোই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে উদ্বুদ্ধ করেছে তার সাহিত্যের রথকে সমানতালে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সত্যিই আজ ভাবলে অবাক হতে হয়, রবির জীবনে তার নতুন বউ ঠাকরুন না আসলে আমরা কতই না সাহিত্য সৃষ্টির থেকে বঞ্চিত হতাম। পৃথিবীর কত আশ্চর্য আমাদের অজানা থেকে যেত। 
তারপর একদিন দুপুরবেলা যখন বাড়ির সবাই খেয়েদেয়ে একটু ঘুমোতে গেছে সেই ফাঁকে আমরাও যখন একটু শান্তিতে নিদ্রায় যাব ঠিক সময়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনীর সাথে আমাদের রবি গাড়ি করে চলে গেল সুদূর যশোরে রবির জন্য পাত্রী দেখতে। পাত্রী আর কেউ না ঠাকুরবাড়ির কর্মীর মেয়ে ভবতারিণী। যশোরের অনেক মেয়েই ঠাকুরবাড়িতে বউ হয়ে এসেছে কিন্তু ওই ভবতারিনীর মতন আর একটিও আসেনি। যাকে নিজের চোখে দেখেছি। যেদিন রবি বিলেত চলে গেল ওকালতী পড়বার জন্য সেদিন ঠাকুরবাড়ির নাট্যকর্মী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একমাত্র গৃহিনীর সাথে আমিও সমান তালে গলা মিলিয়ে কেঁদেছিলাম। সেই খবর কি কেউ জানতে চেয়েছে ? 

তারপর হঠাৎ একদিন এই দক্ষিনের বারান্দার নিচ দিয়ে দাস দাসীরা যখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলো যে আগামী রবিবার রবির বিয়ে সেদিন আমিও কত যে খুশি হয়েছিলাম তার পরিমাপের কোন একক নেই। তারপর রবিবার যথাসময়ে আমার দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে তুমি বরবেশে হেঁটে গিয়ে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসলে ভবতারিণীকে। তার পর নতুন বউয়ের নাম হলো মৃণালিনী দেবী। ঠাকুরবাড়ির এই ছিল এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য বিয়ের পর বউদের নাম পাল্টানোর প্রয়াস । সেই দাস-দাসীদের মুখ থেকেই জানতে পেরেছিলাম যে তুমি বিয়ের রাতে ভরা খেলার সময় সমস্ত ভরাগুলো উল্টিয়ে ফেলেদিয়েছিলে। তোমার মনে এমন কী ছিল রবি?
আমি তো তোমাদের মতন শিক্ষিত নই তাই বলতে পারছি না বা জানিও না যে জলের পরিমাপের জন্য কোন একক ব্যবহৃত হয় তাই আমার চোখের জলের পরিমাণ আমি করে রাখতে পারিনি। যেদিন নতুন বউ ঠাকরুন বিষ খেয়ে নিজের প্রাণ দেওয়ার পর তুমি আর তোমার জ্যোতি দাদা আমার দক্ষিণের বারান্দা হ্যাঁ, ঠিক আমার নিচ দিয়ে কাদম্বরী দেবীকে ধরে ধরে হাটাতে চেষ্টা করছিলে তার আঁচল খুলে ভূমির ধুলোগুলো সংগ্রহ করছিল। মুখটির দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। তাকে আমি সেইদিন যে অবস্থায় দেখেছি সেই দিনের কথা আমি বর্ণনা করতে পারব না। সেই ভাষা এই সামান্য কড়িকাঠের নেই। দুদিন পর চোখে তুলসী পাতা দিয়ে যেদিন তাকে শ্মশানে পাঠানো হলো আমি আরো একা হয়ে গেলাম রবি। তারপর যে যার মতই উপনিষদের বাণী উচ্চারণ করে মহর্ষি হয়ে গেলেন। সেই ঘটনার আগে এত বেদ প্রেম কোথায় ছিল তোমার ঠাকুরদা, দাদা, বাবাদের ?

অনেকটা দুঃখের কথা বলে ফেললাম রবি। পাঠকেরা হয়তো ভেবে চলেছেন এই করিকাঠের মনে এত দুঃখ থাকতে পারে ! তাই এক হাসির কথা বলছি শুনুন।  তখন তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অধ্যাপনা, লেখালেখি, গান-বাজনা ও ছাত্রদের পড়াতে ব্যস্ত‌ আপনাদের কবি। নিজের শরীরের দিকে কোন খেয়ালই তার সেই সময়ে নেই। হঠাৎ একদিন সস্ত্রিক শান্তিনিকেতন থেকে আপনাদের কবি এসে জুটলেন জোড়াসাঁকর বাড়িতে। বাড়িতে এসেই তার বোনপো প্রমদা দেবীর দেবীর কাছে আবদার করে বসলেন তাকে মানকচুর জিলেপি রান্না করে খাওয়াতে হবে। আপনাদের বিশ্বকবি সেই ছোট বয়স থেকেই এমনি আবদার করবার স্বভাব কোথা থেকে যে পেয়েছিল! বাপের জন্মে শুনেছেন জিলেপি হবে তাও আবার মানকচুর ? হ্যাঁ আপনাদের কোবির সেই বিচিত্র আবদারের সাক্ষী একমাত্র আমি। যথারীতি সেই সময়ে আপনাদের কবি নীরলস দিনরাত এক করে লিখে চলেছেন চিরকুমার সভা। রূপক সাংকেতিকতার আড়ালে যে কতটা হাস্যবোধ লুকিয়ে আছে সেই নাটক পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু আজ বললে কেউ হয়তো বিশ্বাস করবেন না টানা তিন সপ্তাহ না খেয়ে থেকে এই নাটক লেখা শেষ করেছেন কবি। হঠাৎ একদিন সন্ধেতে প্রমদা রুপোর থালাতে মান কচুর জিলাপি বানিয়ে এনে রাখলে কোবির সামনে। কবি খেয়ে তো প্রশংসার কোনো ভাষাই খুঁজে পেলেন না তার অভিধানে। কবি জানতেন প্রজ্ঞাসুন্দরীর পর একমাত্র এই বোনপোটিই রান্নায় ছিলেন পটীয়সী। কবি দেশী পাঠার ঝোলোও খেতে ভালোবাসতেন তার এই বোনপোর হাতের। এমনিতেই ঠাকুরবাড়ির নিয়মমত প্রত্যেক বউকেই প্রত্যেকদিন একটি করে রান্না করতে হতো তাই সকলেই ছিলেন রান্নার পটীয়সী। পরে জানা যায় শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন একদিন আপনাদের বিশ্বকবির আবদার রাখতে মৃনালিনী দেবীও তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিলেন এই মানকচুর জিলেপি। 

জানো রবি সেদিন আমার খুব কষ্ট লেগেছিল যেদিন মহর্ষি তোমার দিদি স্বর্ণকুমারীর বিবাহের জন্য পাত্র খুঁজে পাননি। বরঞ্চ কেউ তাকে নিজের ছেলে দিতে রাজি ছিলেন না কারণ তোমরা হলে কুশারী ব্রাহ্মণ। তোমরা বিবাহ বাসরে শালগ্রাম শিলায় বিশ্বাস রাখো না। কিন্তু ভালোবাসার কি কোনো ধর্ম হয় রবি ? জোড়াসাঁকোতে যেকোনো দিয়ে উপলক্ষে বসতো নাটকের আসর। সে বিয়ের দিনেই হোক বা বিয়ের আঠ দিন পরেই হোক। তখন আমার খুব হাসি পেত। কেন বলতো? তার কারণ যে আত্মীয়-স্বজন তোমাদের কুশারী ব্রাহ্মণদের বিয়েতে উপস্থিত হতেন না তাদের নাটক দেখবার নাম করে এ বাড়িতে নিয়ে এসে তোমরা জলখাবার বলে যে তাদের বিয়ের ভোজ খাইয়ে দিতে হাতে হাতে সেই দেখে আমার হাসি বাঁধ মানতে চাইতো না রবি।
জানো রবি একবার বাল্মিকী প্রতিভা আর একবার কালমৃগয়ায় যখন তোমার জ্যোতিদাতা সত্যিকারের বক পাখি মেরে নাটকের জন্য মঞ্চে নিয়ে রাখলেন আর কালমৃগয়ায় হরিণের জন্য নিজের পোষা এক হরিণ ছেড়ে দিলেন মঞ্চে সেদিন আমার এই দক্ষিণের বারান্দায় ঘেরাটোপের পেছনে বসে থাকা ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের সাথে আমিও হেসেছিলাম তোমার ওই নাটকপ্রিয় দাদার কীর্তি দেখে।

তারপর যত দিন এগিয়ে চলল এই বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে আমারও বয়স বেড়ে চলল। একে একে দেখতে পেলাম কবি পত্নীর কোল আলো করে জন্মালো তাদের পাঁচ ছেলে মেয়ে। যথাক্রমে তারা হলেন, মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, অতশীলতা ও শমীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ, রেনুকা, অতশীলতা শমীন্দ্রনাথ যখন জন্মালো তখন পৌষের কুয়াশায় চারিদিকে কিছু দেখা যায় না। সেইবার ঠান্ডাও পড়েছিল ব্যাপক হারে। তারপর একে একে প্রত্যেক সন্তানগুলোই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়লেন। কিন্তু কেউ টিকতে পারলেন না। সব থেকে কষ্ট হয়েছিল আমার যখন শুনতে পেরেছিলাম তুমি তোমার বড়মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরৎকুমার চক্রবর্তী অর্থাৎ তোমার জামাইয়ের হাত থেকে প্রচন্ড লাঞ্ছনা শিকার করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলে। আচ্ছ  সেতো দর্শনের শিক্ষার্থী ছিল সে কেন এমন বিরম্বনা করতে গেল রবি?  তাই হয়তো মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনেও তুমি ছুটে গেলে না তাকে শেষ দেখা দেখতে। যেদিন এই দক্ষিণের বারান্দায় তোমার হার্ট সার্জারি হল সেদিন আমি দেখতে পেরেছিলাম "গোড়া", "শেষলেখা", "বউ ঠাকুরানীর হাট", "ছুটি" ,"শাস্তি", "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন", "দেনা পাওনা", "চোখের বালি", "রাজর্ষি", "মালঞ্চ", "নৌকাডুবি", "চার অধ্যায়", "দুই বোন" ও যেই কাব্যের জন্য তুমি প্রথম নোবেল পুরস্কার পেলে সেই "গীতাঞ্জলির" উৎস। হ্যাঁ তোমার হৃদয় টিকে দেখতে পেয়েছিলাম। ডাক্তারেরাতো চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিল কিন্তু আমি তো তোমার মাথার উপরে ছিলাম রবি।

আজ আর কিছু চাওয়ার নেই কবি। কিছু বলবারও নেই । কিছু অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। আমি তো তোমার জোড়াসাঁকোর বাড়ির দক্ষিণে বারান্দার একটি অবহেলিত করিকাঠ। আমার অভাব থাকলেও অভিযোগ থাকা কি মানায় তুমি বলো ? বর্তমানে তোমার নাম করে সরকার যেটুকু ধরে রেখেছে সেটুকুর উপরেই ভরসা করে বসে আছি। মাঝে মাঝে যখন এই বাড়িতে এখনো গানের আসর বসে , যখন নাটক হয় সেদিকে কান পেতে রই হয়তো গানের মধ্যে থেকে আমার রবির গলা শোনা যাবে।  হয়তো সে বলে উঠবে, "  এ কী এ, এ কী এ, স্থির চপলা!
          কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা!
                      কী প্রতিমা দেখি এ,
                        জোছনা মাখিয়ে,
                   কে রেখেছে আঁকিয়ে,
                     আ মরি কমল-পুতলা! "
বাল্মিকী প্রতিভার সেই শ্লোক তোমার কন্ঠে আমি কতবার যে তন্ময় হয়ে শুনেছি। লিখে গেলাম আমার এই অভিজ্ঞতা চোখে দেখা কানে শোনা কিছু চিত্র যেগুলো হয়তো অনেকেই জানে না। জানি এই লেখাগুলো কখনো কারো চোখে পড়বে না তাও লিখে গেলাম রবি।
যেখানেই থেকো ভালো থেকো তুমি।
তুমি আজও আমাদের সেই ছোট্ট রবি হয়েই আছো।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিও রবি।
                                       
                                 ইতি
                              তোমার দক্ষিণের বারান্দার কড়িকাঠ 




আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri