সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
29-September,2024 - Sunday ✍️ By- সঙ্গীতা মোহান্ত 120

ক্ষুদ্র কথা/সঙ্গীতা মোহান্ত

ক্ষুদ্র কথা
সঙ্গীতা মোহান্ত 

------- অনু , চা করবি কখন !
 বড়দা ভাইয়ের ডাকে অনুসূয়ার ঘুম ভাঙল।  গোধূলির কমলা রঙের একফালি  আলো জানালা দিয়ে এসে বিছানার কোণা দিয়ে  অনুসূয়ার পা ছুঁয়েছে ।  
কিছুক্ষণ সেদিকে সে তাকিয়ে রইল। আঙুলগুলো ধীরে - ধীরে নাড়াচাড়া করে অন্যমনস্ক ভাবে । সাদা ফ্যাকাসে রোয়া ওঠা পায়ের পাতা।  শিরা- উপশিরাগুলো শক্ত হয়ে জেগে উঠেছে। উনুনের আঁচ লাগা, রোদে পুড়ে যাওয়া  হাতের পাতা দুটো মেলে মনের খেয়ালে এপাশ - ওপাশ করে দেখে। 
শিক্ষকতা থেকে প্রায় আট বছর  হলো অবসর নিয়েছে সে । তাই বয়সের ভারও নেহাত কম নয়। তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ কড়িকাঠের দিকে।
শোওয়া থেকে উঠে, অবসন্ন শরীরটা নিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে যায়। 

উত্তরবঙ্গের বহুজনবিদিত প্রাচীন এই জরাজীর্ণ  আশ্রমে দক্ষিণের দুটো ঘরের একটাতে সে আর পাশেরটাতে তার বড়দা ভাই থাকে । ভেতরদিকে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার এক কোণে রান্নাঘর।  উঠোনের ডানদিকে বুড়ো শিউলি গাছটার গা  ঘেঁষে যে ঘরটা, সেখানে ছোটো ভাইয়ের বিধবা বউ। 

 দাদামশাইয়ের ফলাও ব্যবসা আর  তার মা উমাশশীর অপরুপ রুপের কারণে উত্তরবঙ্গের এক নামজাদা ডাক্তারের সাথে  পনেরো বছরের উমাশশীর বিয়ে হয়েছিল। কান পাতলে শোনা যায়,লাল টুকটুকে গোলগাল উমাশশীকে নাকি দাঁড়িপাল্লায় ওজন করিয়ে যত কেজি হয়েছিল, তার দ্বিগুণ ভরি সোনার গয়না দিয়েছিলেন উমাশশীকে তার বাবা। কোলকাতা থেকে পাচক  ঠাকুর, ভিয়েন নিয়ে এসে নিমন্ত্রিতদের তৃপ্ত করেছিলেন। 
এরপর উমাশশীর কোল জুড়ে একে - একে পাঁচটি সন্তান। অনুসূয়ার আগে দুই পুত্র, একটি কন্যা সন্তান।  অনুসূয়ার পরে এলো আরেকটি কন্যা সন্তান। 
তবে ধীশক্তিসম্পন্ন অনুসূয়া ছিল তার পিতার সর্বাধিক প্রিয়।
 একটি মধুর সঙ্গীত শ্রবণে মনে যে আত্মতৃপ্তির জন্ম দেয়, অনুসূয়ার সৌন্দর্যদর্শনের উপাখ্যানও এমনই নান্দনিক।
স্বামী - সন্তান, উপচে পড়া বৈভব নিয়ে উমাশশীর সংসার বহমান  সুখের নদী।  

এহেন উমাশশীর সংসারে ভাঙন এসেছিল।    
 এক সাধুবেশী মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন   ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। আত্মপরিচয় কি দিয়েছিলেন, কি কথা হয়েছিল; বহির্জগতে তা  অজ্ঞাত রয়ে গেল। তিনি কে ছিলেন, কোথা থেকে এসেছিলেন ; সে বিতর্ক আজ থাক।  তবে উমাশশীর সংসার যে সে রাতে উজার হয়েছিল ; তা হলফ করে বলা যায়। দুর্যোগের প্রথম ছোবল।  উমাশশী সেদিন রাজরানী থেকে ভিখারিনী হয়েছিল।  তাদের  বিষয় - সম্পত্তি, জমি - জায়গা,ঘরের সর্বশেষ সোনার দানাটুকুও তার স্বামী উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন , একদিনে -একবেলায়।  এমনকি তিনি  নিজেও চিকিৎসকের পেশা থেকে অব্যাহতি নিয়ে সেই সাধুবেশী মানুষটির ব্যাক্তিগত সচিব রুপে ছায়াসঙ্গী হলেন।
দুটো কাঁসার থালা লুকিয়ে রেখেছিল উমাশশী। ছেলেমেয়েগুলো খাবে কিসে ! হয়ত এই ভেবে। তার স্বামী দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, 'তুমি ওই  থালা নিয়েই থাকো , আমাকে আর কোনোদিন পাবেনা"। ভয় পেয়ে উমাশশী তারাতারি তা বের করে দিয়েছিল। কিন্তু তাও উমাশশী তার স্বামীকে আর কোনোদিন পায়নি, নিজের করে। 

সে হিড়িকে দান হয়ত অনেকেই করেছিলেন। তবে এমন সংসার উজার করা উৎসর্গ  সে সময় আর কেউ করেনি । উমাশশীর স্বামী সেদিন  কোনো ক্ষুদ্র চিন্তায় মনোনিবেশ করেননি। স্ত্রী, পাঁচ- পাচটি সন্তান ; এই সাধারণ থেকে সাধারণ ভাবনাগুলো তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলেনি। 
উমাশশীর ঐ প্রতাপশালী পিতা পরদিন  জানতে পেরে দরজা বন্ধ করে বুক চাপড়ে আর্তনাদ করতে -করতে বলেছিলেন , আমার সোনার উমা এবার পুড়ে ছাই হবে"।
শ্রীরামচন্দ্র যেদিন বনবাসে যায়, দুঃখে কাতর হয়ে রাজা দশরথের মৃত্যুর কথা ইতিহাসে বর্ণিত কিন্তু সীতার পিতা জনকরাজের সেদিন কি হয়েছিল, তার খোঁজ কেউ নেয়নি । 

উমাশশীর শ্বশুরবাড়ি যে শহরতলিতে,  তার পাশেই এক শহরতলিতে কিছুদিনের মধ্যে  প্রকান্ড এক আশ্রম তৈরী হলো। উমাশশীর স্বামী তাঁর স্ত্রী - সন্তানদের নিয়ে আশ্রমে এসে উঠলেন। নিজের পৈতৃক ভিটেরও হয়ত স্বত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন।  তার কারণও জানা যায়নি।  সাবেকি বাড়ির অন্তঃপুরের কথা সাধারণের কাছে অজানাই থাকে চিরকাল। সাধারণ মানুষ শুধু নিজেদের কিছু কল্পকাহিনী একে অন্যের সাথে আলোচনা করে, মনে শান্তি অনুভব করে। 
প্রতিদিন কয়েক শত লোকের পাত পড়ে সেই  আশ্রমে।
তবে উমাশশী কোনোদিন সেখানকার খাবার মুখে তোলেনি, এমনকি নিজের ছেলেমেয়েদেরও খেতে দেয়নি। বড়ছেলেটা তখন  ষোলো বা  সতেরো। আর একদম ছোটো মেয়েটির বয়স সাত কি আট।  ছেলেমেয়েরা সবাই বিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রী। ওখানে সবাই নতুন করে স্কুলে ভর্ত্তি হয়।  রোজ বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে বইখাতা নিয়ে যেত। ফিরে আসত  বইখাতা হাতে নিয়ে। ওদের ব্যাগে থাকত সরকার থেকে গরীব মানুষের জন্য বরাদ্দ খুদকুরো।  তবে সবাই জানত, এরা ডাক্তারবাবুর ছেলেমেয়ে। সেই সুবাদে লাইনে দাঁড়িয়ে  ওই ভাঙা চাল একটু হলেও বেশি পেতো তারা।  সেই খুদ  নিয়ে এলে উমাশশী তা জ্বাল দিয়ে ছেলেমেয়েদের দেয়, নিজেও খায়। জলে নেমে শাপলা, কলমি তুলে নিয়ে আসে ছেলেমেয়েরা। ভাতের সাথে তাও সে সেদ্ধ দেয়, আর মনে - মনে উপায় খোঁজে। পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচবার উপায় খোঁজে। দুর্যোগ তাদেরকে সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছে। স্পন্দন এই বুঝি স্তব্ধ হয়। 
 সে ছেলেমেয়েদের এক - এক করে  একেক আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রিত করে রেখে এলো । কাউকে তাদের কাকা - কাকীমাদের কাছে , কাউকে তাদের বিবাহিত পিসিদের কাছে। এর 
কিছুকাল পর উমাশশী চতুর্থ কন্যাটিকে দিয়ে  এলো তার বাপের বাড়ি।  সেখানেও সদস্যসংখ্যা নেহাত কম ছিলনা। পিতার বয়স বেড়েছে।  স্বজন এবং র্আশ্রিতদের যৌথ উদ্যোগে তাদের পৈতৃক ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার মুখে। 
উমাশশী মাঝেমাঝে বাপের বাড়ি এসে, সেখানে  নিজের অবস্থান- কাল দীর্ঘ করে। অর্থাভাব এবং খাদ্যাভাব নিয়ে বিবাহিত মেয়েদের দিনের পর দিন বাপের বাড়ি আসা যে খুব একটা সুখকর হয়না, তা বলা অনাবশ্যক। উমাশশীরও অন্যথা হয়নি। 

অনুসূয়া তার মামাবাড়িতে এসে সেখানকার স্কুলে দশম শ্রেনীতে ভর্ত্তি হলো। 
উমাশশীর বাকী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় তেমন একটা অগ্রগতি না হলেও, অধ্যবসায়, জেদ এবং  একাগ্রতা অনুসূয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।  দু"বছর পর অনুসূয়ার মামাবাড়িতে নির্দেশ জারি করা হলো, 'আর বেশিদিন টানা যাবে না"।  তার ভাতের থালায় টান পড়ল।   ঠাঁই বদল হলো। তবু তার একাগ্রতার বদল হলোনা।  অন্য এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠল। ক্রমে,বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স এবং এরপর  ব্যাচেলর অব টিচিং ডিগ্রি নিয়ে  শিক্ষকতায় যোগদান করলো সে।
এর কিছু বছর আগেই আশ্রমের স্বামীজি তাঁর ঠিকানা বদলেছেন।  আট থেকে নয় বছর উত্তরবঙ্গে থাকবার পর মূল আশ্রম নিয়ে  তিনি চলে গেছেন উত্তরাখন্ডের নিবিড়, কলরবহীন পাহাড়ি উপত্যকায় ঘেরা এক সবুজ বনানীতে।  সাধুবাবার সাথে  চিরকালের মতো চলে গেছেন উমাশশীর স্বামী। যাকে হারানোর ভয়ে বুকের ভেতর হিমস্রোত প্লাবিত হতো, তাঁকে ছাড়াই আমৃত্যুকাল বেঁচে থাকল উমাশশী। 
উনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বড় মেয়েকেও। 
কয়েক বছর পর উমাশশীর কাছে তার বড়মেয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে।

 অনুসূয়া উমাশশীর কাছে স্থায়ী ভাবে আশ্রমে ফিরে এলো। ওখানেই মেয়েদের একটি  সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে তার চাকরি হয়েছে। ভাইবোনদের কাছে নিয়ে এলো। 

দেখুন, আরেকটা কথা তো বলাই হল না!
এই সবকিছুর মধ্যে বিধাতা পুরুষ একটি কাজ নিখুঁত ভাবে  করে ফেলেছিলেন। 
তিনি অনুসূয়ার বুকের ভেতর এমন একটি  মনকে খাপে - খাপে বসিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে শুধু স্বীয় স্বার্থ ত্যাগের কথা, মানবিকতার কথা লেখা আছে। কর্তব্য,  কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা লেখা আছে। 

সংসারও তাকে নিজের কথা ভাববার ফুরসত দেয়নি। উমাশশী আমৃত্যুকাল চোখে হারাতো তার এই কর্মরতা, কর্তব্যপরায়ণ  মেয়েটিকে। সবারির সংসার গড়ে দিতে - দিতে নিজের ভালোলাগার মানুষটির কথা সে মুখ ফুটে কখনো বলতে পারেনি তার অতি আপনজনদের কাছে।  আমলও দেয়নি কেউ।
বুঝে, না বুঝি করে থেকেছে সবাই। 
সে মানুষটিও তো অপেক্ষা করতে - করতে আজ বৃদ্ধ। কারোরই বলা হলোনা।  অথচ, জানত দুজনেই । 
( পরিশেষে, মার্জনা চাইছি বিদ্বজ্জনদের কাছে। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ সব তর্ক- বিতর্কে, এইরূপ ক্ষুদ্র চিন্তায় ক্ষুদ্র কিছু কথা লেখার জন্য। )

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri