ক্ষমা করো প্রভু/শ্যামলী সেনগুপ্ত
ক্ষমা করো প্রভু
শ্যামলী সেনগুপ্ত
বেথেলহেম এর গীর্জায় আর যশোহর জেলায় জন্ম, কলকাতায় পড়াশুনো এবং কর্মক্ষেত্র ওড়িশার কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের কবিরাজবাবুর ঘরের জানালায় ঘন্টা বেজে উঠত একসঙ্গে ... ডিং ডং, ডিং ডং ... সেই ধ্বনি সামনের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের ওপর দিয়ে,গহীন গভীর জলের বাঁধ (পুকুর) পেরিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসত মাটির ঘরে। নিকোনো মেঝের ওপর রাখা ফুলদানিতে বেশ বড় বড় চন্দ্রমল্লিকা, হলুদ ও শাদা। সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে আমার মা বাগান থেকে তুলে এনে সাজিয়েছেন। দেওয়ালে ঝোলানো যীশুখ্রীস্টের কাঠের মূর্তি। বাবার সাঁওতাল পেশেন্ট উপহার দিয়েছিলেন কখনো। এখন তাঁর সেই অবয়বের সামনে ধূপের ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। আমরা ভাইবোনেরা উষ্ণ জলে স্নান সেরে ধোয়া পোশাক পরে প্রস্তুত। আরেকটু পরে মা, বাবার সঙ্গে আমরা স্থানীয় গির্জায় যাব। আমার বাবা আধ ঘন্টার বেশি থাকতে পারবেন না। পেশেন্টরা এসে যাবে। আমরাও বাবার সঙ্গে ফিরব। আমাদের উপহারের প্যাকেটে সোয়েটার বা মোজা অথবা স্কার্ফ কি কম্ফর্টার, যার যেটা প্রয়োজন। নাগপুরের বড়ো বড়ো মিঠেল কমলালেবু আর ফ্রুট কেক। এসব পাশের শহর রায়গড় (ছত্তিশগড়) থেকে বাবা কিনে এনেছেন।
আসলে তো উৎসব। প্রভু যীশুর জন্মদিন মানে বড়দিন আর সেটা ছিল বড়দিনের উৎসব। আমরা তো ভুলে গেছিলাম যে, আমাদের রিলিজিয়নের জায়গায় 'হিন্দু' লেখা হয়। সব ধর্মের প্রবর্তকগণ আমাদের পূজ্য, এটাই জানতাম। তাই, বড়দিনের ক্যারল ও কেক দুইই আমাদের কাছে উৎসবের অঙ্গ ছিল। ধর্ম নয়।
তোমাকে যেমন যীশুখ্রীস্ট রূপে জানি, তেমন জানি ঈসা মসীহ নামে। কোনও ধর্ম প্রবর্তক বা প্রচারক নয়, একজন মানুষ হিসেবে তোমার অনিন্দ্য মূর্তির কাছে নত হই। নত হই মানবতাবাদের কাছে।অথচ দেখ, এত এত বছর পেরিয়ে গেল তোমার জন্মের পর। তোমার নির্দয় বীভৎস হত্যার পর কত কত বছর গড়িয়ে গেল উন্নততর প্রযুক্তির দিকে, সময় বদলে গেল, শুধু বদলাল না মানব চরিত্র। তেমনই ঈর্ষা, দখলদারির প্রবণতা, অন্যকে তাচ্ছিল্য করা, ঘৃণা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব সব সেই আগের মতো। থেকে গেল আধিপত্যবাদ। এসব যেন প্রাচীন কাল থেকে বয়ে চলা এক নদীর স্রোতের মতো।
সেই স্রোতে ভেসে যায় আপাত যা ভালো। শুধু ভেসে যায় না মানুষের মনের মলিনতা। বদ্ধ জলাশয়ের শ্যাওলাঘন জলের মতো মানব অলিন্দ-নিলয়ে বুড়বুড়ি কাটে আর হৈ হৈ করে মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে নেমে পড়ে নিজেদেরই তৈরি করা রণাঙ্গনে।কোথায় আর তোমার বাণী অনুসরণ করলাম বলো!
তবু শীত এলে জানি বড়দিনের উৎসবে মেতে উঠব আমরা। বাজার জমে উঠবে কেক, কমলালেবু আর শীতের পোষাকে। তোমাকে কেন্দ্র করে উৎসবের আগের রাতে সাজানো হবে ক্রিসমাস ট্রি, যার উপরে ঝকঝক করবে একটি তারা। মোজা ঝোলানো হবে পেলমেট-এ। দরজার সামনে ঘন্টা ঝুলবে।আমরা অনেকেই ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে শুয়ে স্লেজগাড়ি আর বলগা হরিণের স্বপ্ন দেখব,
ফুটপাথের বাসিন্দা, ক্ষুধার্ত শিশু আর সীমান্ত পেরিয়ে আসা ধর্মযুদ্ধের বলি হয়ে যাওয়া মানুষদের কথা ভুলে।
তুমি আমাদের ক্ষমা করো প্রভু।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴