কুরুক্ষেত্র বিমল দেবনাথ
কুরুক্ষেত্র
বিমল দেবনাথ
১
গাদাবন্দুকে বারুদ ঢোকাতে ঢোকাতে কালা কার্জি বলে, ফুলিয়া তোকে কিতনা কহবু ডোঙ্গা ফুটাইক নি লাগি, ময় তোর সব জিম্মা লিব। মোর বাত নি শুনিশ। ইখন বুঝ, বাবুমানেক নজরমে পড়লে…
রতনদের চিৎকারে পাথর ভাঙ্গতে থাকা মানুষগুলো এক পাল চিতল হরিণের মতো ছুটে বনে ঢুকে যায়। ফুলিয়াদের ছুটে আসতে দেখে রতিয়া, অগ্নু, ভিনসাই, মনিরাম, শুকবাহাদুর, যসিন্তা, রত্নিরা কুড়ি পঁচিশ জন কাঠ কাটা বন্ধ করে দেয়। ফুলিয়া কালা কার্জির পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে। ভিনসাই মাটিতে ফেলে রাখা তির ধনুক তুলে নেয় হাতে। মনিরাম খাপ থেকে ভোজালি বার করে। যসিন্তারা শাল গাছের মতো কালাদের আগে এসে দাঁড়ায়। ওরা যেন কালাদের শিখন্ডী। কালা হাতের গাদাবন্দুক আকাশের দিকে তাক করে ফায়ার করে। অগ্নু হাতের গাদাবন্দুকটা এগিয়ে দিতে গেলে কালা মানা করে। সেটা এখন আর ফাটাবেনা। বন্দুকের গুলির শব্দে জঙ্গল কেঁপে ওঠে । ফুলিয়া কালাকে জড়িয়ে ধরেছিল ভয়ে। গুলির শব্দ মিলিয়ে যেতেই কালার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরে। সে আগুন বন্দুকের গুলি থেকেও ভয়ানক। ঝলসে যাওয়ার আগে ফুলিয়া সরে যায় কালার পাশ থেকে। ফুলিয়া জানে এই এলাকায় কালার অনেক মেয়েছেলে আছে। এসব কথা হাওয়াতে ভাসে। কেউ ধরতে পারেনা, কিছু বলতে পারেনা। নিজের বউটা রাতের নানা অত্যাচরে এবং বাচ্চা বিয়োতে বিয়োতে কুড়িতে বুড়ি হয়ে গেছে। এখন আর পেরে ওঠেনা। কালার কাছে যে সকল মেয়েরা এসেছে, হয় ঝলসে গেছে না হয় হারিয়ে গেছে চিরতরে। কেউ কেউ অনেক দিন পর ফিরে আসে রঙিন পাখি হয়ে। তখন কালাপানির চরে উদম আসর বসে। গুলির শব্দ থিতিয়ে যেতে সবাই আবার যে যার কাজে লেগে যায়। কেউ কাটা কাচা সেগুন গাছকে টুকরো করে। কেউ তবল দিয়ে টুকরগুলোর চার পাশ ছুলে লম্বা ব্লক বানায়। ব্লক কাঠের বাজারে দাম বেশি। কেউ বেশি মোটা, বেশি সরু টুকরোগুলো কুড়াল দিয়ে চেলাকাঠ করে। জ্বালানী করবে। ঘোর বর্ষায় কাজে লাগবে। আজকের কাটা গাছের কাঠ বিক্রি করে রতিয়ার ছেলের শ্রাদ্ধ শান্তির টাকা সংগ্রহ করা হবে। গ্রামের সবাইকে দই চিড়া খাওয়াবে। তারপরে হবে শোক ভোলান ফাক্সা ভাত, হাড়িয়া খাওয়া। আগে এই খাওয়ার প্রচলন ছিলনা। বাবুদের আড়ম্বরের মৎসমুখী দেখে ওরাও শুরু করেছে। সংস্কৃতি যত বয় তত চওড়া হয়, বিস্তার লাভ করে। রতিয়ার ছেলের শ্রাদ্ধ শান্তির পর কালাপানি নদীকে পূজা দিতে হবে। শিশুটাকে কালাপানির কালো জল গ্রাস করে। গ্রামের গোসাই বলে দিয়েছে। না হলে নদীটা ডাইনি হয়ে যাবে। নদী ডাইনি হলে খুব মুশকিল। মানুষ ডাইনি হলে মেরে ফেলা যায়। নাদীকে তো মেরে ফেলা যাবেনা। এই নদী আবার ভুটানের কালাপানি থেকে আসে। সেখানে কী যে আছে কে জানে। কালো জলের সঙ্গে কালো কালো পাথরের গুড়োও আসে। সে গুড়োর খুব চাহিদা। সে গুড়ো বিক্রি করে কালারা বেশি টাকা লাভ করে। নদীটাকে ডাইনি বানানো যাবেনা। তার জন্য গোসাই যা বলে তাই করতে হবে। দরকার হলে নরবলি দিতেও রাজি কালা। এই সব কিছুর খরচ করার পরে যেটুকু টাকা বাঁচবে সব কালার। আর কেউ কিছু পাবেনা। সবাই কে হাউলি (বেগার) খাটতে হবে। কালা আজ তাই বিনা পারিশ্রমিকে যতটা সম্ভব বেশি কাঠ কাটাতে চায়। সবাই কাঠ কাটে কালা বসে শুধু ফুলিয়াকে দেখে। ফুলিয়াকে চোখে ইশারা করে জঙ্গলের আড়ালে যেতে। কালা জানে মেয়েরা রাজি না হলে নদীতে জল আসেনা। শুকনো নদীতে কি স্নান করা যায়?
ফুলিয়া কালার চোখের ভাষা বোঝে। চাবাগান ও বনে কম পুরুষ দেখেনি সে। দেখেছে বাগানের বাবুদের, সাহেবদের। দেখেছে বিট অফিসের বিট বাবু ও স্টাফদের। সবাই কেমন করে যেন দেখে ফুলিয়াকে। ও যেন ফল। কখনও ডালিম, কখনও পেয়ারা, কখনও আম, কখনও … ফুলিয়ার মন রাগে রি-রি করে। রাস্তায় দেখা হলেই এরা অদ্ভুত ভাবে তাকায়, হাসে। সুযোগ পেলেই তোষামোদ করে পাশে আসতে চায়। কেউ কাজের কথা বলে না। পাথর ভাঙ্গার দলে কাজ করে। আসল কথা বলেনা। খালি ফল খাবার লোভ, গাছ লাগানোর কথা বলেনা। সবাই এসব কেন করে ফুলিয়া সব বোঝে। বাতাস কানে কানে সব সময় বলে ফুলিয়া তোর মতো সুন্দরী এই তল্লাটে আর কেউ নেই। অভাবেও তোর শরীর অপুষ্ট নয়। গরিব মানুষের মনের পুষ্টিকর খাদ্য পরিশ্রম । তুই কত পরিশ্রম করিস। যৌবনে হাওয়া খেলেও শরীরের গঠন গড়ন খুব সুন্দর হয়ে ওঠে। ফুলিয়া কখনও নিজের শরীর নিজে এক সঙ্গে দেখতে পায়না। পুরুষ মানুষের দৃষ্টি আর সহচারীদের হিংসাতে বুঝতে পারে সে খুব সুন্দরী। কিন্তু বিয়ের ফুল ফোটেনা। গরিব বাবা মায়ের অক্ষর জানা মেয়ের মনে হয় সুন্দরী হওয়াটা অন্যায়। সবাই চিতাবাঘ, বাঘের মতো তাকায়। ফুলিয়া এই প্রথম এক জোড়া চোখ দেখল। কালাদের মতো নয়। গাছের পাতার মতো। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল অপলক। কোন রাগ নেই, কোন হিংস্রতা নেই। কোন কিছু চাওয়ার নেই। কোন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই। শধু যেন দেখাতে আনন্দ। তবুও কেন যে কালা বলছিল, বিটে নতুন বিট বাবু এসেছে। প্রথম সাক্ষাতে ওকে কালা পানির কালা জল খাইয়ে দিতে হবে। না হলে মাথায় চড়ে বসবে। তাহলে কী সেই মানুষটা নতুন বিট বাবু? হতে পারে, কালাদের কাছে সব খবর থাকে। ফুলিয়ার মনে হয় এই মানুষটাও ওর মতো। ভুটান পাহাড়ের গা ঘেঁষে রেতি নদীর উজানে নীল পাহাড়, সবুজ চাবাগান, বন আর রেতির প্রসস্ত বুকে সূর্য যখন ডোবে করম ঠাকুর কী সুন্দর আলপনা আঁকে। ফুলিয়া অবাক হয়ে শুধু দেখে সেই আলপনা । কোন কিছু চায়না। প্রতি বর্ষায় রেতির বানের মতো তারও যৌবন বয়ে যায় তাও করম ঠাকুরের কাছে পর দিন সকালে কোন নতুন খবর আসুক চাইতে ভুলে যায়। সূর্য ডোবার দৃশ্য এমন সুন্দর যে রেতির উজানে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। ফুলিয়া মনে মনে হেসে ওঠে। ভাবে, বাবুটা ভাবছে আমি ওকে দেখতে পাইনি। আমি বাবুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেছি। বাবুটা কী সুন্দর দেখতে! বাবু কি জানে মেয়েদের চোখ হরিণের মতো। ওরা কাজ করতে করতেও দুপাশে দেখতে পায়।
২
এখন চাবাগানের কাজকর্ম অনেক কমেছে। বন্যায় বনের যেমন ক্ষতি হয়, ক্ষতি হয় চাবাগানের, চাষের জমির। এই বন, এই নদী যেন এই বনের চার পাশের মানুষের গচ্ছিত সম্পদ। কোন উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য টাকার দরকার হলে এই বন এই নদী যেন টাকার জোগানদার। কিছু ছেলে আছে খুব খতরনাক। সারা দিন নেশা করে থাকে। অনেকে মদ, হাড়িয়া খেলেও এই ছেলেগুলো কী যে নেশা করে বোঝা যায়না। কেউ কেউ বলে কী যেন একটা ট্যাবলেট খায়। প্রত্যেকের সঙ্গে কোনা না কোন অস্ত্র থাকে। কার সঙ্গে ভোজালি, কার সঙ্গে চপার, কার সঙ্গে কুড়াল। মোড়লদের কাছে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র। এখানে গাছের দাম আছে, বালির দাম আছে, পাথরের দাম আছে; মানুষের দাম নেই। মাঝে মধ্যে রাস্তায়, নদীতে, চাবাগানে এবং জঙ্গলে মানুষের লাশ পড়ে থাকে। কার লাশ কেউ বলে না। পুলিশ তদন্তে এলে কেউ সাক্ষী হতে চায়না। কোর্টে যাতায়েতের খরচা অনেক। এক দিনের আয় বন্ধ। পরদিন খাবে কী? ঝামেলায় কেউ জড়াতে চায়না। কেউ আবার সব জেনেও চুপ করে থাকে খুনের প্রতিশোধে খুন করতে। আবার লাশ পড়ে। তারপর আবার লাশ…। এদের মধ্যে পড়ে গেলে আমাদেরও লাশ পড়ে যেতে পারে।
রতন কাঠের গুড়ির ওপর একটা পা তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে থাকে। বিরুৎ কথাগুলো শুনতে শুনতে অবাক হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে। বিকালের সূর্য চাবাগানের ছায়া গাছের কাঁধ ধরে ঝুলছে। তির্যক রশ্মি তিরের মতো বিদ্ধ করছে বিরুৎএর শরীর ও মন। রতনের অঙ্কীয় অঙ্গ অন্ধকার। তার ছায়া ক্ষণে ক্ষণে লম্বা হয়ে ছুঁতে চায় পূর্ব দিকের রাস্তা। গাছগুলোকে মনে হচ্ছে কেউ কৌরব কেউ পান্ডব। স্টাফরা কেউ যুধিষ্ঠির কেউ দুর্যোধন। বনে কখন কে কৃষ্ণ কে অর্জুন ঠিক থাকেনা। বিরুৎএর মনে হলো স্টাফ গুলো যেন কেমন হয়ে গেল। গুলির শব্দ পেয়েও নির্বিকার। এড়িয়ে চলে যেতে চায় বনের ক্ষত।
রতন আবার বলতে শুরু করে, আমি এই এলাকায় ঘুরেফিরে পনের বছর আছি। এখানকার মানুষের নাড়ি নক্ষত্র জানি। অনেক লাশ দেখেছি। উন্মত্ত দুর্বৃত্তের হাতে বিট অফিসারকে হেনস্তা হতে দেখেছি। জামার বোতাম খুলে বুক দেখিয়ে বলে, দেখুন এই কাটা দাগ, ভোজালি দিয়ে মেরেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। মরতে মরতে বাঁচার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এখন চলুন, ব্যাপারটা পরে দেখা যাবে। গাছতো সোনা রূপা নয় যে গোপন করতে পারবে। শিকার করলেও মাংস হজম করতে সময় লাগবে। আজ আপনার জঙ্গলে প্রথম দিন, কোন অঘটন হোক আমরা চাইনা। প্রথম দিন ওদের কাছে মার খেলে বা ওদের আক্রমণে পালাতে হলে এই বিটে যত দিন থাকবেন মাথা নিচু করে থকতে হবে। বিট বাবুর পালানোর খবর কালাপানির কালো জলের মতো ছড়িয়ে পড়বে চার দিকে। বদনাম নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের। অবশ্য সেটাও আস্তে আস্তে সয়ে যাবে। চলুন রাস্তা দিয়ে ফিরে যাই। সবাই রতনকে সমর্থন করে।
বিরুৎএর ‘যাহা রটে তাহা কিছুটা হলেও ঘটে’ প্রবাদটা একদম সত্যি মনে হয়। এতদিন এটাকে একটা প্রবাদ হিসাবে ভাবত। এখন যা ঘটছে তা দেখে বিরুৎএর মনে হলো, যাহা রটে তাহা সম্পূর্ণ ঘটে। চাকরিটা হয়ে যাবার পরে বন্ধুরা কত কথা বলেছিল। বিরুৎ সে সব উড়িয়ে দিয়েছিল, গুজব বলে। বিরুৎ অবাক হয়ে যায় রতনরা কী ভাবে এত নিরুত্তাপ থাকতে পারে। একটা গুলির আওয়াজ হলো তবুও বনের ভেতরে ঢুকতে চায়না। তাহলে কি রতনরা এসবের সঙ্গে যুক্ত? বিরুৎএর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। বলে, এই বনের দেখভালের দায়িত্ব আমার। প্রথম দিনই দায়িত্ব এড়িয়ে যাবো? এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। চল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাব। কী হচ্ছে দেখে তবে অফিসে ফিরব। বিরুৎ আর একটা প্রবাদ জানে, বিড়াল প্রথম রাতে মারতে হয়। এই ভয়ের বিড়াল সে প্রথম দিনই মারতে চায়।
বনের ভেতর থেকে কাঠ কাটার নানা শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ চলছে। ভয়ানক যুদ্ধ। রতনের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। ও বুঝে যায় নতুন বিট বাবু কারও কথা শুনবেন না। ওনার যা ভাব উনি বনের ভেতর দিয়েই যাবেন। কুড়ি বছরের অভ্যাস, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে চলার। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শিশুরা কি আগুনে ভয় পায়? বড়রা পায়। সব জেনে শুনে আগুনে ঝাপ দেওয়ার অর্থ আত্মাহুতি। আত্মত্যাগ। আবার এক বার মরণকে জড়িয়ে ধরতে ঝাঁপাতে হবে। অকুতোভয় স্টাফগুলো পা টিপে পা টিপে এগুতে থাকে। ওরা জানে যে রকম শব্দ ভেসে আসছে তাতে কাঠ কাটার দলটা বেশ বড় হবে। তবে কার দল বলা মুশকিল। জঙ্গলের চার পাশ থেকে অনেক মানুষ দল বেঁধে ঢোকে। কালার দল হলে এবার দেখে নিতে হবে। বনের ভেতরে পেলে এবার ‘এসপার ওসপার’ হবে। শালা বনের বাইরে বেশ তেজ দেখায়। একবার পাশের বিটের আর্মড পুলিশ নিয়ে এসে বনে কালাকে ঘেরাও করে ফেলেছিল রতনরা। কালার পাত্তা পাওয়া যায়নি। কালা নাকি হনুমান মন্ত্র জানে। হাওয়ায় উড়ে চলে যায়। এবার ইচ্ছা ছিল নতুন বিট বাবুকে নিয়ে ওর বাড়িতে অপারেশন করবে। বনের মধ্যে অসম লড়াইয়ে কী হবে কে জানে। শোনা যায় কালা জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে ঢোকে। রতন নিজের বন্দুক দেখে। নতুন বিট বাবু আসার আগে তেল দিয়ে ঘষেমেজে ঝকঝকে করেছে। কার্তুজ মাত্র চারটা। রতনের মনে হয় সঙ্গে আর একটা বন্দুক হলে ভাল হতো। দুষ্কৃতীদের কাছে তির ধনুকও থাকে। ওদের দলটাও বড় হয়। রতনদেরকে দুষ্কৃতীরা দেখে ফেললে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। দুষ্কৃতীরা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পজিশন নিয়ে নেবে। রতনরা প্রথমে ওদের দেখলে হিসাব মতো গাছের আড়াল নিয়ে এগুতে পারবে। আক্রমণ করতে সুবিধা হবে। এমনিতে বনের ভেতরে সব পরিষ্কার দেখা যায়না। তখনও কাঠ কাটার শব্দ ভেসে আসছে। এক জনের পাশে আর এক জন হাঁটছে। রতন শুধু নতুন বিটবাবুকে তার পেছনে রেখেছে। হাওয়ার মতো ফিস ফিস করে বলে তার পায়ে পা ফেলে হাঁটতে। তাহলে শব্দ কম হবে। বিরুৎ দেখে পাঁচটা স্টাফ দশ-বার ফুটের ফাইল করে হাঁটছে কিন্তু তেমন কোন শব্দ হচ্ছেনা। বিরুৎ রতনের পায়ের ছাপে পা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কার পায়ের ছাপে পা ফেলে হাঁটা বেশ কঠিন। অতি সাবধানতার জন্য মাঝে মধ্যে শব্দ করে ফেলে। রতন কটমট করে তাকায়। যুদ্ধে ক্ষেত্রে যে লিড করে সেই সিনিয়র। বিরুৎ কিছু বলেনা। অনেকক্ষণ হাঁটার পর রতনরা আর কাঠ কাটার শব্দ পায়না। রতনরা খুব সাবধানী হয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে পড়ে। বনের ভেতরে কাউকে দেখতে পায়না। রতন শেষ বারের মতো বলে, পেট্রোলিং বন্ধ করার জন্য। ওর গতিক ভালো লাগছেনা। অর্বাচীন বিরুৎ পেছনে হাঁটতে চায়না। ওরা আবার হাঁটতে থাকে। অকুস্থলে পৌঁছে দেখে পাঁচটা সেগুন গাছ কাটা হয়েছে। আশেপাশে কোন লোকজন নেই। রতলের দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হচ্ছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে কারা যেন ওদের দেখছে। রতনরা দেখতে পাচ্ছেনা। একটা গুমট গরম। এতক্ষণ হাঁটার জন্য ঘামে ভিজে সবাই চপচপ। রতনের নাক গাল থেকে ঘামের ফোঁটা পড়ছে। রতন চারদিক ঘুরে দেখে। তারপর বন্দুক তাক করে গগনভেদী চিৎকার করে বলে, শালারা বেরিয়ে আয়। কথায় লুকিয়ে আছিস? আজ তোদের একদিন কী আমাদের একদিন। কোন উত্তর আসেনা। বনে শুধু রতনের কথার প্রতিধ্বনি ওঠে। রতন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বলে, শালারা টের পেয়ে পালিয়ে গেছে। তারপর বিরুৎকে বলে, স্যার এই কাঠ ডিপোতে নিতে চাইলেও নিতে পারবেন না। তিনটা নদী পার করে মানুষের কাঁধে করে এই কাঠ নিয়ে যেতে যে খরচ পড়বে তা আপনি সরকারের কাছে পাবেন না। কী করে নেবেন? উপরে রিপোর্ট দিয়ে দেবেন।
বিরুৎকে দেখে ঝোপের আড়াল থেকে কালা গাদা বন্দুক তাক করে। ফিসফিস করে ফুলিয়াকে শুনিয়ে বলে- শালা বিট অফিসারকে আজকেই শেষ করে দিব। ওর লাশ কালাপানির পূজায় লাগবে। ফুলিয়া কালার হাত চেপে ধরে। গুলি করতে দেয়না। গুলির আগুন জ্বলেনা, বনের ভেতর কালার চোখের আগুন জ্বলে ওঠে।
৩
সারা দিনের নানা ঘঠনায় বিরুৎ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কোনকিছু পরিষ্কার করে বুঝে উঠতে পারেনি। সন্ধ্যার আগে বিহ্বলতা নিয়ে বন ছেড়ে একটা বনবস্তিতে এসে হাজির হয়। রতন বলে, ঘরে কিছু আছে স্যার? রাতে কী খাবেন। সারাটা দিন কত কিছু ঘটে গেল, রতনের মনে কোন কিছুতে প্রভাব পড়লনা! বন থেকে বেরুতেই খাবারের গল্প। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে বিরুৎএর। বিরুৎ খাওয়াদাওয়ার কথা ভুলেই গেছিল। রতন বলার পর মনে হচ্ছে বেশ খিদে পেয়েছে। পিপাসাও পেয়েছে। রতনরা বনবস্তির পাত কুয়ো থেকে দড়ি লাগানো বাল্টি দিয়ে জল তুলে জল খাচ্ছে। সে সব দেখে বিরুৎএর পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু ‘আর ও’ ওয়াটার ছাড়া… শরীর মনকে বশ করে ফেলে। রতনের পেছনে গিয়ে অঞ্জলি পাতে। ঢক্ঢক্ করে জল খায়। সেই সকালে শহর থেকে আনা বোতলের জল, বিস্কুট আর কেক খেয়েছিল। তারপর আর কিছু পেটে পড়েনি। বনে মনে হয় খিদে কম লাগে। বিরুৎ মুখ গাল গলা কান ধুয়ে নেয়। রতন বলে, এখানে গনেশ সাউএর দোকানে চাল, তেল, নুন, আলু পেঁয়াজ পাবেন। কাঁচা লংকার গাছ আগের বিটবাবু ঘরের পেছনে লাগিয়ে গেছেন। ওটা ফ্রি। এখানে চাইলেও তেমন খরচা করতে পারবেন না। সপ্তাহে চা বাগানে একবার হাট বসে। সেখানেও বেশি কিছু মাল পাবেন না। তবে আমাদের জন্য খুব ভালো। যে টুকু মাইনা পাই অনেকটা বাঁচাতে পারি। পরিবারটা একটু ভাল থাকে। বিরুৎএর মনে হয় রতন ঠিক বলছে। দু’দিনে তেমন খরচ তারও হয়নি। কোলকাতা থাকলে যেটা সেটা কেনাকাটা করে শ’পাঁচেক চলে যেত।
বিরুৎএর রান্নার হাত বেশ ভালো। ভাত আলুর ডাল বানিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। শরীর ক্লান্ত হলেও স্নানের পরে মন ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল। তবুও ঘুম আসেনা। মন পাখির মতো উড়তে থাকে। পাখি কখনও শঙ্কিত কখনও আনন্দিত। বনে কারা কাঠ কাটছিল কিছু বুঝতে পারেনি। এতগুলো গাছ কে কাটল। শহরে হলে এতক্ষন হৈ হৈ পড়ে যেত। সকালে উঠে সব স্টাফকে নিয়ে বসতে হবে। কারা গাছগুলো কেটেছে জানার চেষ্টা করতে হবে। তারপর রেঞ্জ অফিসে গিয়ে কাটা কাঠগুলো আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রতন বলছিল, কাঠ টানার পারিশ্রমিকের যথেষ্ট টাকা সময় মতো পাওয়া যায়না। কাটা কাঠের সঙ্গে যুক্ত হয় নদীতে ভেসে আসা কাঠও। সে সব সময়ে টানা না হলে নিয়ে চলে যায় চার পাশের মানুষ। এই নিয়ে বদনাম ছড়ায়। বিরুৎও কি সেই বদনামের অংশীদার হয়ে যাবে? বিরুৎ ছটফট করে। উঠে বসে বিছানায়। গাছ কাটা পড়া, গুলির শব্দ, বুন হাতির ভয়, খাওয়ার অভাব, আলোর অভাব সব ঠিক আছে। কিন্তু বদনাম!!! না, নেওয়া যাবেনা কিছুতেই। বিরুৎ ভাবে সকালে উঠে চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। টিউশনি করে যা আয় করে তা মাইনের থেকে কম নয়। কেন যে বিভূতিভূষণ পড়েছিল। ‘শালসিঁড়ি’ কিনেছিল। বিরুৎএর বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। ইন্টার্ভিউয়ের কথা মনে পড়ে। ছবিটার কথা মনে পড়ে। ছবির মধ্যে মেয়েটার কথা মনে পড়ে। কী সুন্দর দেখতে। যেন পাথরে খোদাই করা মূর্তি। কোন কামনা বাসন ছাড়া শুধু মেয়েটাকে দেখছিল। ছবি দেখলে কি মনে কামনা আসে? মোনা লিসা’র ছবি দেখলে কি কামনা আসে কার? শুধু দেখতে ইচ্ছা করে। মেয়েটার নাম কী? ওর চোখ দু’টো কেমন? কতক্ষণ ধরে দেখছিলাম। একবারও চোখ তুললনা। রতনের চিৎকারটা তখন রাক্ষসের মতো ছিল। কী সুন্দর ছবিটাকে গিলে ফেলল। মোনা লিসা… মেয়েটা… … মোনা লিসা… মেয়েটা… ভাবতে ভাবতে বিরুৎ কখন গুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। রতনের ডাকে যখন ঘুম ভাঙ্গে, চট করে উঠে হাত ঘড়ি দেখে। তখন নটা বাজে। বিরুৎ রতনের ঢাকে সাড়া দিয়ে বাথ রুমে ঢোকে।
রতন বিট বাবুর বারান্দায় বসে বলে, পাশের বিটে খবর দেন আর্মড ফোর্স পাঠাতে। রেঞ্জে খবর দেন। আজ কুরুক্ষেত্র বাঁধাব। ভোরে গিয়ে দেখে এসেছি, জঙ্গলে ট্রাক ঢুকেছে। খবর পেয়েছি বাগানের লাইনে কালা মালগুলো জমা করেছে। আজ খরিদ্দার আসবে। আজকে শালাকে ধরতে হবে। বিরুৎ অবাক হয়ে যায় রতনের কর্তব্যপরায়ণতা দেখে। স্বতস্ফুর্ত ভাবে ভোর বেলায় চলে গেছে বন টহলে। অথচ রতনদের নিয়ে কত খারপ কথা ভেবেছে! বিরুৎএর লজ্জায় মাথ নিচু হয়ে যায়। বলে, আমাকে ডাকনি কেন? স্যার আপনি সবে এসেছেন। গতকাল কত পরিশ্রম করেছেন। সেতো তোমরাও করেছ। সে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনি চাকরি ছেড়ে না দিলে আপনারও হয়ে যাবে। আমাদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এর থেকে বেশি আয় করার উপায় নেই। তাই বেঁচে থাকার জন্য মরণ থেকে পালাতে পারিনি। রতনের কথাগুলো শুনে বিরুৎএর মনে সেঁকা লাগে। জিজ্ঞাসা করে ‘আর টি’ খোলা আছে? রতন বলে, হেড কোয়ার্টারের ‘আর টি’ ও পাশের বিটের ‘আর টি’ খোলা রাখতে বলেছি।
বিরুৎ চারজন আর্মড ফোর্স ও দু’বিটের দশ জন স্টাফ নিয়ে চাবাগানের লাইনে কালার বাড়ি ঘিরে ফেলে। বাড়ির কিছুটা দূরে সেগুনের ব্লক গুলো স্তরে স্তরে সাজানো। রতন দেখে উত্তরের লাইন থেকে কালা হাতে চকচকে চপার নিয়ে এগিয়ে আসছে। কালাদের দলবল নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে একটা মেয়ে উন্মাদের মতো ছুটে আসছে। মেয়েটা বিরুৎএর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আঁচল মাটিতে লুটানো। হাপরের মতো বুক উঠছে আর নামছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, তোরা পলাইয়ে যা। না হলে ওরা মেরে ফেলবে। সকলে লাইন ভেঙ্গে আসছে। মেয়েটার কান্ডে রতনরা হকচকিয়ে যায়। বিরুৎ অবাক হয়ে দেখে মেয়েটার চোখ। কী সুন্দর কী সুন্দর!! যেন অন্য মোনা লিসা। বিরুৎ ভাবে, ওর মোনা লিসা। এখন কালা রতনদের মুখোমুখি। কোনকিছু না বলে চপার চালিয়ে দেয় বিরুৎএর মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। সেই রক্তে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে যায়। একটা হুলুস্থূল কান্ড বেঁধে যায়। রতনরা মাল ছেড়ে বিরুৎকে নিয়ে ছোটে বীরপাড়া, তাঁর পর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ। বিরুৎ বাঁচবে কিনা বাহাত্তর ঘন্টা পার না হলে বোঝা যাবে না। ফুলিয়া রক্তাক্ত মুখে রেতির বিস্তীর্ণ চর ভূমিতে করম গাছের নিচে বসে আছে একা। এই ভূমি যেন অন্য এক কুরুক্ষেত্র।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴