কিছুটা কাল্পনিক/আদৃতা দে রায়
কিছুটা কাল্পনিক
আদৃতা দে রায়
“এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যময়ী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভরা আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা - এইতো জীবন। শান্ত নিরাপদ জীবন নিরীহ কেরানীর জীবন হতে পারে - তার নয় -”
রিসর্ট ‘অবকাশে’ একফালি নিভৃত অবকাশ যাপনের সেই একান্ত মুহূর্তে চাঁদের পাহাড়ের শঙ্করকেই যেন বারবার মনে পড়ছিল আমার।
ঘরের সামনে একফালি বারান্দা, সেখানে গোল হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ছিলাম আমরা ক'জনায়…গান,গল্প,কবিতায় বুঁদ হয়ে।
অনতিদূরে নেওড়া নদী, তার ওপরে লালপুল।
সম্প্রতি দিন কয়েক এখানে বৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও বাতাসে সোঁদামাটির গন্ধ। সাথে জঙ্গুলে গন্ধও মিশেছে কিছুটা।
অদূরেই আদিবাসীরা মহুয়া খেয়ে মাদল বাজিয়ে ধরেছে গান।
ভ্যান গঘের ‘দ্য স্টারি নাইট’ ছবির মতোই আকাশে জ্বলজ্বল করছে কোজাগরী চাঁদ। গাঢ় নীল ক্যানভাসে হীরের কুঁচির মতো সুসজ্জিত দূরের নক্ষত্রমন্ডলী।
এমন বন্য মাদকতার স্বাদ একবার পেলে কি আর সে লোভ সামলানো যায়?
যদিও চুপ করে বসে থাকতেই ভালো লাগছিল আমার, তবু সকলের আবদারে আখতারি বাঈকে স্মরণ করে ধরেছিলাম গান,
“জোছনা করেছে আড়ি/আসেনা আমার বাড়ি/গলি দিয়ে চলে যায়/লুটিয়ে রূপোলী শাড়ি।”
যদিও আজ জোছনা ছিল প্রকৃত অর্থেই অকৃত্রিম ও অকৃপণ।
হেঁশেল থেকে ভেসে আসছিল নানারকম উপাদেয় খাবারের সুঘ্রাণ।
আমাদের গান-গল্পের আড্ডায় ছেদ পড়ে। অমিত কাকু এসে জানান, ইতিমধ্যে আমাদের সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হ’য়েছে।
খাওয়াদাওয়া শেষে সঙ্গীরা সকলেই যে যার ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।
ঘুমের সাথে আমার অবশ্য চিরকালের বৈরিতা।
অগত্যা আমি একা একা সন্তর্পণে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই।
আকাশে আলোর বন্যা। অর্ধভেদ্য রূপোলী চাদরে ছেয়ে আছে সমস্ত চরাচর। থেকে থেকে কানে ভেসে আসছে নাম না জানা বুনো পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁপোকার একটানা বিষন্নতা উদ্রেককারী শব্দ, একইসাথে একটা থমথমে, চাপচাপ নিঃস্তব্ধতার বিপরীতধর্মী সহাবস্থান।
জঙ্গল সবসময়ের জন্যই রহস্যময়ী, তবে অক্টোবরের জঙ্গল যেন ভীষণ রকমের ইউফোরিক। বছরের এই সময়টা বড্ড মায়াবী। রাত অল্প গভীর হ'তে না হ'তেই হিম পড়তে শুরু করে। রাতচরা পাখিটা বারবার তার অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে যায়...
আমি মনে মনে আমার বিপরীতে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের সত্যচরণকে কল্পনা করে নিই, এবং আমাদের কাল্পনিক কথোপকথন শুরু হয় অনেকটা এইরকম ভাবে….
-“অরণ্যে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা এই বুঝি প্রথম?”
-“হ্যাঁ”
-“বেশ…তবে বলো কেমন লাগছে, এই নৈঃশব্দ্য, এই অনিশ্চয়তা, এই একাকীত্ব?”
-“বেশ অন্যরকম। মনে হচ্ছে…”
-“কী?”
-“মনে হচ্ছে যে গোটা জীবনটা এখানেই, এভাবেই যেন কাটিয়ে দেওয়া যায়…”
সত্যচরণ হেসে ওঠে।
-“তুমি হাসছ যে?” আমি বলি।
-“একবার সভ্য পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা সদস্যের তকমা গায়ে লেগে গেলে যেমনটা চাইছ,তেমনটা আর যায় না...” সত্যচরণ বলে।
-“কেন?” আমি পালটা প্রশ্ন করি।
-“ তুমি এখন এমনটা ভাবছ ঠিকই” সত্যচরণ স্মিত হেসে বলে, “আমিও ভাবতাম বৈকী এক সময়…কিন্তু তুমি -আমি, আমরা সকলে সভ্য জগতের প্রতিনিধি। তাই আমরা দর্শকমাত্র।”
-“কী বলতে চাও?”
-“এটাই বলতে চাই যে তুমি অরণ্যকে আপন করে নিতে চাইলেও, অরণ্য তোমাকে কখনওই আপন বলে মেনে নেবে না…." সত্যচরণের চোখে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে আসে,
"অরণ্য এমনই। সে পদে পদে তোমাকে বুঝিয়ে দেবে তুমি বহিরাগত এবং অরণ্যের আইন-কানুন তোমার প্রতিকূলে…”
একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়ে, আমি শঙ্কিত হয়ে বলি,
-“দূরে ওটা কিসের শব্দ ?”
-“ ওটা কিছু নয়৷ হাতির পাল বেরিয়েছে, তাই গ্রামবাসীরা মুখে ওরকম অদ্ভুত আওয়াজ করছে।”
কথোপকথনে ছেদ পড়ে, সত্যচরণের ছায়ামূর্তি সহসা আলোয় মিলিয়ে যায়।
আমি ইয়ারপ্লাগ কানে গুঁজে ফোনের মিউজিক প্লেয়ারে আমার প্রিয় রাগ মারু বেহাগ চালিয়ে দিই।
“তরপত র্যায়না দিনা/পিয়া বিনা মোরা জিয়া তরসে।”
হঠাৎ কোনো কাল্পনিক নারীর বিরহে সমব্যথী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে আমার। কার যেন কান্নার শব্দ কানে ভেসে আসছে ক্রমাগত?
কুন্তা? নাকী রাজকন্যা ভানুমতী?
কুন্তা কি সত্যচরণকে এখনও নীরবে ভালোবাসে?
সত্যচরণই কি ভানুমতীর সাথে ঘর বাঁধতে পেরেছে?
একের পর এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মাথায়...সাথে প্রবল বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করে।
ধীরপায়ে ঘরে ফিরে আসি। ডিমলাইটের নীলাভ আলো আর জোৎস্না মিলেমিশে ঘরে মায়াবী এক আবেশ।
কানের যন্ত্রে মারু বেহাগের অন্তরা ততক্ষণে ঝংকার তুলেছে,
“ইনয়ত পিয়া তোরে দরশন বিনা,
ন্যায়নন সে মোরা নীর বরসে…”
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴