কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথের শেষ কয়টি দিন/গৌতম চক্রবর্তী
চির সখা হে- শেষ পর্ব
কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথের শেষ কয়টি দিন
গৌতম চক্রবর্তী
ঐতিহাসিক রেডিও-অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পর ২১শে মে কবি মৈত্রেয়ীর আবদার রক্ষা করে মংপুতে গিয়েছিলেন। এরপর আরও তিনবার রবীন্দ্রনাথ মংপু এসেছেন। কোনওবার শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি, কখনও বা কালিম্পং হয়ে। শেষবার যখন মংপু এলেন ১৯৪০ সালে, সেবার আগে কালিম্পং এসেছিলেন। তারপর একদিন পরেই মংপু যান। কিছুদিন মংপুতে কাটিয়ে আবার কালিম্পঙে ফেরেন। কালিম্পঙে পৌনে দু’মাস কাটিয়েছিলেন (৭ই মে থেকে ২৯শে জুন)। সেবারের পর্বতবাসের অধ্যায়টি জুড়ে কেবলই প্রিয়জনের মৃত্যুযন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছেন চির-আনন্দময় কবি। কালিম্পং যাওয়ার কয়েকদিন আগেই মারা গেলেন চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ। কবির কর্মজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৪০-এর শুরুতেই কলকাতায় এসে গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন। ২৭শে জানুয়ারি নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন। দু’মাসের কিছু বেশিদিন হাসপাতালের বিছানায় কাটিয়ে ৫ই এপ্রিল অন্তিমলোকে যাত্রা করলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ‘চার্লি’। এই চার্লি খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন, অথচ গুরুদেবের সংস্পর্শ পেয়ে যাজকের কাজ চিরতরে ত্যাগ করে হয়ে উঠলেন মানুষের প্রকৃত বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মাজির মধ্যে মিলনের সেতুটি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে যিনি রচনা করেছিলেন, সেই মানুষটিও হলেন এই চার্লি। তাঁকে এই সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন স্বয়ং ‘বড়দাদা’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অ্যানড্রুজ মারা গেলেন ৫ই এপ্রিল। তার ন’দিন বাদে নববর্ষের দিন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব পালিত হল। সুদূর চীন থেকে সর্বময় নেতা মার্শাল চিয়াং কাই-শেক এবং শিক্ষামন্ত্রী চিয়েন লি-ফু জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠালেন। কবি এরপর কালিম্পং যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ৫ই মে, ১৯৪০। বাংলা ২২শে বৈশাখ, ১৩৪৭। মংপুতে কবির জন্মদিন পালন হচ্ছে সেদিন। স্থানীয় নেপালী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে সে এক ভিন্ন স্বাদের জন্মদিন পালন। পরদিন সুধাকান্তবাবুর মুখে শুনলেন অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ নেই।
সেইদিন সন্ধেবেলায় অসীম শূন্যের পানে চেয়ে শুধু বলেছিলেন-‘কেউ জানল না সে কী আশ্চর্য মানুষ ছিল। এমন মহৎ, এমন একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ সকলের দৃষ্টির আড়ালে ছিল, অগোচরেই চলে গেল। যারা জানে শুধু তারাই বুঝবে এমন হয় না, এমন দেখা যায় না।’ ‘স্বর্গের কাছাকাছি’তে মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ ও তাঁর একবছরের ছোট বোন ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে ইংরেজি শেখার ব্যপারে রবীন্দ্রনাথ দারুন সাহায্য পেয়েছিলেন। মংপু থেকেই ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে সেই দুঃখ ঝরে পড়েছে-‘তোরা বোধ হয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি ভালোবেসে ছিলুম। নানা উপলক্ষ্যে তাকে আমার কাছে টানবার ইচ্ছা করেছি বারবার, বিরুদ্ধ ভাগ্য নানা আকারে কিছুতেই সম্মতি দেয়নি। এইবার মৃত্যুর ভিতর দিয়ে বোধ হয় কাছে আসব, সেইদিন নিকটে এসেছে।’ পরদিন ৭ই মে কবি কালিম্পং চলে এলেন। রথীন্দ্র-প্রতিমা তখন কালিম্পঙে এসেছেন। মংপুতে আবারও ফেরবার কথা ছিল দিন সাতেকের মধ্যেই। সেকারণে বেশ কিছু গরম জামাকাপড় আর ব্যবহার্য সামগ্রী রেখেও এসেছিলেন মৈত্রেয়ীর হেফাজতে, কিন্তু আর যাওয়া হয়নি কোনও কারণে। পাঁচদিনের মাথায় এল তৃতীয় মৃত্যুসংবাদ। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পথচলার একদম প্রথম যুগ থেকে যিনি কবির পাশে ছিলেন, কর্মে ও নিষ্ঠায়, সেই কালীমোহন ঘোষ আর নেই। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিশ্বভারতী হারাল তাদের অন্যতম দুই কর্মনিষ্ঠ বন্ধুকে। পরপর তিনজন প্রিয়তম মানুষের চলে যাওয়া। অভ্যস্ত ছিলেন তিনি এসবে, আযৌবন, আমৃত্যু।
কিন্তু সভ্যতার পৃথিবীর এমন বিকৃত রূপ দেখার জন্য তো কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না। কালিম্পঙে বসে খবর পাচ্ছেন কবি জার্মান বাহিনী তখন ফ্রান্সের অনেকটাই দখল করে ফেলেছে। গৌরীপুর ভবনে তখন মৈত্রেয়ী দেবীরাও এসেছেন। তখন রোজ সবাই মিলে রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনতেন। এই দুর্দিনে সকলেই খুব উদ্বিগ্ন। ফ্রান্সের খবর বিশেষ মনোযোগ সহকারে শোনা হতো। নাৎসি বাহিনীর হাতে প্যারিসের পতন হল। তারিখটা ১৪ই জুন, ১৯৪০। শয়তানের করাল থাবায় ধরাশায়ী হয়েছে শিল্পকলার রাজধানী। প্যারিসের পতন তখন অবশ্যম্ভাবী, শত্রুপক্ষের হাতে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করার আগের রাতে প্রচারিত হল শেষ রেডিও ব্রডকাস্ট। সেইটিই ছিল ‘The Post Office’-এর ফরাসী অনুবাদের নাট্যাভিনয়। ধ্বংসলীলার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই ধ্বংসকেই যেন সাদরে বরণ করে নেওয়া। অনুবাদটি করেছিলেন ফরাসী লেখক আঁদ্রে জিদ, যিনি ১৯৪৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এমন বিরল সম্মান পেয়ে সেদিন কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু মানব-দরদী মহামানবের কাছে মানবতার এমন ভূলুণ্ঠন সেই সম্মানের আনন্দকেও ম্লান করে দিয়েছিল। এই ফ্যাসিবাদী নখ-দন্ত প্রদর্শন তিনি কোনোভাবেই সেইসব দিনের সাথে মেলাতে পারছিলেন না। প্যারিসের পতনের পরদিন ১৫ই জুন এই বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টকে টেলিগ্রাফ করলেন। আমেরিকা তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু মিত্রশক্তিকে সেনা ও প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দিয়ে চলেছে নিয়মিত। কবির মনে হয়েছিল, এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বুঝি একমাত্র থামাতে পারে আমেরিকাই। একথা সত্যি যে সেই সময়ের সাপেক্ষে আমেরিকার সাহায্য ছাড়া ফ্যাসিবাদ-দমন ছিল নিতান্তই অসম্ভব। কারণ ফ্রান্স ততদিনে জার্মানির পদানত, আরেক মহাশক্তিধর রাশিয়া তখন জার্মানির সাথে অনাক্রমণ চুক্তিতে নিরপেক্ষ ভূমিকায়। বাকি ব্রিটেন নিজেই তখন বিশ্বব্যপী নিজহস্তে গড়া ঔপনিবেশিক দুর্গ সামলাতে টলমল করছে। এ চিঠিতে অবশ্য আমেরিকা নয়, ইংরেজের শতাব্দীপ্রাচীন শোষক-প্রবৃত্তিকেই পরিষ্কার ইঙ্গিত করেছেন। আসলে কবি চেয়েছিলেন এই মারণলীলার দ্রুত অবসান।
গৌরীপুর ভবনের ওই বিষণ্ণ-চত্বরে দাঁড়িয়ে তখনও এতকিছু আমি জানতাম না। এখন লিখতে বসে যখন জানতে পারছি, তখন মনে হচ্ছে, শুধু ওই লাইভ ব্রডকাস্টই নয়, আরও কত ঐতিহাসিক মুহূর্ত ধরে রেখেছে এ বাড়ি। জীবন-পথিক কবির জীবনের শেষ ভ্রমণ সফরের সাক্ষীও তো এই বাড়িই। সেসব খণ্ড খণ্ড ইতিহাস-ফ্রেস্কো বোধহয় এখনও লেপ্টে থাকে নোনা-ধরা দেওয়ালের গায়ে। চোখে পড়ে না। ৭ই অগাস্ট, ১৯৪০। বাংলা ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৭। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে ডি. লিট. সম্মান দেওয়া হল বিশ্বকবিকে। সম্মান গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তব্য রাখেন তার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার সামনে দাঁড়িয়ে মানবতার প্রতি আশাবাদ-চেতনার অঙ্গীকার। সেইদিন কেউ দূরতম কল্পনাতেও হয়ত ভাবেননি, ঠিক আর একবছর বাদেই মৃত্যুঞ্জয়ী কবি পাড়ি দেবেন অমৃতলোকে। স্বাস্থ্য অবশ্য তাঁর ভেঙে পড়েছে । মেজাজেও পরিবর্তন এসেছে। বার্ধক্যের খুঁটিনাটি চিহ্ন ধরতে শুরু করেছে। মিতভাষী লোকটি তখন একটু খিটখিটেও হয়ে গিয়েছিলেন। আর অসম্ভব জেদী। অগাস্ট মাসের শেষে অসুস্থ প্রতিমা দেবী কালিম্পঙে চলে গেলেন হাওয়াবদল করতে। তিনি সেইসময় পায়ে সায়াটিকার যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। রথীন্দ্রনাথ গেলেন পূর্ববঙ্গের পতিসরে, জমিদারি দেখাশোনা করার উদ্দেশ্যে। ৩রা সেপ্টেম্বর আশ্রমে বৃক্ষরোপণ আর বর্ষামঙ্গল একসাথে পালিত হয়েছিল। ছেলে-বউমা চলে যাওয়ার পর থেকেই কবির মন যাই-যাই করতে শুরু করে। কিন্তু শরীরের কারণে যাওয়া কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়ে নিজেই সন্দিহান ছিলেন। যেদিন বর্ষামঙ্গল উদযাপিত হল, সেইদিনকার চিঠিতে প্রতিমা দেবীকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, মধ্য-সেপ্টেম্বরেই তিনি কালিম্পঙের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। প্রতিমা দেবী তখন একরাতের জন্য মংপুতে থেমেছিলেন।
চিঠিতে পাহাড়ে যাওয়ার জন্য কবির ব্যাকুলতা স্পষ্ট-“হংসবলাকার দলে যদি নাম লেখা থাকত তাহলে উড়ে চলতুম মানস-সরোবরের দিকে। যাওয়ার দিন উপস্থিত হল। সম্ভবত ১৫ই সেপ্টেম্বর। এমনিতে পাহাড়ের ঠাণ্ডা হাওয়ার চেয়ে রাঢ়বঙ্গের বর্ষাকেই কবির পছন্দ ছিল বেশি। কিন্তু সেবারে এইরকম ভয়ঙ্কর গরমের কারণেই বোধহয় অসুস্থ শরীরযেন বল পাচ্ছিলেন না। সত্ত্বেও কালিম্পং চলে যেতে চাইলেন। কবির দুজন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকার দুজনেই তাঁকে নিষেধ করছিলেন পাহাড়ে যেতে। তাও তাঁর জেদাজেদির কাছে অবশেষে হার মানেন। কালিম্পঙে তাও হাসপাতাল রয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে (টেলিফোনের উদ্বোধন তো স্বয়ং কবির হাতেই হয়েছিল) তাই তাঁরা নিমরাজি হয়েও মত দেন যে গেলে কালিম্পং ঠিক আছে, তবে মংপু একেবারেই নয়। এদিকে মৈত্রেয়ীকে কথা দিয়েছেন মংপু আসবেনই। সেজন্যে মৈত্রেয়ীর মা হিমানী দেবী মেয়েকে চিঠি লিখে বলেছিলেন কবিকে যেকরে হোক বারণ করে পাহাড়যাত্রা থেকে নিবৃত্ত করতে। কিন্তু নিয়তির টানও অমোঘ আর মানুষ রবীন্দ্রনাথও মরণশীল, অতএব ১৯ সেপ্টেম্বরের দার্জিলিং মেলে যাত্রা করলেন কবি। ১৯ তারিখ রওনা হয়ে ২০ তারিখ গৌরীপুর ভবনে এসে পৌঁছেছিলেন। গৌরীপুর ভবন বাড়িটার একটা ব্যাপার ছিল, সেটা হচ্ছে, পাহাড়ি অঞ্চলে যেরকম কাঠের বাড়ি তৈরি হয়, সেরকম কাঠের ছিল না, ছিল সিমেন্টের। তাই ঠাণ্ডাভাবটাও হতো বেশি। আর রবীন্দ্রনাথও জানলা খুলে দেওয়ার জন্য জেদ করতেন বলে চারপাশ খোলা থাকত। তাই বৃদ্ধ মানুষের ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
মৈত্রেয়ীরা যেদিন এলেন সেদিন থেকেই শরীরটা খারাপ করতে শুরু করল। দুপুরে পড়ে গিয়েছিলেন চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে। ২৬ তারিখ বিকেলে কালিম্পঙের বাঙালি ডাক্তার গোপালচন্দ্র দাশগুপ্ত এবং স্কটিশ ডাক্তার ক্রেগ এসে দেখে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ইউরেমিয়া রোগের সংক্রমণের ফলে কবি অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। গোপাল দাশগুপ্ত কবির বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাঁর উল্লেখ পেয়েছি প্রবোধ সান্যালের লেখাতে। ডাক্তার ক্রেগের নামটি কেবল ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। তাঁকে ‘হাসপাতালের ডাক্তারসাহেব’ বলেই উল্লেখ করেছেন প্রতিমা দেবী। এখানে হাসপাতাল বলতে যেটা বোঝানো হয়েছে, সেটি হচ্ছে ওই স্কটিশ মিশনারিদেরই তৈরি করা হাসপাতাল। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে, কালিম্পঙের এক ও অদ্বিতীয় জন আলেকজান্ডার গ্রাহাম ও তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৈরি হাসপাতাল। কালিম্পঙের ইতিহাসের পাতায় পাতায় যেন মিশে আছেন তাঁরা। ক্রেগ তখন চার্টেরিস হাসপাতালের নতুন চিকিৎসক। বয়স তখন বেশ কম। তাঁর পুরো নাম কোথাও পাইনি। তাঁকে রবীন্দ্রনাথের বেশ পছন্দ হয়েছিল এটা প্রতিমা দেবী লিখেছেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর বেলার দিকে দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লে মৈত্রেয়ী দেবী মংপু ও কলকাতায় যোগাযোগ করার সমস্ত ব্যবস্থা করেন। গৌরীপুর ভবনের পাশের বাড়িতে টেলিফোন ছিল। সেখান থেকে শান্তিনিকেতনে অনিল চন্দকে ফোন করে সব কথা জানানো হয়। পাশের বাড়িটি ছিল কলকাতার বিখ্যাত আইনজীবী শরৎচন্দ্র বসাকের। কলকাতায় বিশ্বভারতীর অফিসে ফোন করে কবির অসুস্থতার খবর জানানো হয়। প্রতিমা দেবী নিজে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে প্রশান্ত মহনানবিশকে ফোন করেন। তারপর প্রতিমা দেবীর নির্দেশে মৈত্রেয়ী দেবী গাড়িতে করে একাই চলে যান কোনোভাবে রথীন্দ্রনাথের কাছে পতিসরে যদি খবর পৌঁছনো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে। প্রতিমা দেবীর আরও নির্দেশ ছিল, কোনো বড় ডাক্তার যদি এইসময়ে আসতে পারেন, তাহলে সেই ব্যবস্থাও যেন মৈত্রেয়ী করেন। কারণ, ডাক্তার দাশগুপ্ত তখন নিজেই দিশেহারা আর ক্রেগও “সার্জিক্যাল কেস হাতে নিতে বড়ো ইচ্ছুক নন, বোধ হয় ভয় পেয়েছিলেন।”
তবে প্রতিমা দেবীর জানার কথা নয়, যে আসলে ভয় নয়, ক্রেগের না আসার কারণ ছিল সম্পূর্ণই পেশাদারি। সেটা মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছেন। চার্টেরিস হাসপাতালের অবস্থান ছিল বাজার পার হয়ে উঁচু পাহাড়ের গায়ে। ডাক্তারের বাড়িও ছিল সেখানেই। সাজানো বাগানঘেরা। মৈত্রেয়ী যখন তাঁকে আসবার জন্য অনুরোধ করেন, তিনি বলেন হাসপাতালে এক প্রসুতি মহিলার প্রসব হবে, সুতরাং অসুস্থ মানুষটি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেও তাঁর পক্ষে এখন যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব পেশেন্টও নন। অনেক অনুরোধেও রাজি না হলে মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় তাঁকে হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করেন। সাহেব উঠে পড়ে পায়চারি করতে লাগল। লম্বা বারান্দায় তার চিন্তিত ঈষৎ বিচলিত পদধ্বনি আমায় একটু আশ্বস্ত করলো।” অবশেষে মৈত্রেয়ীর জেদের কাছে হার মেনে দার্জিলিঙের নামকরা সিভিল সার্জনকে খবর দিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলেন। সার্জন এসেই রোগীর অবস্থা দেখে অপারেশন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হাসপাতালে দেওয়া হয়নি কেন, নার্স কে এসব পেশাদারি প্রশ্ন করা শুরু করেন, যেসবের উত্তর দেওয়ার জন্য না প্রস্তুত ছিলেন প্রতিমা, না মৈত্রেয়ী। ডাক্তার দাশগুপ্তও নীরবে অপারেশন করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। কিন্তু সেইসময়ে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, কাছের মানুষজন নেই, ওই অবস্থায় অপারেশন করানোটা হঠাকারিতা হবে ভেবে দুজনের কেউই অপারেশনে মত দিচ্ছিলেন না। প্রতিমা মৈত্রেয়ীকে বলেন, বাবামশায়ের জ্ঞান থাকলে তিনিও অপারেশনে মত দিতেন না। কিন্তু সাহেব ডাক্তার এদিকে নাছোড়বান্দা। তাঁর কড়া নির্দেশ, রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নয়ত বারো ঘণ্টায় কী হয়ে যায়, কোনও ঠিক নেই। দুই দেবীর লেখা পড়েই একথা পরিষ্কার বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের অসুখ হওয়াতে তাঁরা যত না অসুবিধায় পড়েছিলেন, আরও বেশি কঠিন পরীক্ষায় পড়েছিলেন ইংরেজ সার্জনের নাছোড় মনোভাবে। কোনোক্রমে সার্জনকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন। কলকাতায় আরেকবার ফোন করে জানা গেল, যে ডাক্তারদের নিয়ে প্রশান্ত মহলানবিশ দার্জিলিং মেলে রওনা হয়ে গেছেন। এই ফোন ডাক্তার নিজেই করেছিলেন। কলকাতার ডাক্তাররা আসছেন জেনে তিনি আর কিছু জোরাজুরি করেননি, তবে বলে গিয়েছিলেন, দরকার হলে ডাকলেই তিনি আবার আসবেন। ডাক্তারের এই উদার মানসিকতার কথা অবশ্য মৈত্রেয়ী দেবী লেখেননি। তাঁর লেখায় ডাক্তারকে একগুঁয়ে, জেদী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলেই বেশি মনে হয়েছে। প্রতিমা দেবী বরং ডাক্তারের খানিক নরম চিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন।
ইংরেজ ডাক্তার যাওয়ার পর একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এসে কিছু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে যান। কবির হোমিওপ্যাথি এবং বায়োকেমিক চিকিৎসার ঝোঁক ছিল বলে তাঁর সঙ্গে সর্বক্ষণ ওইসব ওষুধ থাকত। হোমিওপ্যাথির গুণে পরদিন ভোরের দিকে তাঁর চেতনা ফিরে আসে। পরদিন অর্থাৎ ২৮শে সেপ্টেম্বর সকালে তিনজন ডাক্তার সত্যসখা মৈত্র, অমিয়নাথ বসু ও জ্যোতিপ্রকাশ সরকার (নীলরতন সরকারের ভ্রাতুষ্পুত্র) কে নিয়ে এসে পড়েন প্রশান্ত মহলানবিশ ও কবিকন্যা মীরা দেবী। মেয়েকে দেখে কবির চিরন্তন আনন্দ উছলে উঠেছিল। তারপর নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে পৌঁছে দুপুর নাগাদ আসেন অনিলকুমার চন্দ, সুধাকান্ত রায়চৌধুরি এবং তৎকালীন শান্তিনিকেতন সচিব সুরেন্দ্রনাথ কর। মংপু থেকে মনোমোহন সেনও চলে আসেন। অর্ধচেতন রোগীকে নিয়ে এতজনের দল নামবে রাস্তা দিয়ে। এদিকে আগেরদিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তা বহু জায়গায় ধসে গেছে। মনোমোহন সেনের নেতৃত্বে শ’খানেক শ্রমজীবী রাস্তা সারাইয়ের কাজ করেছিলেন। একটু একটু করে রাস্তা সারাই হচ্ছিল, গাড়ি এগোচ্ছিল। গাড়ি বলতে একটি বিরাট স্টেশন ওয়াগন। তার মধ্যে সিট খুলে বিছানা পাতা হয়েছিল। মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন পরিচর্যায়। আমি ভাবছিলাম, এঁদের কথা তো ঠিক আছে, বইতে পাওয়া যাবে, স্বমহিমায় তাঁরা ভাস্বর, কিন্তু সেদিন কবিকে যাতে নিরাপদে নামিয়ে আনা যায়, সেজন্যে ওই একশোজন শ্রমজীবী মানুষ যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জলকাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে রাস্তা সারাইয়ের পরিশ্রম করে গেছিলেন, তাঁদের কথা আর কেই বা বলবে! ইতিহাস, সেও বুঝি কেবল সামনে থাকা মানুষদেরই জয়গান গায়। ২৫শে বৈশাখ, ১৩৪৫। আর ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪০। কত পার্থক্য দুটো দিনে। অথচ উপলক্ষ্য সেই একজনই। স্থান সেই একই গৌরীপুর ভবন। ২৫শে বৈশাখে সকলের হৃদয়ে ছিল মুগ্ধতা আর ২৮শে সেপ্টেম্বরে সকলে ছিলেন উৎকণ্ঠিত। আর বাড়িটা? সে কি ভাবছিল? সে কি জানত, আর খানিক পরেই চিরতরে তার নাড়ি ছিঁড়ে চলে যাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?
কবির শেষ ভ্রমণসফর। সমাপ্তিটা একেবারেই সুখকর ছিল না। সেবার দুপুর নাগাদ রওনা হয়ে রাত ন’টায় পাঁচ-ছয়খানা গাড়ির ক্যারাভান শিলিগুড়ি এসে পৌঁছয়। পতিসর থেকে ততক্ষণে শিলিগুড়ি পৌঁছে গেছেন রথীন্দ্রনাথ। যে টেলিফোনের মাধ্যমে বেতার সংযোগের উদ্বোধন হয়েছিল কবির হাত দিয়ে, কবির সঙ্কটময় মুহূর্তে সেই পরিষেবাই অসামান্য কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিল। কবির অসুস্থতার খবর জানিয়ে যখন ফোন করা হচ্ছিল, সেই খবর জেনে নিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মীরা অল ইন্ডিয়া রেডিওকে দেয়। বেতারে কবির অসুস্থতার খবর সারা দেশে সম্প্রচারিত হয়। রথীন্দ্রনাথ সেটা শুনেই তড়িঘড়ি শিলিগুড়ি চলে এসেছিলেন। কলকাতায় পৌঁছনোর পর গান্ধীজীর একান্ত সচিব মহাদেব দেশাই এসেছিলেন মহাত্মাজীর শুভেচ্ছা-বার্তা সঙ্গে নিয়ে। শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ট্রেন। দেশভাগের আগেকার লাইন। শিয়ালদহ-রানাঘাট-ভেড়ামারা-হার্ডিঞ্জ ব্রিজ-ঈশ্বরদি-সান্তাহার-হিলি-পার্বতীপুর-নীলফামারি-হলদিবাড়ি-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি। বারো ঘণ্টার যাত্রা। দেশভাগের আশঙ্কা করেনি তখনও কেউ। কেউ ভাবেনি নিজেদের ভিটায় যেতে একদিন পাসপোর্ট-ভিসার নিয়মকানুন মানতে হবে। আমাদের গৌরীপুর ভবন ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে এল। চলে আসার সময় সঞ্জিতাকে একবার চিত্রভানুর কথা জিজ্ঞাসা করি। প্রতিমা দেবীর ছবি আঁকার স্টুডিয়ো ছিল সেখানে। সাহিত্যেও উল্লেখ পেয়েছি। সেটা কতদূরে এখান থেকে? সঞ্জিতা বলেন, ওটা আরেকটু নীচের দিকে। চিত্রভানু তৈরি হয়েছিল কবির মৃত্যুর ঠিক দু’বছরের মাথায়। এখন যেখানে পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি, ঠিক তার পাশেই চিত্রভানুর গেট। এ জায়গাটার নাম ছিবো বস্তি। গেটের দুদিকে লেখা তারিখ। ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০। ৮ অগাস্ট, ১৯৪৩। শেষজীবনে রথীন্দ্রনাথের সাথে যখন তাঁর চির-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, সেসময় প্রতিমা দেবী এখানে এসে দিন কাটিয়ে যেতেন। ছবি আঁকতেন। দুই শিল্পীর স্মৃতিতে ভরপুর এই বাড়ি। এখন রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখানে। পাহাড়ি মহিলারা হাতের কাজ শেখেন। উপযুক্ত পথেই ব্যবহৃত হচ্ছে চিত্রভানু। গৌরীপুর ভবনটাও যদি কোনোভাবে ব্যবহৃত হতো।ইতিহাস নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালি এখন ইতিহাস-বিস্মৃত হতেই কি বেশি ভালোবাসে?
তথ্যঋণ:
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ- মৈত্রেয়ী দেবী
স্বর্গের কাছাকাছি- প্রতিমা দেবী
বাইশে শ্রাবণ - নির্মল কুমারী মহলানবিশ
গুরুদেব- রানী চন্দ
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়- রবীন্দ্রজীবনী খণ্ড ৪
রমেশ দাস -তিস্তা উপত্যকা রেলপথ
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴