সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
07-May,2023 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 556

কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ (প্রথম পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
-------------------------------------------------

গৌরীপুর হাউসে বাঁচিয়ে রাখা হোক রবীন্দ্রস্মৃতি

আমাদের নিত্যদিন, প্রতিমুহূর্তে, অস্থিমজ্জায়, চিন্তায়-মননে যিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন তিনি আর কেউ নন। পরমপ্রিয় অতি আপনজন গর্বের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছেন পরম সম্পদ যা আমরা ফিক্সড ডিপোজিটের মতো ভাঙিয়ে তাঁর নাম জপ করে চলেছি। কিন্তু খুবই বেদনার, দুঃখের এবং লজ্জার যখন বছর চারেক আগে এক গ্রীষ্মের ছুটিতে এরকমই এক রবীন্দ্রপক্ষে কালিম্পংয়ে মেঘ-কুয়াশা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দূরপিনদাড়ার অদূরে রিং কিং পং রোডে অবস্থিত নিঝুম মরগ্যান হাউস, গলফ মাঠের পাশ দিয়ে হাজির হয়েছিলাম গৌরীপুর হাউসের উঠানে তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। উদোম, অনাদৃত, তাচ্ছিল্যকর ভুতুড়ে পরিবেশ। ভেজা জংলা ঘাস, আবর্জনা, বিষ্ঠা, প্লাস্টিক এককথায় চরমতম অবহেলা। পোড়োবাড়ি, ভূতবাংলো বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিতিকিচ্ছিরি বেহাল রবি কবির স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউসে দেওয়ালে, কার্নিশে, জানালার খাঁজে খাঁজে গাছপালা। আগাপাশতলা শ্যাওলার কালচে আস্তরণে ঢাকা। ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর ফলকে বলা আছে – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷'' অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন কাটিয়েছিলেন এই বাড়িতে এবং তথ্য বলছে নিজের লেখা জন্মদিন কবিতাটি তিনি টেলিফোনে আবৃত্তি করেছিলেন, যা সরাসরি সম্প্রচার করে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা দপ্তর ‘‘আকাশবাণী''৷ কালিম্পংয়ের সঙ্গে কলকাতার টেলিফোন যোগাযোগেরও নাকি সূচনা হয়েছিল সেই সঙ্গে৷ সেই ইতিহাস, সেই গুরুত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে ধূলামলিন এক মর্মর ফলকে৷ দায়িত্ববোধের সেখানেই ইতি৷ 

রবীন্দ্র অনুরাগী হিসাবে আমার দুঃখ, অভিমান আর জেদ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ক্ষেত্রসমীক্ষা করে মংপু, গৌরীপুর হাউসের হতশ্রী অবস্থা সংক্রান্ত আমার লেখাগুলি এবং ভিডিওগ্রাফির ক্লিপিংস রাজ্য হেরিটেজ কমিটি সহ উত্তরবঙ্গের নির্বাচিত মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়কদের কাছে পাঠাবো। কারণ আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি সততার সঙ্গে আঁকড়ে থাকা যায় তাহলে অসীর চেয়ে এখনো মসী বড়ো। সেই বছরেই পুজোর সময়ে কালিম্পং এসে মংপু, গৌরীপুর হাউস, গ্রাহামস হোমকে বেছে নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করি প্রচুর মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে। মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব সহ হেরিটেজ কমিটিকে ফাইল পাঠাই এবং অবশেষে মংপু বাংলো, গৌরীপুর হাউসের সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ভ্রামণিক প্রাবন্ধিক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সদস্য আনন্দগোপাল ঘোষ সহ আরো অনেক রবীন্দ্র অনুরাগীর সাহায্য সহযোগিতাই সরকারের ঘুম ভাঙাতে হয়তো সাহায্য করেছিল। মংপু হয়ে কালিম্পং যখন এসেছিলাম তখন গৌরীপুর হাউসের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে নিছক বেড়াতে গিয়েও একরাশ অভিমান আর দায়িত্ববোধ নিয়ে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে এসে পৌঁছেছিলাম একটা হেরিটেজ সফর এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। সহজ উঠোনের চারটি পর্বে সম্পাদকের অনুমতি পেলে কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক অনেক অজানা তথ্য পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপিত করতে পারব। তবে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপডেট তথ্য হয়তো দিতে পারব না। কারণ করোনাকালের পর আর কালিম্পঙে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। 

দূরপিনদাঁড়া রোড মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা উতরাই পেরোতেই একটা ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের কোয়ালিশ। এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। একটা সরু পায়ে চলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। গাড়ি থেকে নামলাম। এই সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি নামবার কোনও উপায় নেই। অথচ তখন প্রকাণ্ড মোটর নামত দিব্যি। মনে মনে হিসাব করলাম তার মানে এখন যা সরু তার চেয়ে বেশ খানিক চওড়া ছিল তখন। রাস্তার ডানদিকের অংশটা ধ্বসে গেছে বহুদিন। সাবধানে নামছি। দেখতে পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান এবং তার গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়েছিল৷ পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরীপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও ছিল এবড়োখেবড়ো, রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷ চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখে চোখে জল আসার উপক্রম হয়েছিল৷ সদর দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দু হাট করে খোলা৷ তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখলাম একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয় ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। দেখেছিলাম বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ নেই। যেগুলোতে ছিল, সেগুলোও দেখেছিলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। দেওয়াল এবং মেঝের কিছু অংশ খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা ছিল।

বাড়ির চত্বরেই চলছিল কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম পলিটেকনিক কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই। কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে! রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছিলাম একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি সিঁড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? ভেতরে প্রবেশ করে কারা থাকে একটু খোঁজখবর করতে একটা দরজা দেখিয়ে দিল এক নির্মাণকর্মী। দরজাতে কড়া নাড়াতে বেড়িয়ে এলেনএক মাঝবয়েসী মহিলা। হিন্দীতে আসার কারণ জানতে চাইলে জলপাইগুড়ি থেকে এই বাড়িটি নিয়ে লিখব বলে এসেছি শুনে একাধারে বিস্ময় এবং আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে। অত্যন্ত খাতির করে ভেতরের ভাঙাচোরা অথচ পরিপাটি করে গোছানো ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে ভাড়া থাকেন তিনি আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। নাম, সঞ্জিতা শর্মা। সম্ভবত এখনো আছেন। এছাড়া ছিল কতকগুলো মোরগ-মুরগি। তাঁর মুখেই জেনেছিলাম সেখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন। তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময় রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। মায়ের নাম ছিল কৃষ্ণা। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন-‘বিটি, মিঠাই লে আ’। পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন। পদমলাল, কৃষ্ণা কেউই আর বেঁচে নেই এখন।

কথা প্রসঙ্গে দেখলাম বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে। সঞ্জিতার সহায়তায় গৌরীপুর লজে বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেখেছিলাম প্রতিটা ঘরেই ফায়ারপ্লেস। সাদা দেওয়ালে অনবরত শ্যাওলা জমে তা আর সাদার পর্যায়ে ছিল না। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ‘ভূতের বাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। গৌরীপুর লজ বললে কেউই বুঝবেন না। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হয়। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে “জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে ফলকটি  করিয়েছিলেন সেসব কিছু লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়ে থাকুন, ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত খোদাইটি করিয়েছিলেন। কালিম্পংয়ে রায়চৌধুরি পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস গৌরীপুর হাউস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য৷ অথচ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই স্মৃতি আজ ধূলাচ্ছন্ন৷ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না। সে নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷

অবলুপ্ত ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশকে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মানসিক অনুপ্রেরণাতেই এই সফর ছিল। দেখেছিলাম হেরিটেজ গৌরীপুর ভবন দিনে দিনে ভগ্নস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সরকার মাঝেমাঝে কিছু অনুদান দিলেও রাঘববোয়াল ঠিকাদারদের উদরস্থ হচ্ছে তার সিংহভাগটাই। অথচ মানুষের কোন বাদ প্রতিবাদ নেই। গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছিলেন কালিম্পংয়ের মতো জায়গায় প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি৷ পরবর্তীকালে বিস্তর লেখালেখি এবং প্রভাবশালী মহলে খোঁচাখুঁচির ফলে রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৮ সালের মার্চ মাসের ২১ তারিখে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন পাহাড়ের মংপুতে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত ভবন ঘিরে যেমন কাজ শুরু করে, তেমনই কালিম্পং-এর রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউস এবং চিত্রভানু ঘিরেও কাজ শুরু করে। কালিম্পং-এর বাড়ি দুটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন অধিগ্রহণ করার বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেই অনুযায়ী কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় রবীন্দ্র অনুরাগীরা চাইছিলেন ওই দুটি স্থানেই রবীন্দ্র মিউজিয়াম তৈরি হোক।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে স্থানীয় মিলনী ক্লাবের সভাপতি দুলাল রায়ের সঙ্গে দুরভাসে কথা বলে জেনেছিলাম কালিম্পং সফর করার সময় তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কালিম্পং-এর রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত বাড়িগুলি সংস্কারের কথা বললে মুখ্যমন্ত্রী তাতে রাজি হন। এরপর সেসব হেরিটেজ কমিশনের অধীনে নিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। গৌরীপুরের ঐতিহাসিক বাড়ি হেরিটেজ কমিশন নিয়ে নিলেও এখনও সেভাবে কাজ শুরু হয়নি। সেই বাড়ির সামনে পলিটেকনিক কলেজের কাজ হচ্ছে। ফলে বালি, পাথর এবং নির্মাণের সামগ্রী ফেলে রাখা হচ্ছে ওই বাড়ির সামনে। মিলনী ক্লাব সেখানে কবি প্রণাম আয়োজন করে প্রতিবছর। আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে দুলালদার সক্রিয় সহযোগিতা, সমর্থন এবং অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। চলে আসার সময় দুলালদাকে একবার চিত্রভানুর কথা জিজ্ঞাসা করি। জানাই প্রতিমা দেবীর ছবি আঁকার স্টুডিয়ো ছিল চিত্রভানুতে। সাহিত্যেও উল্লেখ পেয়েছি। জানতে চাইলাম সেটা কতদূরে এখান থেকে। দুলালদা জানিয়েছিলেন ওটা আরেকটু নীচের দিকে। দুলালদার সঙ্গেই গিয়েছিলাম এই গৌরীপুর হাউসের কাছেই অতিশা রোডে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত চিত্রভানুতে। সে বাড়িটির জমি কেনা হবে বলে কবিই স্থান নির্বাচন করে দিয়ে যান। কবির খুব ভালো লাগত কালিম্পং। তাই কালিম্পং-এ স্থায়ী একটি আবাস তৈরি করতে চান কবি। ১৯৪১ সালে কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীর নামে লিজে নেওয়া হয় জমি। সেখানে নির্মাণের সময় রথীন্দ্রনাথ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মাণ করিয়েছিলেন। পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসাবে রথীন্দ্রনাথ কাজে ব্যস্ত থাকলে প্রতিমাদেবি দীর্ঘদিন সেই চিত্রভানুতে ছিলেন। আর তিনি থাকার সময় চিত্রভানুর লনে তিনি কয়েকবার রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন করেছিলেন। সেই সময় কালিম্পং টাউন হলে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালিত হলে তাতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিমা দেবী।

চিত্রভানু তৈরি হয়েছিল কবির মৃত্যুর ঠিক দু’বছরের মাথায়। তাঁর প্রয়াণের পর চিত্রভানুর দেওয়ালে মার্বেল পাথরে কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাইও করা হয়। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্টুডিওর নামে এই বাড়ির নামকরণ হয় চিত্রভানু। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে সেই বাড়ির অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে প্রতিমা দেবীর ব্যবহার করা টেবিল, চেয়ার, খাট সবই আছে। তাছাড়া কবিগুরুর অনেক হাতের কাজ এখানে আছে। এখন যেখানে পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি, ঠিক তার পাশেই চিত্রভানুর গেট। এ জায়গাটার নাম ছিবো বস্তি। গেটের দুদিকে লেখা তারিখ। ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০। ৮ অগাস্ট, ১৯৪৩। শেষজীবনে রথীন্দ্রনাথের সাথে যখন তাঁর চির-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে সেসময় প্রতিমা দেবী এখানে এসে দিন কাটিয়ে যেতেন। ছবি আঁকতেন। দুই শিল্পীর স্মৃতিতে ভরপুর এই বাড়ি। এখন রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্থ নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখানে। এখন রাজ্য সরকারের তরফে মহিলাদের হাতের কাজের কিছু প্রশিক্ষণ হয়। পাহাড়ি মহিলারা হাতের কাজ শেখেন। উপযুক্ত পথেই ব্যবহৃত হচ্ছে চিত্রভানু। গৌরীপুর ভবনটাও যদি কোনোভাবে ব্যবহৃত হতো। সেই বিশেষ দিনটায় ফিরতে ইচ্ছা করছিল বারবার। মানসচক্ষে ভেসে উঠছিল ছবিটা- অট্টালিকা চত্বর লোকে লোকারণ্য। পাশে রাখা রেডিও সেট। বিশ্বকবির কণ্ঠ বেজে উঠবে তাতে। একখানা যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী থাকা। আসলে ওই মেলাতে না পারা আর মেলাতে যাবার চেষ্টা করার অসহায়ত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা ভাবছি, তা যেন সবই গল্পকথা। ইতিহাস নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলা বাঙালির বুঝি এতটা ইতিহাস-বিস্মৃত হওয়া সাজে না।
তথ্যসূত্রঃ পাহাড়ে পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ-রতন বিশ্বাস, পেপার কাটিং( আনন্দবাজার, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, বিভিন্ন ব্লগ, গুগল সার্চ, বঙ্গদর্শন ওয়েব, দুলাল রায়-সম্পাদক, মিলনী ক্লাব, কালিম্পং, শিশির রাউত-মংপু, জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগার।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri