কালিম্পং-এর সেই মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের দিনগুলি/গৌতম চক্রবর্তী
কালিম্পং-এর সেই মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের দিনগুলি
গৌতম চক্রবর্তী
------------------------------------------------------------
আমার চিরসখা রবীন্দ্রনাথকে পাহাড় কোনোদিনই খুব বেশি টানেনি। আজন্ম রোম্যান্টিক, প্রকৃতিপ্রেমিক কবি অপার্থিব সৌন্দর্যের পাহাড়ি ঠিকানা পছন্দ করতেন না একথা ভাবতে একটু কষ্ট হলেও এটাই কিন্তু ধ্রুব সত্য। কারণ পাহাড়ের দূর্গমতার জন্য চারিদিকে প্রাণের অভাব তাঁকে টানত না। সেই তুলনায় নদীর গতিময়তা তাঁকে চিরচঞ্চল করে রেখেছিল আজীবন। প্রতিমা দেবী লিখেছেন- ‘বাবামশায় পাহাড় পছন্দ করতেন না, নদীর ধারই ছিল তাঁর প্রিয়। বলতেন, নদীর একটি বিস্তীর্ণ গতিশীলতা আছে, পাহাড়ের আবদ্ধ সীমার মধ্যে মনকে সংকীর্ণ করে রাখে, তাই পাহাড়ে বেশিদিন ভালো লাগে না।’ ৪.৪.১৯৩৮ তারিখে অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর লাইভ ব্রডকাস্টের এক মাস আগে মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে জানতে পারলাম প্রতিমা দেবী যখন গুরুতর অসুস্থ তখন ডাক্তারের পরামর্শে পাহাড়ি খোলা হাওয়ায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আসার বাসনাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের মৈত্রেয়ীকে লিখলেন-
“কল্যাণীয়েসু (য়াসু)
বীরেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকে তাদের কালিম্পঙের বাড়ি চাবা মাত্র তারা উৎসাহপূর্ব্বক দিয়েছে ………. বউমাকে ডাক্তার দীর্ঘকাল পাহাড়ের হাওয়ায় রাখতে চায়, তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা ও অনুচরবর্গ থাকে, এই উপলক্ষ্যে আমার ভগ্ন শরীরের ভার তার উপর দিতে চাই- আমার এখন দরকার মাতৃশুশ্রূষার……………
জীবনের উপান্তে এসে কবি নিভৃত বিশ্রামের জন্য বেছে নিলেন কালিম্পং শৈলাবাস। আসলে কালিম্পং পাহাড় টানছিল রবীন্দ্রনাথকে। তারিখটা ২৬ শে এপ্রিল, ১৯৩৮। সেই সময় দ্বিতীয় চীনা-জাপানি যুদ্ধ চলছে। তখন তাঁর বয়স আটাত্তর বছর। একেই বয়সের বাধা। তার উপর বিশ্বভারতীকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের শরীরকে একটু বেশিই অবহেলা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফলত বড় রোগ সেই অর্থে না থাকলেও পুরনো ছোটোখাটো রোগ থেকে মাঝেমাঝেই সংক্রমণ হতো। কিন্তু কবি গুরুতর অসুস্থ হলেন এই সময়। এরকম কঠিন অসুখ এবং বয়সজনিত ঝুঁকির কারণে সারাজীবন ধরে স্বাধীন চলাফেরায় অভ্যস্ত আত্মনির্ভর মানুষটাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষজীবনে পরনির্ভর হতে হয়েছিল। নইলে একসময়ে যে কবি কন্যাসমা মৈত্রেয়ীকে স্বয়ং লিখেছেন -‘ভালোবাসি সমতল দেশকে, মাথা উঁচু পাহাড়ের নজরবন্দী আমার বেশি দিন সয় না, তাছাড়া সারাদিন শীতবস্ত্রের আবেষ্টনকে আমি দৌরাত্ম্য বলেই মনে করি।’ আবার আরেকটি চিঠিতে লিখছেন- ‘বাংলাদেশের মতোই আমার মনটা নদী-মাতৃক।’ মৈত্রেয়ীর আমন্ত্রণে সেই কবি লিখলেন
“কল্যাণীয়াসু
মৈত্রেয়ী, শারীরিক মানসিক আবহাওয়ার চাঞ্চল্যবশত কর্ম্মসূচি পাকা করে স্থির করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখনকার মতো কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারছিনে। কিন্তু মনে রইল তোমার নিমন্ত্রণ যদি সহজে সম্ভাব্য হয় তো হয়ে যাবে। ইতি
স্নেহরত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮। ৩। ৩৮
কবি শিলিগুড়ি থেকে মোটর যোগে দার্জিলিং জেলার পূর্বপ্রান্তে কালিম্পংয়ে সেই প্রথমবার পদার্পণ করবেন এ রকম কথা হল। এখন যার নাম মহানন্দা স্যাংচুয়ারি সেই সময়ে সেটা ছিল বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল। এই বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছিল তিস্তা ভ্যালি এক্সটেনশন রেলওয়ের লাইন। এটা ছিল দার্জিলিং-হিমালয়ান রেলওয়েরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। মোট ৫১ মাইল পথ। স্টেশনগুলি ছিল শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি রোড জংশন, সেবক ফরেস্ট সাইডিং, সেবক, সাড়ে তেরো মাইলস, কালিঝোরা, রেলি সাইডিং, রিয়াং এবং গেলখোলা বা কালিম্পং রোড। গেলখোলাকে বহু জায়গায় গেলিখোলা বা গিয়েলখোলা বলা হয়েছে। গেলখোলার রেলওয়ে কোড নেম ছিল GEKA। ‘খোলা’ মানে নদী। এটি ছিল সুন্দরী তিস্তার উপত্যকা বরাবর। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, ঝর্ণা সব মিলিয়ে অপরূপ প্যাকেজ। সেই রেলপথে প্রায়ই দেখা মিলত বন্যজন্তুর। চিতাবাঘ, হাতি, হরিণ, কখনও কখনও নদীতে জল খেতে দেখা যেত স্বয়ং ডোরাকাটাকেও। সন্ধে হলেই স্টেশন কোয়ার্টার থেকে আর বেরোতেন না আবাসিক কর্মীরা। গেলখোলার উল্লেখ মৈত্রেয়ী দেবীর ‘স্বর্গের কাছাকাছি’তে রয়েছে। সেসময়ে কালিম্পঙে আসতে হলে পর্যটকেরা গেলখোলা অবধি আসতেন, তারপর লাইন পেরিয়ে গরুর গাড়ি অথবা পায়ে হেঁটে কালিম্পঙে পৌঁছতেন। এই রেলপথটির তত্ত্বাবধানে ছিল গিলিন্ডার্স অ্যান্ড আরবুথনট কোম্পানি। গরুর গাড়ির পরিষেবাটিও তাদেরই প্রদত্ত ছিল। ১৯৫০ সালে তিস্তার বিধ্বংসী বন্যায় এই লাইনটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। আর এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনও প্রয়াস দেখায়নি সরকার। ১৯৫১ সালে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয় তিস্তা ভ্যালি এক্সটেনশন রেলওয়ে।
২৫শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে কবির অতিথি হয়ে এসেছিলেন পরিব্রাজক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল। তখন তিনি ‘যুগান্তরে’র সম্পাদক। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এ তিস্তা ভ্যালি রেলপথের সেই যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। অবশ্য এই লেখা তিনি যে সময়ে লিখছেন সেটা ১৯৫০-এর পরে। ততদিনে উপত্যকার বুক চিরে যাওয়া সেই রেলওয়ের সলিলসমাধি হয়ে গেছে। প্রকৃতির রোষের কাছে মানবশ্রেষ্ঠ জাতির প্রযুক্তিও হার মেনে গেছে। তখন মোটরগাড়িই একমাত্র ভরসা। তিস্তার ওপরের সেতু সেবক করোনেশন ব্রিজ নামে খ্যাত ছিল। শিলিগুড়ি থেকে এসে গাড়ি ঘুরত সেবকপুলের দিকে। গেলিখোলার পুরনো রেললাইনের গা বেয়ে। সেই পথ চলে গিয়েছিল পাহাড়-পর্বতের অন্তঃপুরে। গেলিখোলার পুরনো রেলপথটি ছিল মোটর পথের পাশে পাশে। রবীন্দ্রনাথ সেই মোটর পথে এসেছিলেন। কবিগুরু আসার আগের দিন রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমাদেবীও এ পথে কালিম্পঙে পৌঁছালেন কবি আসবেন বলে তার সমস্ত আয়োজন পূর্ণ করার জন্য। তিস্তার দুরন্তপনার জন্য পরবর্তীকালে এপথে ট্রেন চলাচল আর সম্ভব হলো না। জলের ধাক্কায় লোহার লাইন মুচড়ে যায়, স্লিপারগুলি উৎখাত হয়ে অদৃশ্য হয় এবং গেলিখোলা রেল প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা গুরুদেবকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেন। ছোট কালিম্পং শহরে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। সরল এবং হৃদয়বান কালিম্পঙের মানুষ জানতেন, কবির শরীরটা ভাল নেই। সে কারণে তাঁরা তাঁকে বিরক্ত করতে চান নি। তাঁরা ঠিক করলেন একটা তোরণ তৈরি করবেন। কালিম্পং থানার সামনে পাইন আর ওক গাছের পাতা এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল তোরণ।
১৯৩৮ এর ২৬ এপ্রিল কালিম্পংয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় দিন। শঙ্কা কাটিয়ে নির্জনতা প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ এসে পৌঁছলেন কালিম্পঙে। কবিকে নিয়ে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ গাড়ি কালিম্পং পৌঁছল। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দ, বেদজ্ঞানী অ্যাটর্নি হীরেন দত্ত। তোরণের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলেন গুরুদেব। তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হল মালা। কবি আর তাঁর সহযোগীরা এ বিষয়ে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। পাহাড়ের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার পরিমাপে অনাড়ম্বর অভ্যর্থনা। কালিম্পঙে এসে চির সখা কবি এটা ভেবেও বেশ খুশি ছিলেন যে ২৫ শে বৈশাখ বেশ শান্তভাবে কেটে যাবে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। ১ লা মে গৌরীপুর ভবনে প্রায় তিনশো লোকের সমাগম হয়েছিল সকলের ‘প্রাণের ঠাকুর’কে দেখার জন্যে। সকলেই স্থানীয় মানুষ। সে সময় গরমের ছুটি কাটাতে আসা বাঙালিরাও এসে ভিড় করতেন গৌরীপুর লজে। কবিও শহরের নানা অনুষ্ঠানে যেতেন। মানুষের একান্ত আপন কবিকে স্বাগত জানানোর জন্য এমন অনাড়ম্বর আন্তরিকতাই বুঝি শ্রেয়। নতুন দেখা কালিম্পং তাঁকে সত্যিই মুগ্ধ করতে পেরেছিল। ঠিক হল ১৯৩৮ সালে কবির ৭৮ তম জন্মোৎসব পালিত হবে পাহাড়ের শান্ত পরিবেশে। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ‘ জন্মদিন’ কবিতাটি গৌরীপুর ভবনে বসে লেখা হল। ঠিক হল কবি সেই দিনকার সেই ২৫ শে বৈশাখের সন্ধ্যায় দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি নবরচিত কবিতা বেতারযোগে পাঠ করবেন।
পরিব্রাজক, সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল ‘দেবতাত্মা হিমালয়ে' গৌরীপুর হাউসে কবির জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ করেছেন। মংপু থেকে ড: মনমোহন সেন, মৈত্রেয়ীদেবী, চিত্রিতাদেবী এলেন। সেন পরিবার ছাড়াও ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে কবির অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘যুগান্তরে’র সম্পাদক পরিব্রাজক-সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল। কবির জন্য যুগান্তরের ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা’র বেশ কিছু কপি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘দেবতাত্মা হিমালয়’-এ সেই যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার। তাঁর ভাষাতেই, “সেটা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ এবং বাংলা তারিখ ছিল ২৫ বৈশাখ। মহাকবির জন্মদিনে আমরা যাচ্ছিলুম কালিম্পং-এ। রবীন্দ্রনাথ তখন সেখানে”। সময়কাল ১৯৩৮। সেই সময় অশোককুমার সেন ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার কেন্দ্র অধিকর্তা। কবিকণ্ঠে জন্মদিন কবিতা সম্প্রচার করার জন্য কালিম্পং ট্রাংক টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। গৌরীপুর ভবন থেকেই ১৯৩৮ সালের ২৫ বৈশাখ আকাশবাণীর বেতার-তরঙ্গে কবির বিখ্যাত 'জন্মদিন' কবিতাটি পাঠ করার উদ্যোগ আয়োজন করা হল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে যোগাযোগ হল কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে কালিম্পঙের। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ কালিম্পং এসে পৌঁছলেন। এসেছিলেন বেতার-বিশেষজ্ঞ নৃপেন্দ্র মজুমদার যিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ভারতীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রযোজক ছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যাল লিখছেন- “আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ঝড়ও ছিল প্রচন্ড। বৃষ্টি, পাহাড়ের ভাঙন, দূর্যোগের ফলে রাস্তায় কয়েকদিন আগে পোঁতা টেলিফোনের খুঁটিগুলি উপড়ে পড়েছিল। অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে এল। টেলিফোন সংযোগ কয়েকবার পরীক্ষা করা হল। সেদিনই কবির হাতে দূরভাষ কেন্দ্রের উদ্বোধন হবে। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে জুড়বে কলকাতা আর কালিম্পং। টেলিফোন পরীক্ষা হল বারবার”।
ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল দুরপিন পাহাড়ের অস্তাচলে। সাড়ে সাতটা কী আটটার সময়ে বেল বাজল। কবি গিয়ে বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। সকলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। কবি গৌরীপুর ভবনের একটা ঘরে বসে আছেন। দরজা, জানালা বন্ধ। বাইরে থেকে যেন কোনও শব্দ ভিতরে ঢুকতে না পারে। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল অবাঞ্ছিত শব্দের হাত থেকে মুক্তি পেতে। বাইরে রাখা আছে রেডিও সেট। কবির আবৃত্তি কলকাতা ঘুরে ব্রডকাস্ট হবে সেই যন্ত্রে। সোজা কলকাতা পৌঁছে বেতারে ছড়িয়ে পড়বে দেশ জুড়ে। সকলেই তখন প্রচন্ড কৌতূহলী। সকলের মধ্যে জন গ্রাহামও ছিলেন। বাড়ির চারিদিকে বসানো হয়েছিল টেলিফোনের তার। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, আবেগ, ইতিহাস সব একাকার হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সৌজন্যে ওই একটি মানুষ। প্রবোধ সান্যাল লিখছেন- “মহাকবি মাঝে মাঝে একবার ভীষণ শব্দে গলা ঝাড়া দেন, একথা সকলেরই মনে আছে। কিন্তু কাব্য পাঠকালে সেই আওয়াজটির দাপটে সূক্ষ্ম যন্ত্রটা বিদীর্ণ হয়ে যাবে কিনা এই আশঙ্কাটা ছিল রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকের মনে। সেজন্য উদ্বেগও ছিল”। তখন সাড়ে সাতটা থেকে আটটা। গৌরীপুর ভবনের ঘরে বসে কবির কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হল ‘‘আজি মম জন্মদিন / সদাই প্রাণের প্রান্তপথে /ডুব দিয়ে উঠেছে সে / বিলুপ্তির অন্ধকার হতে /মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।…(জন্মদিন, সেঁজুতি)। টানা পনেরো মিনিটের পাঠ। একটি দীর্ঘ কবিতা। নাম ‘জন্মদিন’। পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। আবৃত্তি শেষ। সেই পাঠ ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা, সেখান থেকে দিল্লী, বোম্বাই, লখনৌ, পেশোয়ার, লাহোর। একই সময়ে ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত মুখরিত হল বিশ্বকবির উদাত্ত কণ্ঠের মাদকতায়। সেই মায়াবী মুহুর্তের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন প্রবোধকুমার-“আমাদের পায়ের নীচে কালিম্পং থর থর করতে লাগলো কিনা সেকথা তখন আর কারো মনে রইলো না। জ্যোৎস্না ছিল সেদিন বাইরে। একটা মায়াচ্ছন্ন স্বপ্নলোকের মধ্যে আমরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিলুম। ভুলে গিয়েছিলুম পরস্পরের অস্তিত্ব।” প্রথম লাইভ ব্রডকাস্ট। কালিম্পঙের সাথে কলকাতার দূরভাষ যোগাযোগটিও সেদিনই স্থাপিত হল, যোগ্যতম লোকের হাতেই। ধীরে ধীরে কালিম্পঙের পাহাড়ি নির্জনতাও ফিরে এল।
১৯৩৮ সালে কালিম্পঙের ঐতিহাসিক রেডিও অনুষ্ঠানের পর ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চার বার, প্রতিবার অন্তত মাস দেড়েক-দুয়েকের জন্য রবীন্দ্রনাথ এসে মংপুতে থাকতেন৷ কখনো শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি, কখনও বা কালিম্পং হয়ে। শেষবার যখন মংপু এলেন ১৯৪০ সালে সেবার আগে কালিম্পং এসেছিলেন। তারপর একদিন পরেই মংপু যান। কিছুদিন মংপুতে কাটিয়ে আবার কালিম্পঙে ফেরেন। কালিম্পঙে ৭ই মে থেকে ২৯ শে জুন এই পৌনে দু’মাস কাটিয়েছিলেন। কবির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সংবাদপত্রে তখন নিয়মিত খুঁটিনাটি খবর প্রকাশিত হতো। দেশবিদেশ থেকে খবর জানতে চেয়ে চিঠি আসত। গান্ধীজী নিয়মিত টেলিগ্রাফ পাঠাতেন। কবির শরীরের অবস্থা জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাতেন দেশ বিদেশের শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রনায়কেরা। দেশের দুঃসময়েও তাঁরা যে কবির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেছেন, কবি তাঁর চিঠিতে সেই কারণে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। ১৪ই জুন, ১৯৪০। সুসভ্য সভ্যতার তখন বিকৃত রূপ। এই রূপ দেখার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। কালিম্পঙে বসেই খবর পেলেন জার্মান বাহিনী ফ্রান্সের অনেকটাই দখল করে ফেলেছে। তখন রোজ সবাই মিলে গৌরীপুর হাউসে রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনতেন। নাৎসি বাহিনীর হাতে প্যারিসের যেদিন পতন হল গৌরীপুর ভবনে তখন মৈত্রেয়ী দেবীরাও এসেছেন। মাদমোয়াজেল বসনেক নামের একজন ফরাসী মহিলা তখন থাকতেন কালিম্পঙে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত। নিয়মিত আসতেন গৌরীপুর ভবনে। ফ্রান্সের এই দূর্দিনে সকলেই তখন খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। শয়তানের করাল থাবায় ধরাশায়ী হয়েছে শিল্পকলার রাজধানী। প্যারিসের পতন তখন অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধের খবর বিশেষ মনোযোগ সহকারে শোনা হতো।
সেদিন রবীন্দ্রনাথের শরীরটা ক্লান্ত ছিল, চুপচাপ বিশ্রাম করছেন। হঠাৎ দরজার কাছে উত্তেজিত অথচ মৃদু কণ্ঠস্বরে ‘গুরুদেব’ বলে মাদমোয়াজেল ঘরে ঢুকে তাঁর বিছানার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে জানালেন প্যারিসে ‘ডাকঘর’ নাটক অভিনয় হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ উঠে বসলেন। মনের ভিতরে একটা নাড়া লাগল। একটু স্তব্ধ হয়ে থেকে আবার যেমন ছিলেন তেমনি শুয়ে পড়লেন, শুধু উত্তেজিতভাবে পা নড়ছিল। (অথ্যসূত্র-‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’)। শত্রুপক্ষের হাতে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করার আগের রাতে প্রচারিত হল শেষ রেডিও ব্রডকাস্ট। সেইটিই ছিল ‘The Post Office’-এর ফরাসী অনুবাদের নাট্যাভিনয়। ধ্বংসলীলার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে The Post Office’-এর ফরাসী অনুবাদটি করেছিলেন ফরাসী লেখক আঁদ্রে জিদ, যিনি ১৯৪৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মানব-দরদী মহামানবের কাছে মানবতার এমন ভূলুণ্ঠন সেই সম্মানের আনন্দকেও ম্লান করে দিয়েছিল। মাঝেমাঝেই বিষণ্ণ হয়ে যেতেন কবি। কালিম্পঙে থাকাকালীন কবির কেবলই মনে পড়েছে একদিন পশ্চিমের মানুষ তাঁকে কীরকম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিল। যে হাঙ্গেরিতে মানুষ উপচে পড়েছিল শুধু তাঁকে দেখবে বলে, তাদের এই ফ্যাসিবাদী নখ-দন্ত প্রদর্শন তিনি কোনোভাবেই সেইসব দিনের সাথে মেলাতে পারেন নি। প্যারিসের পতনের পরদিন ১৫ই জুন কালিম্পং এর গৌরীপুরের বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টকে টেলিগ্রাফ করলেন। আমেরিকা তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু মিত্রশক্তিকে সেনা ও প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দিয়ে চলেছে নিয়মিত। কবির মনে হয়েছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বুঝি একমাত্র থামাতে পারে আমেরিকাই। কবির ভাবনা পুরোপুরি সঠিক ছিল এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আসলে কবি চেয়েছিলেন এই মারণলীলার দ্রুত অবসান। অন্তত জীবদ্দশায় সেটাই দেখে যাওয়া তাঁর অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু কাব্যিক বাণী যুদ্ধবাজ রাজনীতিকের কাছে কোনওরকম মূল্য পাবে না, এ তো জানাই কথা।
তথ্যসূত্র (দেবতাত্মা হিমালয়ঃ প্রবোধকুমার সান্যাল, মংপুতে রবীন্দ্রনাথঃ মৈত্রেয়ী দেবী, স্বর্গের কাছাকাছিঃ মৈত্রেয়ী দেবী, পাহাড়ে পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথঃ রতন বিশ্বাস, বঙ্গদর্শন ব্লগ, আনন্দবাজার ডিজিটাল, সেই সময় ডিজিটাল, সোহম সাহা- ব্লগ দুনিয়াদারি, সাক্ষাৎকার- দুলাল রায় সহ আরো বহু বিশিষ্টজনেদের সাক্ষাৎকার। প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা জানাই)
ছবি : সংগৃহীত
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴