কল্পবিজ্ঞান, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এবং বেগম রোকেয়া শাখাওত হোসেন/মাল্যবান মিত্র
কল্পবিজ্ঞান, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এবং বেগম রোকেয়া শাখাওত হোসেন
মাল্যবান মিত্র
কল্পনার দৌড় যে লিঙ্গভেদ মানেনা সেটা পৃথিবীব্যাপী শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসৃষ্টিগুলোর দিকে চোখ ফেরালেই স্পষ্ট বোঝা যায় অথচ আজো আমাদের দেশের রোগ-নির্নায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোতে “ কন্যাসন্তান কে রক্ষা করুন “ এই মর্মে বিভিন্ন পোষ্টার দেখাযায়, বুদ্ধি ও কৃষ্টির গর্বে বলীয়ান বঙ্গদেশে নারীবাদী লেখিকাকে দেশান্তরি হতে হয়, কর্মক্ষেত্রে ধর্ষণ হয় একজন মহিলা চিকিৎসকের। ইতিহাস বলে আজ থেকে মাত্র একশো পচিশ বছর পূর্বে বিশ্বের কোনো সমাজেই নারীদের ভোটাধিকার বলে কিছু ছিল না। আজকের সংজ্ঞায় নারী-অধিকার বলে কোনো কিছু ছিল না। কোথাও ছিল না সরকারী বা বেসরকারী সংস্থায় চাকরির অধিকার, এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে আদালতে সাক্ষ্য দেবার অধিকার থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রেই তা ছিল উপেক্ষিত। ভারতবর্ষে, এবং বিষেষত বাংলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম সমাজে এই চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত বনেদি জমিদার পরিবারের এক কন্যার বিয়ের কাবিন নামায় স্পষ্ট করে লেখা ছিল, শাসনের প্রয়োজনে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে মুখমণ্ডল ব্যতীত শরীরের অন্যান্য স্থানে বেত্রাঘাত করিতে পারিবেন, তবে যেন তাহার কোনো দাগ না পড়ে! দেড়শত বছর আগেও যাবার প্রয়োজন নেই। মাত্র সাত আট বছর আগে প্রকাশিত লেখিকা নূরজাহান বোসের 'আগুনমুখার মেয়ে' আত্মজীবনীতে নারীর প্রতি পুরুষের সমাজ স্বীকৃত অত্যাচারের কথা পড়লে, পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে নিজেদের মুক্তমনা - আধুনিক বা শিক্ষিত বলতেও প্রবল কুন্ঠাবোধে ভুগতে হয়।
সময়টা ১৯০৫, ভাগলপুরের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ শাখাওত হোসেন, নিজের সরকারি কাজ শেষকরে একদিন নিজের বাসস্থানে ফিরে, নিজের লেখার ঘরের অগোছালো টেবিলে খুঁজে পেলেন একটি ইংরেজি ভাষায় হাতে লেখা একটি গল্পের পান্ডুলিপি, পান্ডুলিপির উপরে লেখা, ‘ সুলতানাস ড্রিম ‘, লেখকের নাম বেগম রোকেয়া শাখাওত হোসেন ; নিজের স্ত্রীর প্রথম পূর্নাঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টি পড়ে চমকে গেলেন সৈয়দ শাখাওত হোসেন, স্ত্রীকে বললেন ‘ এ দেখছি নির্মম প্রতিশোধ ‘ অবাক হলেন পর্দানশীন, অবরোধবাসিনীর কল্পনার দৌড় দেখে। ইংরেজিতে লেখা বলে পান্ডুলিপিটি শাখাওত হোসেন নিয়ে গেলেন ভাগলপুরের তৎকালীন ম্যজিস্ট্রেট ও ইংরেজিতে পন্ডিত চার্লস ম্যকফারসন এর কাছে নিয়ে যান দেখে দেবার জন্য। সেই লেখা পড়ে এর গায়ে সামান্যতম আঁচড় কাটেননি ম্যাকফারসন। পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে একটা সংযুক্ত পত্রে তিনি লিখেছিলেন, “এতে প্রকাশিত ধারণাগুলি বেশ আনন্দদায়ক এবং মৌলিকত্বে পূর্ণ এবং সেগুলি নিখুঁত ইংরেজিতে লেখা।”
এই বইয়ের ইংরেজি ভাষার বিশুদ্ধতার বিষয়ে বাঙালি পাঠকেরাও অবগত ছিলো। সাধনা পত্রিকাতে বইটার একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছিলেন আবুল হুসেন। তিনি সুলতানা'স ড্রিমের বিশুদ্ধ ইংরেজির বিষয়ে লেখেন, “পুস্তিকাখানি যেরূপ সুমার্জিত বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় লেখা, সেরূপ ভাষা আয়ত্ত করা আমাদের অনেক ইংরাজি-শিক্ষিত যুবকের পক্ষে কঠিন।" ১৯০৫ সালেই মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সুলতানা'স ড্রিম। ১৯০৮ সালে এটা পুস্তকাকারে বের হয়ে আসে। ১৯২২ সালের এটার বাংলা অনুবাদ করেন বেগম রোকেয়া নিজেই। নামকরণও করা হয় আক্ষরিকভাবেই, 'সুলতানার স্বপ্ন'।
মার্কিন কিংবদন্তী কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের মতে কল্পবিজ্ঞান হচ্ছে 'সাহিত্যের একটি শাখা যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত হয়'। এর সাথে বাঙালি ও ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান গবেষকরা আইজ্যাক আসিমভের আরো একটি উক্তি যোগ করে থাকেন, তা হচ্ছে 'মানুষ যতক্ষণ বিজ্ঞানের যথার্থতা বা যৌক্তিকতা বুঝতে পারবে না এবং তা তাঁদের গল্পের উপযোগী করে ব্যবহার করতে পারবে না, ততক্ষণ সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞানের জন্ম হবে না'। এর বাইরেও বিভিন্ন লেখক কল্পবিজ্ঞানকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সুক্ষ্মতা বিবেচনায় তাতে মতভেদ থাকলেও মোটা দাগের সংজ্ঞাটিতে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁদের মতে কল্পবিজ্ঞান হলো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকে কল্পনা দ্বারা প্রসারিত করে ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনো অবস্থাকে গল্পে রূপদান।
এভাবে কল্পবিজ্ঞান রচনার প্রথম শর্ত হচ্ছে এটি হতে হবে কাল্পনিক। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে কল্পনাটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। আর অধিকাংশ লেখকের মতে কল্পবিজ্ঞানের তৃতীয় শর্তটি হতে হবে ভবিষ্যতমুখী। অর্থাৎ আজকের বৈজ্ঞানিক-কারিগরি তথ্য বা জ্ঞান ভবিষ্যতে অনেক উন্নত হয়ে বর্তমানে বিরাজমান অথবা ভবিষ্যতে উদ্ভুত যোগ্য নতুন কোনো সমস্যার সমাধানে কাল্পনিক গল্প। সেই ভবিষ্যৎটি হতে পারে যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মতভাবে অথবা ফ্যান্টাসি বা অবাস্তবসম্মতভাবে। বিখ্যাত ফরাসী লেখক জুল ভার্ন রচিত 'এরাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ', 'টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দি সি', এবং 'ফ্রম দা আর্থ টু দা মুন', তেমনি তিনটি বাস্তবসম্মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যার সবগুলো কল্পনাই ভবিষ্যতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কল্পনাটি যদি বাস্তবসম্মত না হয়, তবে সেটি হয়ে যেতে পারে আষাড়ে, আজগুবি, যাদু অথবা রূপকথার গল্প। তা হলেও সেটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হতে পারে, যেমনটি হয়েছে ইংরেজ লেখিকা মেরি ওয়োলস্টোনক্রাফট শেলী'র ফ্রাংকেস্টাইন বইটির ক্ষেত্রে, যদিও কেউ কেউ এতে দ্বিমত প্রকাশ করবেন। কিন্তু উল্লিখিত দুই ব্যক্তির লেখাগুলো ভবিষ্যতমুখীই ছিল।
অন্যদিকে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও বর্তমান সময়ের বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সবচেয়ে সোচ্চার, অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্যের মতে 'কল্পবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকে কল্পনা দ্বারা প্রসারিত করে যে জগৎটি সৃষ্টি করা হয় সেটি একটি বিকল্প অবস্থা। দেশ-কাল বিচারে এই বিকল্পতার সময় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বা কালোত্তীর্ণ হতে পারে'। তাঁর মতে 'বিজ্ঞান কল্পকাহিনির কাজ হলো প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও জৈবিক এবং বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগৎটির অবতারণা। অনেক সময়ই গল্পে আমরা এমন সমস্ত প্রক্রিয়া বর্ণনা করি যা হয়তো ভবিষ্যতেও কখনো বাস্তবায়িত হবে না (যেমন আলোর গতিবেগের বেশিতে বা অন্য একটি মহাবিশ্বে ভ্রমণ), কিন্তু লেখক যদি সেই প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তির ভিত্তিতে কোনো নীতি প্রণয়ন করেন তাহলে সেটি (বিজ্ঞানকে ভাঙলেও) বিজ্ঞান কল্পকাহিনি হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে'।
বেগম রোকেয়ার 'সুলতানার স্বপ্ন' কি উপরে উল্লিখিত কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পুরণ করতে পেরেছিল? এক কথায় এবং জোড়ালোভাবে উত্তর হলো হ্যাঁ, এবং অবশ্যই। প্রথমতঃ উপন্যাসটি ছিল কাল্পনিক। কল্পনাটি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল এবং আছে। দ্বিতীয়তঃ এটি ছিল সমসাময়িক অন্ততঃ চারটি প্রধান প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপরে ভিত্তি করে রচিত। তৃতীয়তঃ বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দুটি ক্ষেত্রেই বেগম রোকেয়ার কল্পনাটি ছিল ভবিষ্যতমুখী। সবচেয়ে বড় কথা হলো ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর কল্পনাটি ছিল যৌক্তিক বা বাস্তবসম্মত; মস্তিষ্কের লাগামহীন চিন্তা-প্রসূত নয়। ফলে আজ থেকে সোয়া'শ বছর পূর্বে ভবিষ্যতের যে যে অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতির কথা তিনি লিখে গেছেন, বিগত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর থেকে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়ে চলেছি আজও। এভাবে বাংলা কল্পবিজ্ঞান গবেষকদের ওপরে উল্লিখিত আইজ্যাক আসিমভের প্রিয় উদ্ধৃতিটির শর্তটিও পুরোপুরি পূরণ করা হয়েছে। এমন কি কল্পবিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্যের আধুনিক সংজ্ঞায় 'বৈজ্ঞানিক নীতি বা গঠনকে ভেঙে সেই ভিন্ন জগৎটির অবতারনা'র কথা যা বলা হয়েছে, সুলতানা'স ড্রিম উপন্যাসটি সেই শর্তও পূরণ করেছে। ভারতের নারীশিক্ষা-উপেক্ষিত ও বঞ্চিত সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্কুলে না গিয়ে, আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি কীভাবে তখনকার উন্নততর বিজ্ঞানের সন্ধান পেয়েছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এ নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে বলে মনে হয় ।
সময়ের দিকনির্দেশনা পেরিয়ে ‘সুলতানার স্বপ্ন ‘ এক অভিনব প্রচেষ্টা। লেখিকার সময়ে সমাজকে যেভাবে পুরুষরা নিয়ন্ত্রণ করেছে, নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নিয়ে নারীদের অন্তঃপুরে বন্দী করেছে, অবগুণ্ঠিত করেছে, সেটাকেই একেবারে উল্টো করে দিয়ে নতুন এক সমাজের কল্পনা করেছিলেন বেগম রোকেয়া। আমাদের সমাজে এটা একটা অভিনব প্রচেষ্টা হলেও, সাহিত্য গবেষক গোলাম মুরশিদ এটাকে মৌলিক ভাবনা মনে করেন না। তিনি তাঁর " নারী- প্রগতির একশো বছর: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া" বইতে লিখেছেন, “সুলতানা'স ড্রিমে যে নারীস্থান এবং নারীর আধিপত্যের কল্পনা, তা অভিনব অথবা মৌলিক নয়। এরিস্টোফেনিসের লাইসিসট্রাটা এর সর্বপ্রথম নিদর্শন, খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। উপন্যাসে এভাবের প্রতিফলন ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে একেবারে অনুপস্থিত নয়। তৎসত্ত্বেও বলা যায়, সুলতানা'স ড্রিম নামে স্বপ্ন, উচ্চতর কোনো দাবি বা ভানও নেই লেখিকার, তবু তাঁর স্বপ্ন একেবারে আজগুবি নয়। বরং তাঁর মধ্যেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রতিবিম্বিত। ইতিমধ্যে মহিলাদের সামাজিক এবং পারিবারিক ভূমিকায় যে বিবর্তন এসেছে, তা থেকে এই মন্তব্যই সমীচীন।" পুরুষের আধিপত্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত এবং ক্ষুব্ধ রোকেয়া কি প্রতিশোধ নিয়ে চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে পুরুষদের বিরুদ্ধে? বাস্তবে যে প্রতিশোধ সেই সময়ে তাঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিলো না, সেটাকে তিনি অলীক এক রাজ্য কল্পনা করার মাধ্যমে সম্ভব করে তুলেছিলেন। এ কারণেই হয়তো তিনি যখন লেখাটা তাঁর স্বামীকে দেখিয়েছিলেন, তিনি মন্তব্য করেছিলেন এই বলে 'এ দেখি নির্মম এক প্রতিশোধ'। হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে লিখেছেন, “পঁচিশ বছরের এক আমূল নারীবাদী তরুণীর নারী-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে 'সুলতানার স্বপ্ন'-এ, যা কোমলমধুর কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষমাহীন নির্মম। রোকেয়া ব্যাপকভাবে নারীস্থানের সমাজজীবন উপস্থাপিত করেন নি, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করেছেন পুরুষদের। পুরুষের ওই দেশে কী প্রয়োজন, তা তিনি বলেন নি; তবে প্রতিশোধগ্রহণের জন্য পুরুষদের অত্যন্ত দরকার ছিলো সেখানে। রোকেয়া পুরুষজাতিটিকেই বাদ দিতে পারতেন ওই সমাজ থেকে, কিন্তু তিনি দেন নি; তিনি হয়তো মনে করেছেন সামাজিকভাবে পুরুষ দরকার, তবে তার চেয়ে বেশি দরকার পুরুষপীড়নের জন্যে।"
নারীর অধিকার আদায়ের অভিনব পন্থা ছাড়াও, 'সুলতানা'স ড্রিম' আরেক কারণেও অবিস্মরণীয়। বাংলায় লেখা এটাই প্রথম নারী লিখিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও। যদিও এটাকে সেভাবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তার বদলে প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা 'পলাতক তুফান' গল্পটি। যদিও রোকেয়ার বইটা প্রকাশ হয়েছে 'পলাতক তুফান' লেখার অনেক বছর আগেই।
পুরুষের সৃষ্ট কারাগার থেকে বের হয়ে আসা এবং সেই কারাগারে পুরুষদেরই আটকে ফেলার জন্য নারীস্থানের মেয়েরা ব্যবহার করেছিলো বিজ্ঞানকে। পুরুষদের অন্তঃপুরে পাঠানোর পরেও তাদের সেই বিজ্ঞাননির্ভরতা কমেনি। শিক্ষা ও বিজ্ঞানই সব সমস্যার সমাধান, এই মতবাদে বিশ্বাসী রাজ্যের রানীর উৎসাহ ও আদেশে মেয়েদের জন্য অসংখ্য স্কুল ও দু'টো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো। একটিতে সূর্যালোক ও সূর্যতাপের গবেষণা এবং নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে ঘরবাড়ি আলোকিত এবং রান্নার কাজ সহজ করা হলো। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা একটি জল-বেলুন নির্মাণ করে আকাশ থেকে জল সংগ্রহ ও সঞ্চিত করে দেশকে খরার হাত থেকে বাঁচালো। এর ফলে দেশে কৃষি-ফলন বাড়লো। নারী বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বায়ুযানে অল্প সময়ে অধিক দূরত্ব অতিক্রম করা যায়। বায়ুযানের কারণে কোনো সড়ক বা রেল দুর্ঘটনা ঘটে না।
রোকেয়া যে সময়ে এই বৈজ্ঞানিক কল্পনা গুলো করেছেন, সেই সময়টাকে চিন্তা করলে বিস্মিত হতেই হয়। তিনি যে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারসমূহের বিষয়ে অবগত ছিলেন, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। একই সাথে তাঁর কল্পনাপ্রবণতাকেও সাধুবাদ দেওয়া লাগে। তিনি যখন বায়ুযানের কল্পনা করেছেন, তখন তিনি স্বচক্ষে বিমান দেখেন নাই। বিমান দেখেছেন তিনি আরও কয়েক বছর পরে। আর বিমানে ভ্রমণ করেছেন 'সুলতানা'স ড্রিম লেখার পঁচিশ বছর পরে। ১৯৩০ সালে তিনি তাঁর বিমানচালক ভাইপো তথা নিজের দিদি ও ভারতবর্ষের প্রগতিশীল নারী সমাজের অন্যতম মুখ আনম খান চৌধুরীর ছেলে মুরাদের সাথে পঞ্চাশ মাইল ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তাঁর 'বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল' প্রবন্ধে এ বিষয়ে লেখেন, “২৫ বৎসর পূর্বে লিখিত 'সুলতানার স্বপ্নে' বর্ণিত বায়ুযানে আমি সত্যই বেড়াইলাম। বঙ্গের প্রথম মুসলিম পাইলটের সহিত যে অবরোধ-বন্দিনী নারী উঠিল সে আমিই।"
সম্প্রতি ইউনেস্কোর গতশতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কুড়িটি ‘মোস্ট মেমোরেবেল বুকস’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে বেগম রোকেয়া শাখাওত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’, তবে রূপকহীন ভাষায় সাম্প্রতিক বঙ্গদেশ ও তার ঘটনাবলী যে লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ তৈরি বা নারী অধিকার সুরক্ষিত করতে নির্মমভাবে ব্যর্থ তা বারবার প্রমাণিত। আর তাই বেগম রোকেয়ার সুলতানার মতো আজকের নিপীড়িত নারীসমাজ যদি এই পৃথিবীকে গল্পের দার্জিলিং শহর বা ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তবে তা নিশ্চিতরূপে অশনিসঙ্কেত বয়ে আনবে আপামর পুরুষসমাজের জন্য। তাই নারী ও পুরুষের দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে পিছে ফেলে, পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ও সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞানকে সত্যি করে সমাজ ও সময়কে লিঙ্গবৈষম্যহীন করে তোলার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রয়োজন থেকে আশারাখি শুধুমাত্র একটি রাত দখল এর আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে একসাথে সাম্যের গান গাইবে সমস্ত নারী ও পুরুষ জাত আর বতর্মান প্রেক্ষিতে সার্বিকভাবে সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে আজকের সঠিক বোধবুদ্ধি সম্পন্ন প্রগতিশীল মানব সমাজ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴