করোনা কালীন জঙ্গল ডায়েরি/সুনীতা দত্ত
করোনা কালীন জঙ্গল ডায়েরি
সুনীতা দত্ত
ছোট থেকে জঙ্গলের সাথে ওঠাবসা বা বেড়ানো কোনোটাই হয়ে ওঠেনি। ডুয়ার্সের সেই জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ অর্থাৎ যে সময় আমি বড় হয়ে উঠছি, একটু একটু করে পরিবেশকে জানছি (নব্বইয়ের দশক) সে সময় সুযোগ আসেনি কোনো জঙ্গলকে বা জঙ্গলের পরিবেশকে দেখার। সুযোগটা প্রথম আসে ২০০০ সালের দিকে। বন্ধুরা মিলে একসাথে বেড়ানো আর সেই সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশকে কাছে থেকে দেখা।প্রথমে লাটাগুড়ি, বাতাবাড়ি হয়ে কিছুটা পাহাড় পেরিয়ে মন ভরে গেল। প্রথম জঙ্গল দর্শন সেই সাথে কাছের বন্ধুরা, সারাদিন ঘুরে মনে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে ফিরলাম। তখন থেকে জঙ্গল বেশ হাতছানি দিত। এর বেশ কিছুদিন পর ঘুরে এলাম বক্সা। আলিপুরদুয়ারের এই জঙ্গল বেশ ভালো লাগল, মনে মনে তখন থেকে ভেবে নিলাম জঙ্গলে ঘুরে তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে হবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে কথা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অনুভবটা আর অনুরণিত হল না সেভাবে। সব ইচ্ছে কোথায় যেন তলিয়ে গেল। তবে প্রকৃতি পরিবেশকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ এল চাকরি জীবনে পদার্পণ করে ।এই সুবাদে নাগরাকাটা আর প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি আসা। কিছুদিন এদিক ওদিক করে ঘুরে ঘুরে কাজ করার পর স্থায়ী কর্মস্থল হল ধূমপাড়া প্রাইমারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীন উত্তর নুনখাওয়া ডাঙ্গা গ্রাম যা আঙ্গরাভাষা ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত।
বছর পাঁচেক ধূপগুড়ি থেকে যাতায়াত করলেও তারপর ঠিকানা বদল, গয়েরকাটা থেকে নিত্যদিনের যাতায়াতের রাস্তা হল মোরাঘাট বিটের অন্তর্গত জঙ্গলের কিছু অংশ। গয়েরকাটা থেকে বাস ধরে মধুবনী নদী পার করে এই জঙ্গলের শুরু। দুইপাশে জঙ্গল কে বুকে নিয়ে মাঝখান দিয়ে পিচঢালা পাকা রাস্তা। এই জঙ্গলের অনেক কর্মী আমদের সাথে বাসে উঠতেন।নোনাই নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এই জঙ্গলে কত যে অচেনা শব্দ শুনেছি তার ঠিক নেই। প্রতিদিনের যাতায়াতের মাঝে ঠিক নোনাই আসার আগেই বিট অফিসের সামনে দিয়ে যাবার সময় সিট্রলিনার গন্ধে কেমন যেন নেশা জড়িয়ে থাকত। সে গন্ধ অবশ্য সব সময় থাকত না, কিন্তু যখন থাকত না তার জন্য মন কেমন করে উঠত। কয়েকজন বনকর্মী যাতায়াতের নিত্য সঙ্গী ছিলেন। তারা মাঝে বাস যখন ধীরে চলত গাছের সাথে পরিচয় করাতেন। মূলত তাদের থেকেই চিকরাশি নামটা প্রথম শুনেছিলাম। আমাকে এক কর্মী একটি মেহগিনি গাছ উপহার দিয়েছিলেন, আমি সেটাকে আমার কর্মস্থলে লাগিয়েছিলাম। কিছুদিন পর দেখলাম সেই মেহগিনি গাছের চারা বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়েদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
মধুবনী নদী পার করে বাস যখন জঙ্গলে ঢুকত প্রচণ্ড গরমেও অচেনা হিমেল বাতাস এসে কানে কানে গল্প করে যেত। দূষণ মুক্ত নিটোল সেই হওয়ার গল্প কাউকে কখনও বলা হয়নি, ওরা মনের অনেক গভীরে আজও বাস করে। আমি ২০০৭ সাল থেকে এই রাস্তায় যাতায়াত শুরু করেছিলাম শুনেছি আমি যে জঙ্গলকে দেখছি সে নাকি আরো অনেক গভীর ছিল। লোকজনের যাতায়াত প্রয়োজন ছাড়া প্রায় ছিল না বললেই চলে। গাড়িও ছিল হাতে গোনা। তখন দিনে দুপুরে ছিনতাই আর বিয়ের গাড়ি গেলেই ডাকাতি হত। সর্বস্ব খোয়া যেতো যাত্রীদের। একদিকে বন্য প্রাণী আর আরেকদিকে ডাকাত দলের ভয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল এই পথ দিয়ে চলাচল। কিছুদিন আগেও অর্থাৎ করোনা কালীন সময়ের আগেও আমি শুনেছি বাইক ছিনতাইয়ের কথা। তবে এখনকার মতো রাতে তখন কোনো যান এই রাস্তায় চলত না।সূর্য ডোবার অনেক আগেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেত।
প্রতিদিনের যাতায়াতে অনেক দিন এমন হয়েছে কয়েক ঘণ্টা বাস কে মাঝ পথে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, দাঁতাল মহারাজ পথ আগলে রাখতেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে নিয়ে। কতবার যে এমন হয়েছে সেটা এখন সংখ্যা দিয়ে আর মনে করতে পারি না।তখন এন্ড্রয়েড ফোনের চল ছিল না বলে ছবি তুলে রাখা হয়নি। আর বর্ষার মুহূর্তে কত যে ময়ূর দেখেছি তারও ইয়ত্যা নেই। প্রতিদিন জঙ্গলের বুক দিয়ে যাওয়া আবার ফিরে আসা মাঝে মাঝে গজরাজের দেখা, ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ শব্দ, সিট্রিলিনার মাতাল সুবাস যেন সারাদিনের নিটোল অক্সিজেন সরবরাহ করে নিয়ে আসত।
সব ঠিকঠাক চলছিল জঙ্গলের গন্ধে ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত আর সেই ভালোবাসার রস নিয়ে বাড়ি ফিরে পরের সকলের জন্য অপেক্ষা করতাম। পৃথিবীর বুকে নেমে এলো সেই ভয়ানক সময়। অতিমারি করোনা হঠাৎ করে সব চিন্তাভাবনাকে গুটিয়ে দিল। কে কতক্ষণ থাকব আদৌ থাকব কি না কেউ বুঝতে পারছিলাম না। সবাই যখন গুটিয়ে নিয়েছে বলা যায় কিছুটা জোর করে গুটিয়ে নিয়েছে তখন আমরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে বাইরে বেরিয়েছি।অনেকক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কিছু না পেয়ে বাড়ি এসেছি। আবার কোনোদিন কারো মোটরবাইক পৌঁছে দিয়েছে গন্তব্যে। তখন জঙ্গলে অবিরত এক শান্তি বিরাজ করত, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হত আকাশ। করোনা বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতি কত কষ্টে ছিল, আজ সে অনেক সুখী। কিছুদিন এই সমস্যা ভোগ করার পর বাড়ি থেকে ঠিক করা হল নিজের দুই চক্র যান নিয়ে কাজ করলেই বিপদ কিছুটা কম। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে আমার সঙ্গী হল আমার এক্টিভা। যাতায়াত নিশ্চিত এখন কি করে সবাইকে ভালো রাখা যায় তার চিন্তা।
শুরু হল করোনা টিকাকরণ। মানুষ যেন আবার ফিরে পেতে চাইল পুরানো জীবনকে। গা ছমছমে ঘটনাটা এই সময়ের সাক্ষী। ২০২১ সালের জুলাই মাস। বর্ষা বিদ্যুৎ গর্জনের এক সন্ধ্যা। দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে, সাথে হালকা ভারী বৃষ্টি দিনভর চলছে।সকালে নির্ধারিত সময়ে নিজস্ব যান নিয়ে ধুমপাড়া হাসপাতালে পৌঁছলাম। করোনা ভ্যাকসিনের ডিউটি।প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ ইনজেকশন দেওয়া হত কয়েকজন মিলে।লোকজনের লাইন থাকত ভোর থেকে।সেদিন ইনজেকশন শেষ করতে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। সকালে বৃষ্টি থাকলেও সারাদিন বৃষ্টি ছিল না। কাজ শেষ করে যখন বাড়ি ফেরার সময় তার আগে থেকেই হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আমি ও আমার সহকর্মী বন্ধু আমাদের নিজস্ব যান নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।সহকর্মীর সাথে আরেকজন যাত্রী, আমি আমার যানে একা। ধূমপাড়া থেকে শর্টকাট বেরোনোর একটা রাস্তা মজরমিলে ওঠে সেই রাস্তা ধরে রাঙ্গতি সেতু পার করে দুরামারি তারপর সোজা পথ ধরে নোনাই। নোনাই পার হতেই আমাদের পরিচিত জঙ্গলে প্রবেশ।বৃষ্টির বেগ ততটা না থাকলেও অনবরত পরেই চলেছে। অন্যদিন সন্ধ্যা নামলেই গ্রামীণ পুলিশ ভাই জঙ্গলের রাস্তা পার করে দিত কিন্তু সেদিন কোনো কারণে কাউকেই পাওয়া যায়নি। নোনাই পার হতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। চালকের আসনে থাকলেও মাঝে মাঝে জঙ্গলের দুই পাশে চোখ চলে যাচ্ছিল।মাঝ পথে খেয়াল করলাম সহকর্মী বন্ধু পিছিয়ে পড়েছে। আমার গতি কমে এল কিছু সময় পর আবার একসাথে। মাঝে একটা ম্যাজিক গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সহকর্মী আবার পিছিয়ে পড়ল। আমি আর গতি কমালাম না, তখন মাথায় চিন্তা বাড়ি কখন পৌঁছবো বাচ্চাটা সকাল থেকে মা ছাড়া। এসব ভাবছি গাড়ির গতি খুব বেশি ছিল না, হঠাৎ করে মনে হলো সামনে কালো রঙের বড় আকারের গরুর মতো কি যেন রাস্তা পার হল। মন ঠিক বুঝে গেল ওটা একটা বাইসন, কারণ আগেও অটোতে যাতায়াতের সময় এমন ঘটনা ঘটেছে। পাশে সহকর্মী তখন চলে এসে বলছে, "ডানদিকে তাকিয়েছিলে?" আমি না বললাম ও আমাকে বলল এখন গতি বাড়াতে পরে বলবে সব। মধুবনির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায় তার আগের বিরুপাক সেতুটা পার হবার আগেই দেখলাম বেশ মোটা একটা লম্বা সাপ রাস্তা পার হচ্ছে। পাশে সহকর্মীকে জোরে বললাম গতি কমাতে। সহকর্মী বেশ দক্ষতার সাথে গতি নিয়ন্ত্রণ করল, আমিও সাধ্যমতো গতি কমিয়ে ফেলেছি সাপটাও ততক্ষণে রাস্তা পার হয়ে গেছে। এখন ওই রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি লাগানো হয়েছে কিন্তু সেই সময় ছিল না। আমাদের মোটরবাইকের আলোয় যা দেখা যাচ্ছিল সেই ভাবেই চলছিলাম।মধুবনীর সামনে আসতেই দেখলাম কয়েকটা বাইক সামনের দিক থেকে আসছে। সহকর্মীকে বললাম তখন কি বলছিলে? ও যা জানাল আমি মনে মনে তাই ভেবেছিলাম। আমি যখন অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম ওরা হঠাৎ ডানদিকে দুটো দাঁতালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। সহকর্মী বলল, "আমি বুঝেছি তুমি খেয়াল করনি, তাই কিছু বলিনি তখন!" আমার এই চালক সহকর্মীটি বেশ অকুতোভয়।একদিন বিকেলে পিছনে ২ জনকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকে ওই রাস্তায় অনেক লোক দাঁড়িয়েছিল। শুনলাম কয়েকটা হাতি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ও কিছু পরোয়া না করে ঝটপট জোরে চালিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। মধুবনি পার করে গয়েরকাটা পৌঁছে সেদিন আমরা তিনজন প্রকৃতিকে জয় করে ফিরেছিলাম।
অভিজ্ঞতা মধুর না হলেও সেই সময়টুকু আজও ভাবলে গায়ে কাটা দেয়। বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম প্রায় পৌনে আটটা বাজে। সেদিন সহকর্মীকে বলা হয়নি বাইসনের কথাটা তবে পরে বলেছিলাম।করোনা না এলে হয়তো আমরা এই পরিস্থিতিতে পড়তাম না আর তখন বুঝতেও পারতাম না জীবনের সাথে আমার অরণ্যপ্রেম সেদিন কিছুটা হলেও ভয়ানক হয়ে উঠেছিল।
তবুও হৃদয়ে রয়ে গেছে সেই দিনের কথা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴