কবির পরশ/সমাপ্তি চৌধুরী
কবির পরশ
সমাপ্তি চৌধুরী
"তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।"
জানো কবি, মনে মনে শতবার একথা বলেছি তোমায়। প্রথম যখন কবিতাটা পড়েছি, মনে মনে ভেবেছি তুমি কাকে উদ্দেশ্য করে একথা বলেছো? ক্রমে বুঝেছি, এ তো আমাদের মত শত শত রবীন্দ্র প্রেমী পাঠকের জন্য। সেই 'সহজপাঠ 'থেকে তোমার সঙ্গে চেনাজানা। তারপর 'শিশু ভোলানাথ'- এর হাত ধরে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠলাম। তোমার সঙ্গে পরিচিতি একটু একটু করে বাড়তে লাগল। ছেলেবেলায় তোমার কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হত, আরে এ তো আমার মনের কথা------ ' রবিবার ' সত্যিই বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, কিন্ত তুমি কেমন করে বুঝলে আমাদের সে ব্যথা? স্কুলের অনুষ্ঠানে যখন 'বীরপুরুষ' আবৃত্তি করেছি, তখন মনে মনে নিজেকে মায়ের রক্ষাকর্তা ভেবেছি। কতবার সত্যি সত্যিই নিজের মনে প্রশ্ন করেছি দুপুর বেলা কেন রাত হয়ে যায় না? 'হাট' কবিতা পড়তে পড়তে চোখের সামনে যেন একটা গ্রামীণ হাটের ছবি ফুটে উঠেছে। তখন বোধহয় ক্লাস ফোর, আমাদের স্কুলে 'অমল ও দইওয়ালা' নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আমি সেখানে অমল চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। রিহার্সাল করতে করতে কতবার মনে হয়েছে,'আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম'-------
মন মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায় তোমার সঙ্গে একান্তে----- হয়ত কখনও আত্রাই নদীতে বোটে করে ভেসে চলা গানের খাতা হাতে তুমি-- সেখানে তোমার সঙ্গী হয়েছি আমি। মাঝিদের সুরের সাথে সুর মিলিয়ে কত অসামান্য সব সৃষ্টি তোমার। তুমিই তো বলেছো--"একাকী গায়কের নহে তো গান/ গাহিতে হবে দুইজনে "------ তাইতো যখন একলা থাকি,তোমার সাথে গেয়ে উঠি " আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে"।
আবার কখনও বা কোনও পঁচিশে বৈশাখের সকালে মংপুর সেই বারান্দায় বসে তোমার ওই উদাত্ত কণ্ঠে যেন শুনছি----- " তোমরা রচিলে যারে
নানা অলংকারে
তারে তো চিনি নে
আমি,
চেনেন না মোর
অন্তর্যামী
তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর
নামের প্রতিমা। "
কালের নিয়মে বেড়ে উঠেছি। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজে এসেছি। প্রথম যেদিন ছাতিমতলায় পা রাখলাম, মন এক অদ্ভুত ভাললাগায় আবিষ্ট হয়ে গেল। মনে হল, এই তো চেয়েছিলাম-- তোমার সেই হাতে গড়া শান্তিনিকেতন-- এখানেই তোমার আদর্শে দীক্ষিত হতে চেয়েছিলাম। যেদিকে তাকাতাম মনে হোত তুমি বিরাজ করছো। শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলো স্বপ্নের মত কাটতো।যেন সবসময় তোমার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। সবকিছুই তোমাকে ঘিরে। যেকোনো অনুষ্ঠান তুমি- ময়। বৃক্ষরোপণ, রাখীবন্ধন, বসন্ত উৎসব, পৌষমেলা, মাঘমেলা----- সব অনুষ্ঠানই তো তোমাকে নিয়ে, তোমার সৃষ্টি নিয়ে। তুমি ছিলে, তুমি আছ, তুমি থাকবে---- তাই তো আমাদের দিনগুলো এত আনন্দ মুখর। জীবনের যেকোন সময় তোমায় পাশে পেয়েছি। তুমি যেন আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে মিশে আছো কবি। আনন্দে, বেদনায়, ভাল লাগায়, খারাপ লাগায়---- তুমিই তো আশ্রয়স্থল।
তুমি সব বয়সের সঙ্গী আমার। সাহিত্যের সব শাখায় তোমার অবাধ বিচরণ। যখন গল্পগুচ্ছ হাতে নিয়ে বসেছি, তখন বুঝতে শিখেছি ছোটগল্প আসলে কী----- অনুভব করেছি "শেষ হয়েও হইল না শেষ"। তোমার নারী চরিত্ররা আমায় বরাবর আকর্ষণ করত। নিজের নামের সাথে মিল পেয়ে 'সমাপ্তি' গল্প পড়তে গিয়ে মৃণ্ময়ী চরিত্রটির মধ্যে বেশ নতুনত্বের স্বাদ পেলাম। তথাকথিত অমার্জিত, দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে। কোথাও কোথাও চরিত্রটির মধ্যে নিজের মেয়েবেলাকে খুঁজে পেয়ে যেন আরও একাত্ম হয়ে পরি। তৎকালীন সমাজের প্রচলিত প্রথার বাইরে বেড়ে ওঠা এক সরল, নির্ভীক, মুক্তমনা নারী চরিত্র। সে বাঁচতে চায় নিজের শর্তে, মানুষ হিসাবে। গতানুগতিক সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো এক প্রতিবাদী প্রতীক হলো মৃণ্ময়ী।
আবার পরিণত বয়সে যখন 'চোখের বালি' পড়েছি তখন বিনোদিনী চরিত্রটির প্রতি অদ্ভুত টান অনুভব করেছি। আশালতার চেয়ে বিনোদিনী চরিত্রটিই আমায় আকর্ষণ করেছে বেশি। রবীন্দ্র ভাবনায় যেন একটি স্বতন্ত্র চরিত্র এই বিনোদিনী। সারা উপন্যাস জুড়ে সে শুধু নিজের যোগ্যতাই প্রমাণ করে গেছে। বিনোদিনী সবদিক থেকে অবহেলিত, বঞ্চিত। তখনকার দিনে ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক রুচি সম্পন্ন এবং প্রখর আত্মসচেতন হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কোথাও চরিত্রটির মধ্যে বড় অসহায়তা ফুটে উঠেছে। যাকেই সে গ্রহণ করতে গেছে, তার কাছেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়--- বিনোদিনী কোথাও যেন এক সামাজিক প্রতিবাদ। একজন অল্পবয়সী বিধবা, তার মনের সমস্ত আকাঙ্খা নিয়ে সমাজের তথাকথিত সংস্কারের দ্বারা অবদমিত। তার ব্যক্তিত্বের নানা স্তর এখানে আবর্তিত। এই যে 'চোখের বালি' সম্পর্ক পাতানো--- এটাও এক ধরনের সামাজিক প্রতিবাদ। সামাজিক অনুশাসনে প্রায় অচ্ছুত একটি মেয়ের তীব্র জীবন আকাঙ্ক্ষার নাম বিনোদিনী। নারী শুধু সমাজ নির্ধারিত 'নারী' মাত্র নয়----- এক গোটা মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় রবীন্দ্র ভাবনায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক অনেক লেখকদের চাইতে ভিন্নভাবে নারী চরিত্রদের এঁকেছেন। উনিশ শতকে যেখানে নারীর অধিকার প্রায় অকল্পনীয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, প্রগতিশীল, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন করে। তাঁর ভাবনা, চিন্তা, আদর্শ তাঁকে সমকাল থেকে সবসময় এগিয়ে রেখেছে। তাই তো তুমি চিরকালীন।
কবির ভাষাতেই বলি------
"শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও। "
তুমি হৃদমাঝারে সদাই বহমান। জীবনের নানা ওঠাপড়ায় তুমিই তো ভরসা জাগাও মনে। নীরবে অন্তরাত্মা গেয়ে ওঠে------
" তবু মনে রেখো
একদিন যদি বাধা পড়ে কাজে
শারদ প্রাতে---- মনে রেখো।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴