কবিতা বণিক-এর আলোচনায় ডঃ রতন বিশ্বাস-এর 'পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ'
কবিতা বণিক-এর আলোচনায় ডঃ রতন বিশ্বাস-এর 'পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ'
গবেষক ও প্রাবন্ধিক ডঃ রতন বিশ্বাসের লেখা ‘পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ’ নিঃসন্দেহে একটা অমূল্য সম্পদ।ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। লেখক সুন্দর বলেছেন - মাটির ঢিবিকে পাহাড় ভেবে আনন্দ লাভ করা যেন তার প্রথম পাহাড় দর্শন। কবির পৈতে উপলক্ষ্যে মাথা মুড়ানো হলে স্কুলে যাবেন কিভাবে সেই চিন্তার অবসান করলেন , হিমালয় ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে,তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। হিমালয়ের আহ্বান কবিকে অস্হির করে তুলেছিল। কবির ভাষায় “পর্বতের উপত্যকা, অধিত্যকায় স্তরে, স্তরে, পঙতিতে পঙতিতে সৌন্দর্যের আগুন লাগাইয়া দিয়েছিল।” ছোট্ট রবি মাঝে মাঝে একাই এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যেতেন।পাহাড়ের সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করার এই প্রক্রিয়ায় তাঁর বাবা কখনও বাধা দেন নাই।
দার্জিলিং ভ্রমণ তাঁর কাছে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের একুশ বছর বয়সে দাদা বউদির সাথে “রোজভিলায়” উঠেছিলেন। এখানে তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা,মেঘ, ঝর্ণার ধারা, ঝাউ, দেবদারু,পাইন, ওক, হিমেল হাওয়া কবিকে আপ্লুত করেছিল। “ প্রতিধ্বনি” কবিতাটি দার্জ্জিলিংএ বসেই লিখেছেন। লেখক খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, রবিঠাকুরের “ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ “ লেখার আনন্দময় অবস্হাতেই দার্জিলিং এসে পাহাড়ের প্রতিধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে লিখলেন “ ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরই শ্রবণ’ পরে।” আবার “ প্রতিধ্বনি” কবিতা লেখার পর বলেছেন “ ওগো প্রতিধ্বনি,/ বুঝি আমি তোকে ভালোবাসি / বুঝি আর কারেও বাসি না।” কবি নির্জনতা খোঁজেন। দার্জিলিঙে লিখলেন “ বাতাসে সৌরভ ভাসে আঁধারে কত না তারা, / আকাশে অসীম নীরবতা—“। ১৯৩৩ সালে দার্জিলিং থাকা কালীন “ মায়ার খেলা” গীতীনাট্য রচনা শুরু করেন। কোচবিহারের রাজপরিবারের দুটো বিখ্যাত বাড়ি ‘ ক্যাসলটন’ ও ‘ হার্মিটেজ’ এই দুই বাড়িতে বসে কবি মহারানি সুনীতিদেবীকে গান শোনাতেন। আবার সুনীতিদেবীর গল্প শোনার তাগিদে তৈরি হল “ মণিহারা”। বেড়াতে বেড়াতে গল্প করতে করতে তৈরি হয়েছিল “দুরাশা”, “ মাস্টারমশায়” গল্পের ভূমিকা তৈরি করেছিলেন। কাব্যচর্চার মধ্যে “ স্হায়ী অস্হায়ী” “ক্ষণেক দেখা” রচনা করেন। আনন্দমোহন বসুর মেয়ের অটোগ্রাফ খাতায় লিখেছিলেন “সমুদ্র ও গিরিরাজ” । কবিকে পাহাড়ের নির্জন নিসর্গ অলস করে তুলেছে। কারণ সমতল শহরের কর্মব্যস্ততা পাহাড় অঞ্চলে নেই। দিলীপ রায়কে চিঠিতে লিখছেন “ আমার মনটা আজকাল কুঁড়েমির গভীর সমুদ্রে ডুব সাঁতার কাটছে।” আবার ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন—“ মাঝে মাঝে মেঘগুলো এসে শিখরে আড্ডা জমায় কিন্তু অত্যন্ত সাত্বিক শুভ্রভাবে— সাদা জটাধারী পথিক সন্ন্যাসীর মতো।” শেষবার দার্জিলিংএ ১৯৩৩ সালে গ্লেন ইডেনে উঠলেন। হেমন্ত বালা দেবীকে লিখছেন “ আশ্রয় নিয়েছি গিরিশৃঙ্গে। কিন্তু নিয়তি এখানেও এসে পৌঁছায়, তাঁর গাড়িভাড়া লাগে না। নানান কাজের দাবী, নানা লোকের নানা অনুরোধ, পূর্বরদ্ধ কর্মের অনুসৃতি সমস্তই আমার দরজা পর্যন্ত পথ করে নিয়েছে।…” মৈত্রেয়ী দেবী ও সে সময়ে দার্জিলিংএ ছিলেন। গ্লেন ইডেনে বসবার ঘরে মালঞ্চ ও বাঁশরী দুটো গল্প শোনালেন।
১৯৩১ এ কবিগুরুর সত্তরতম জন্মদিন সর্বত্র পালিত হল। বক্সাদূর্গের বিপ্লবীরাও জেল কতৃপক্ষের অনুমতি চেয়ে কবির সত্তরতম জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্তে নিয়েছিলেন। কলাগাছ , মঙ্গলঘট বসিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে কবির উদ্দেশ্যে অভিনন্দন পত্র পাঠ “ জনগণ মন অধিনায়ক” গাওয়া, “ শেষ বর্ষণ” নাটক অভিনয় করা হয়েছিল।
এদিকে মহাত্মা গান্ধী জেল থেকে বেরিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ রাখার ও অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানান। তা সত্বেও জেলবন্দী সহস্র নরনারী মুক্তি পেলেন না। তখন দলের নেতারা বন্দিদের মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানিয়ে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম করেন। রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং থেকে জেলে আত্মাহুতি দান করতে নিষেধ করে টেলিগ্রাম করেন। এ আদেশ পালন করা হয়েছিল। ১৯৩৩ এই বছরই ১১ই জুন জিমখানা ক্লাবের একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হন। এখানে কবি ইংরেজি ও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। কবির “ বিদায় অভিশাপ” আবৃত্তির সাথে শ্রীমতী দেবীর নৃত্য খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। “ উত্তিষ্ঠিত নিবোধত”, ‘ বিচ্ছেদ’ , ‘আষাঢ়’ , ‘যক্ষ’ , ‘দুঃখী’এখানেই রচনা। হিমালয়ে বর্ষা অনেক আগেই এসে পড়ে। এই বছরেই ১৮ই জৈষ্ঠ “আষাঢ় “ কবিতাটি রচনা করেন। কবি লিখলেন “ … রিক্ত যত নদীপথ ভরি দিলে অমৃত প্রবাহে। / জয় তব জয় / গুরু গুরুমেঘ গর্জে ভরিয়া উঠিল বিশ্বময়।” লেখক এমন অনেক উদাহরণ তুলে ধরেছেন যে কবি দার্জিলিংএ না থেকেও দার্জিলিং এর পরিবেশ, পরিজন, প্রকৃতি তাঁর কবিতায় , গল্পে স্হান পেয়েছে। ক্যামেলিয়া কবিতায় লিখেছেন - “ খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।” পত্রপুটে লিখেছেন “ রাত কাটাবে সিঞ্চলে” এমন অনেক তথ্য দিয়েছেন লেখক। দার্জিলিঙে থাকার সময় কবির নাতনি নন্দিনীকে “ ডায়াসেশন” স্কুলে পৌঁছে দেওয়া ও নিয়ে আসার কাজ করতেন।
লোকসাহিত্য বিষয়েও তিনি খুব যত্নবান ছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের কর্মী অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে “ মেয়েলি ব্রত” শিরোনামে নানান ব্রত সংকলন করিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের দীনেন্দ্র কুমার রায়কে দিয়ে লেখান পল্লি পার্বণের বর্ণনামূলক প্রবন্ধ। ৭ই কার্তিক (বৃহঃ ২২শে অক্টোবর ) কার্শিয়াংএ বসে এই বইটির জন্য পেনসিলে লেখা একটি দীর্ঘ ভূমিকা কালিতে কপি করে মুদ্রণের নির্দেশ দিয়ে অঘোরনাথকে পাঠিয়ে দেন।
ক্ষুদ্র পাহাড়ি শহর তিনধারিয়া। এখানকার প্রাকৃতিক অপরূপ মাধুর্য কবির চোখে ফুটে উঠেছিল। যেদিকে তাকানো। যায় অসংখ্য বনফুল, শাল, সেগুন আর শিশু। তিনটি ধারা — শিও খোলা, ধোপীখোলা এবং পাগলা ঝোরা মিলেমিশে তিনধারিয়া। কবি তাঁর এখানকার নির্জন নিজস্ব সময়ে কবিতা, গান, চিঠি ও গীতাঞ্জলির প্রচুর গান রচনা করেন। গীতাঞ্জলির ৭১ সংখ্যক কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদও করেন। জোড়াসাঁকো থেকে ক্ষিতিমোহন সেনকে ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ তিনধারিয়া আসার অনুরোধ জানিয়ে লেখেন —“ পুরীতে যাবার কথা হয়েছিল বটে কিন্তু বৌমার ইচ্ছা হল পার্বতীর পিতৃগৃহ দেখবার জন্য তাই আজ বিকেলের মেলে তিনধারিয়ায় রওনা হচ্ছি।…” । রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্হে পাওয়া যায় —“ ১৯১৭ সালে মে মাসে দার্জিলিং যাইবার সমস্ত ব্যবস্হা নাকচ করিয়া দারুণ গ্রীষ্মে শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। অবশেষে হিমালয়ের তিনধারিয়ায় কিছুদিন বাস করেন।”
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ চারবার গেছেন। মৈত্রেয়ী দেবী ও ডঃ মনমোহন সেনের অতিথি হয়ে। এখানে লিখেছেন “ অধীরা” , “সানাই” , “ পত্রোত্তোর” , “ রাজপুতানা” , এবং “ মংপু পাহাড়ে”। এখানে তাঁর দিনগুলি লেখাপড়ায়, হাসি ঠাট্টায় কেটে যায়। মংপুর স্মৃতির ভাণ্ডার অনেক।’ জন্মদিনে ‘ কাব্যগ্রন্হে ৫,৬,৭,৮ এখানে এসে লেখা। ৮ নং কবিতায় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ কবিকে খুব ব্যথিত করেছিল। লিখেছেন— “ আজি মম জন্ম বাসরের বক্ষ ভেদ করি / প্রিয় -মৃত্যু-বিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ; / আপন আগুনে শোক দগ্ধ করি দিল আপনারে / উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে।”
শিলং পাহাড়ে কবি তিনবার এসেছিলেন। প্রথমবার ১৯১৯ সালে শিলং যাওয়ার পথে খুব দুর্ভোগ হয়েছিল। তবুও কবির শিলং পাহাড় খুব ভালো লেগেছে। তাঁর স্মৃতি বিজরিত তিনটি বাড়ি ব্রুকসাইড বাংলো, জিৎভূমি, সীডলি হাউস। ১৯৬১ সালে শিলংএ রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাড়ি তিনটিতে মর্মর স্মৃতি ফলক স্হাপিত হয়। লেখার ক্ষেত্রে খুব একটা বড়ো কিছুতে হাত দেননি। দুএকটি ছোট কথিকা ও কিছু ইংরেজি তর্জমা।
‘ শেষের কবিতা’ উপন্যাস রচনা কাল ২৫শে জুন ১৯২৮ স্হান ব্যালাব্রুয়ি, ব্যাঙ্গালোর। গবেষক লেখকের কাছে সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে কবি সুদূর ব্যাঙ্গালোরে থাকলেও কবিতায় অনেকখানিই শিলং পাহাড়ের জায়গা রয়েছে। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির কথাও বলেছেন। অনেক গান লিখেছেন এখানে।
আলমোড়ায় থাকার সময় ‘ যাত্রাপথ ‘ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ নৈনিতালের কাছে রামগড়ে ‘স্নো ভিউ’ নামে একটা বাড়ি কিনলেন। কবি নাম দিলেন ‘ হৈমন্তী’।এখানকার অপরূপ সৌন্দর্য, দিগন্তজুড়ে দেখা যায় তুষারাবৃত শৃঙ্গশ্রেণী কেদার নাথ, বদ্রীনাথ নন্দগিরি, পঞ্চচুলি আরও কত হিমালয়ের উচ্চ শৃঙ্গশ্রেণী, তাদের অলৌকিক সৌন্দর্যে কবি মুগ্ধ। এখানে কবির হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি ছিল।
১৯১৫ সালে কবি কাশ্মীরে গেলেন। শ্রীনগরের বাইরে কোথাও না গেলেও বিখ্যাত মার্তণ্ড মন্দিরের ভগ্নস্তূপ দর্শন করে গান রচনা করেন “ আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও।…” ঝিলম নদীর বাঁকা স্রোত দেখে কবির মনে হয়েছে — নদীটাকে একটা বাঁকা তলোয়ারের মতো দেখাচ্ছে। ঝিলমের জল ঝিলমিল করছিল , তার উপর অন্ধকার নেমে এল। যখন অন্ধকার নদীকে আবৃত করল তখন মনে হল, কে যেন খাপের মধ্যে তলোয়ার পুরে দিল।… “ শ্রীনগরে হাউসবোটে থাকা কালীন লিখলেন “মানসী”। এখানে প্রকৃতির রূপকে তুলে ধরেছেন।
কাশ্মীর অবস্হানকালে তিনি যে শান্তি পেয়েছেন তা সহ কবির পাহাড়ের সৌন্দর্য রস সম্পূর্ণ উপভোগ করতে হলে অবশ্যই এই বইটি হাতে তুলে নিতে হবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴