কবিতা বণিক-এর আলোচনায় সাহিত্যিক অশোক কুমার গঙ্গাপাধ্যায়-এর বই ‘গোধূলি বেলার দিনরাত্রি'
কবিতা বণিক-এর আলোচনায় সাহিত্যিক অশোক কুমার গঙ্গাপাধ্যায়-এর বই ‘গোধূলি বেলার দিনরাত্রি'
অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে একটি পরিচিত নাম। তার লেখায় সমাজের চেনা মানুষ চেনা পরিবেশ, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ- দুঃখ, পাওয়া - না পাওয়ার চিত্রগুলো এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে বই পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে মন চাইবে না। ‘গোধুলিবেলার দিনরাত্রি’ বইতে বৃদ্ধ বয়সে মানুষের কী পরিণতি হচ্ছে বা হতে চলেছে তার চিত্র ফুটিয়ে, সাবধান বাণীর সাথে ভালোবাসার, স্নেহের সম্পর্কের কথাও শোনাতে চাইছেন লেখক। এমন কি অনেক মানুষ হয়ত তার মনের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠার পথও পাবেন।
‘গোধূলিবেলার দিনরাত্রি’ আমার কাছে মনে হয় বইটি সার্থক রূপ পেয়েছে। প্রত্যেক বয়স্ক মানুষদের সংসারের চাপে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, বঞ্চনা, প্রতারণা, একাকীত্ব, শরীরের অসহায়তা, অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণাগুলো যেন বৃদ্ধ বয়সে এসে চেপে ধরে। সেসময় যে সহমর্মিতার প্রয়োজন হয় তা সবসময় পাওয়া যায় না, আবার পেলেও তার সঠিক মূল্যায়ন করা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না। নিজের হাতে গড়া সন্তানকেও চিনতে ভুল হয় অনেক ক্ষেত্রে। অপ্রয়োজন হলেও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হওয়া পরিবেশের অবস্থা দেখে নিজেকে সেই অবস্থায় তুলনা করে অযথা কষ্ট পাওয়া ও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ারও অনেক মানুষ আছেন। মানুষের জীবনের গোধূলিবেলা যেন স্বস্তির আনন্দের হয় সেই দিক লক্ষ্য রেখে লেখক মানব জীবনের গোধূলি বেলার দিন রাত্রিগুলোকে কেমন করে উৎসাহিত ও আনন্দময় করা যায়
তারই একটা সুন্দর চিত্র এঁকেছেন “গোধূলিবেলার দিনরাত্রি” বইতে।
বিভূতি বাবুর ‘গোধূলি বেলার' সমীর মুখোপাধ্যায়কে সবচেয়ে ভালো লাগলো। ছোট ছেলের সাথে মিল খুঁজে পেলেন। লণ্ডনের এম, বি, এ পাশ করে এমন আধা শহর আধা গ্রামের মতো জায়গায় তার দাদুর মতো সহায়হীন মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ঐ ডাক্তার দাদু কলকাতার নিজের বাড়িতে স্ট্রোকে মারা যাওয়ার পাঁচ/ ছয়দিন পরে মানুষ জানতে পারে। দাদুর নিঃসঙ্গ জীবনের এভাবে মৃত্যু সমীরকে প্রভাবিত করেছিল। বৃদ্ধাশ্রম নামটা ঠিক পছন্দ নয় সমীরের। কারণ সবাই তো নিপীড়িত বা নির্যাতিত নয়! অনেকের ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছার হিসেব কেউ রাখে না। ফলে কেউ কেউ যায় ডিপ্রেশনে। নানান মনের কষ্ট নিয়ে থাকা অসহায় মানুষদের ও সবার কথা ভেবেই "গোধূলি বেলার" সৃষ্টি। গোধূলি বেলার মালিক হলেও ম্যানেজার এর মতো সমস্তটাই দেখাশোনা করেন। এই সমীর বাবুর মতো অল্পবয়সী ছেলের কাজে, কথায় এতো ম্যাচিওরিটি দেখে অবাক হন বিভূতিভূষণবাবু। এখানকার খাওয়া বাড়ির মতো। পরিবেশ তো বাড়ির চাইতেও ভালো। কলকাতায় ফিরে বিভূতিভূষণবাবু স্ত্রীকে বোঝাতে চাইছিলেন যে বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন যে তাদের দুই ছেলে, তারাই তো অনেক দূরে থাকে। তাই তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান আজ পেয়েছেন। এর মধ্যে চেন্নাই থেকে ছোটো ছেলে অরিন্দমের ফোন আসে। ছেলে বলছে তার ছেলেরা নাতিরা সবাই তাদের মিস করছে। বৃদ্ধাশ্রমে ভালো না লাগলে কষ্ট করে যেন না থাকে। কারণ মানসিকতায় সবার সাথে মিলবে না। লতিকা দেবী ছেলে বৌমা, নাতি সবার খোঁজ খবর নিলেন। ছেলে তাদের ১০ই মার্চ সোমবার দার্জিলিং মেলে যাওয়ার তারিখ শুনে ফোন কাটলে বিভূতি বাবু স্নেহ আর স্বস্তির পারস্পরিকতা উপলব্ধি করছিলেন।গোধূলি বেলায় পৌঁছনোর পর বড় ছেলের ফোন এসেছিল। এখানে অনেকদিনের বাসিন্দা ভবঘুরে মায়াদি, এখন রান্নার দায়িত্ব যেমন নিয়েছেন তেমন নিজের মতো করে অন্যান্য কাজের দেখাশোনাও আনন্দে করেন। আছেন অবিনাশ মিশ্র ও ডোনা মিশ্র। অবিনাশ বাবুর দুটো কিডনি খারাপ হওয়ায় কেউ যখন কিডনি ডোনার হতে সাহস করেননি। তখন ডোনার স্কুলের কেরাণী হরিপদর ছেলে শিবু বিনে পয়সায় ডোনার হয়ে জীবন বাঁচালেন। রিটায়ারমেন্টের পর শিবুকে একটা জামা কাপড়ের দোকান করে দিয়ে এসেছেন। শশাঙ্কশেখর যাকে লোকে পাগল বলে তিনি ও তার স্ত্রী সুলোচনা থাকেন। সুলোচনার আক্ষেপ তিনি পাগল নন। তাহলে এত বড় ব্যবসা সামলাতেন কিভাবে। ওপেনহার্ট সার্জারি করিয়ে ২ মাস নার্সিংহোমে রেখে পূর্ণ বিশ্রাম ও শান্তির জন্য সেই ভদ্রলোক এখানে রেখে যান, যার বাগান বাড়িতে অনুদি থাকতেন। সুরঞ্জনার সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতায় দিনের পর দিন নিজেদের নিঃশেষ করে সবাইকে স্বাবলম্বী করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই রবিরঞ্জন সুরঞ্জনাকে সিঁদুর পরিয়ে এই গোধূলিবেলায় তুললেন। সমীরের মধ্যে এই সব বৃদ্ধ দম্পতিদের উৎসাহ জোগানো, পাশে থাকার ভরসা দেওয়ার মতো দৃপ্ত কথাগুলো বিভূতিবাবুর খুব ভালো লেগেছিল। এর মধ্যে মিরিকে বেড়াতে যাওয়া, সেখানে লেকে বোটিং করে বিভূতিবাবু-লতিকা, শশাঙ্ক শেখর- সুলোচনা নিজেদের যেন নুতন করে খুঁজে পেলেন। আনন্দে সে রাতে তারা মিরিকে থেকে গেলেন। শশাঙ্কবাবুর বিয়াল্লিস বছর ধরে চেপে রাখা অসহনীয় দুঃখ বেরিয়ে এলে লতিকা দেবী বললেন - তুমি দুঃখ করছ কেন সুলোচনাদি! মহাশূন্যের ব্ল্যাকহোলের মতো যন্ত্রণাও প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনে ঘুরছে। এই আদি অন্তহীন ঘোরার খেলায় মানুষ অসহায়। ফেরার পর সমীর জানাল আগামীকাল মেডিকেল চেক আপের দিন। সবাই তৈরি থাকবেন। অন্যদিকে চেক আপের জন্য অনুদিকে সেই ভদ্রলোক বা পূর্নেন্দু সেনগুপ্ত, স্বামী পরিচয় দিয়ে ভেলোর নিয়ে গেলেন। পরে খবর দিয়েছিলেন, সুস্থ হয়ে তারা হরিদ্বার গিয়ে একটা বাড়ি কিনে আছেন। প্রতিদিন সকলের মঙ্গলকামনায় গঙ্গায় প্রদীপ ভাসান।
সংসারের দায়িত্ব কর্তব্য সেরে নিজের নিজের সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্খাকে বাক্স বন্দী করে জীবন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছেন এই যে মানুষগুলো, তবুও যেন মানুষগুলোর মধ্যে উচ্ছ্বাস, আবেগ, প্রাণ, ভালোবাসা যা কারোরই দেখার অবকাশ ছিল না, আজ যেন ‘পারাপার’ নামের বাসে চড়ে সেভক ব্রিজ দেখতে যাওয়া গোধূলিবেলার সদস্যদের মধ্যে ভরপুর হয়ে উঠেছে। যেন যৌবনকেই ফিরে পেয়েছেন। কেউ কেউ ভাবছেন গোধূলিবেলার বর্ষীয়ান কপোত- কপোতী। রবিরঞ্জন বললেন, সবাই পুরোনো আমলের বাহারি আলমারি। দূর থেকে সুন্দর। ভোলা, মন্টু, মায়াদির তদারকিতে খাওয়া পর্ব শেষে সুরঞ্জনা গান গাইল এবং সবাই গলা মেলাল। ফিরে এসে পরদিন সবাই মিলে অবিনাশ মিশ্র ও অপর্ণা মিশ্রের চল্লিশতম বিবাহবার্ষিকী আনন্দের সাথে পালন করলেন।
লতিকা দেবীর বড় ছেলে অমিতাভর মেয়ে টুকুন ফোনে জানায় সে কলকাতায় এম, বি, এ পড়তে চায়। তারপর বাবা ও কাকার সাথে টুকুন গোধূলিবেলায় আসে তার দাদাই, দিদাই কেমন আছে, কিভাবে আছে দেখতে। টুকুনের বাবা, কাকা কেমন দাদু, দিদার পাশে শুয়ে ছেলেবেলাকে উপভোগ করল, বিকেলে টুকুন একটা বকুল গাছ পুঁতে সেই গাছের বড় হওয়া নিয়ে অনেক কথা, কবিতাও হল সবার সাথে। টুকুন বলেছিল সম্পর্কের আকর্ষণ মাধ্যাকর্ষণের মতো অমোঘ। ইচ্ছে করলেই ছিন্ন করা যায় না। তাই হয়ত লতিকাদেবীর ইচ্ছে হল ঠাকুর পুকুরে তাদের চারকাঠা জমিতে সবাইকে নিয়ে একটা নুতন সংসার রচনা করবেন। সেখানে গোধূলিবেলার বন্ধুদের যেমন অধিকার থাকবে তেমনি তার সন্তানদের, নাতি, নাতনিদেরও অধিকার থাকবে। আমাদেরই ভালো, মন্দ মেশানো নিজের হাতে গড়া এই প্রজন্মকে ইচ্ছে করলেই দূরে ঠেলতে পারি না।
ছেলেরা দূরে থাকে বলে এই অজুহাতে বৃদ্ধাশ্রমে আসা, সকলের সাথে মিলেমিশে থাকা একে অপরের সাথী হওয়া, আমার মনে হয় এই সদ ভাবনা নিয়ে হয়ত একই দূরত্বে ছেলেদের কাছে চলে গেলেও তারা খুব ভালো থাকতেন। সংসারের কাছে আমাদের যেন একটু বেশিই চাহিদা। তাই মনের মিলে ঘাটতি ও বেশি দেখা যায়। বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে তো বসে থাকতে হবে কারো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো নিয়ে, কেউ কেউ প্রত্যাশা পূরণের প্রতীক্ষায় অনন্তকাল ধরে বসে থাকবে অচিন পুরের পথে। লেখকের এই ভাবনাকে কুর্নিশ জানাই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴