এথিক্যাল হ্যাকার/শুক্লা রায়
এথিক্যাল হ্যাকার
শুক্লা রায়
ঋতমকে যখন পুলিশ অ্যারেস্ট করল তখন সমস্ত পাড়া-প্রতিবেশি, এমনকি ঋতমের বাবা-মায়ের চোখেও একরাশ ঘৃণা ফুটে উঠল। তবু সন্তান তো সন্তানই। মানুষ খুন কর ফেললেও তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। তারপরেও বাবা-মা চায় আমার ছেলেটা ছাড়া পাক। আকষ্মিক ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় প্রায় সবাই হতভম্ব। প্রাথমিক অভিঘাত কাটিয়ে ঋতমের মা চিৎকার করে কেঁদে উঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। ঋতমের বাবা কৌশিক ঠিকমতো শোক প্রকাশের আগেই বাধ্য হয়ে বৌয়ের সুশ্রুষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি পুরুষ মানুষ। তাঁকে কাঁদতে নেই। অথচ ভেতরটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। দু হাতে মাথা চেপে ধরে তবু ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। একটাই ছেলে। খুব যত্নে মানুষ করেছেন। অন্যদের মতো ছেড়ে দেননি। চেষ্টা করেছেন এই মেকানিক্যাল সময়ে এসেও জীবনের মূল্যবোধগুলির পাঠ দিতে। সবগুলিই কী ব্যর্থ তবে? ঋতমের অ্যারেস্ট হওয়ায় ছেলের থেকেও তাঁরই ব্যর্থতা বেশি বলে তাঁর মনে হচ্ছে। কিছু ভালো লাগছে না। অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন। খবর শুনে ঋতমের মামা-মামী এসেছেন। তাঁরা ব্যস্ত ঋতমের মাকে নিয়ে। সম্বন্ধী এসেছিলেন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু তাঁর বুকের চাপা কষ্টটা তিনি বুঝলেন। বিরক্ত না করে ঘরেই এককোণে বসে তাঁর দিকে খেয়াল রাখছেন। পুলিশ ছেলের ফোন, ল্যাপটপ সব নিয়ে গেছে। ঘরটা যেন শূন্য হয়ে আছে। ঘরটার মতো কৌশিকের বুকটাও তো খাঁ খাঁ করছে।
রাইসা নামের যে মেয়েটি সুইসাইড করেছে তার সুইসাইড নোটে স্পষ্ট ঋতমের নাম উল্লেখ করেছে। ঋতম রাইসার বয় ফ্রেন্ড। মেয়েটাকে বেশ কয়েকবার দেখেছেন কৌশিক। পোশাক-আশাকে অতি আধুনিক হলেও মেয়েটার মুখটা বড় মায়াবী। খুব কথা বলে আর ডাক-খোঁজ ও ভালো। ভেবেছেন এই মেয়েটিকেই নিশ্চয়ই পুত্রবধূ করবেন। কিন্তু মাঝখান থেকে কী যে হয়ে গেল। তাঁদের ও এক সন্তান, মেয়ের মৃত্যুর পরে বাবা-মা দুজনেই নার্সিংহোমে ভর্তি। কৌশিক তাঁদের কথা ভেবেও মনে মনে কষ্ট অনুভব করেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে নেমে আসে। এতটাই হাহাকার মিশে বের হয় যে ঋতমের মামা চমকে তাকান। কিন্তু কিছু বলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নেন। তাঁর বুক থেকেও যে একটা নিঃশ্বাস ভেতরটাকে ফালা ফালা করে বেরিয়ে আসে। সেই ছোট্টটি থেকে ছেলেটা তাঁর ন্যাওটা। ভোলেন কী করে!
কয়েক সেকেন্ডের ছোট্ট একটা নগ্ন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে রাইসার। উঠতি ছেলেদের হাতে হাতে আগুনের মতো দ্রুত সেই ভিডিও ছড়িয়ে গেছে। সেখানে শরীরটাকে বিভিন্ন ভঙ্গীতে ঢেউ খেলাতে দেখা যাচ্ছে রাইসাকে। যদিও কায়দা করে নিজের মুখটাকে ঢেকে রেখেছে। তবু চেনা যাচ্ছে ওটা রাইসাই। ক্রমে পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন সব জানাজানির ফলে ঘর থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। ওরা মানে রাইসার বাবা-মা ও। রাইসাকে যতবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে ততবারই বলেছে ঋতমের কাছে ভিডিও পাঠিয়েছিল। ঋতম দেখতে চেয়েছিল। আর ও সেটা ভাইরাল করেছে। শেষমেস চাপ সহ্য করতে না পেরে রাইসা সুইসাইড ই করে ফেলল। কৌশিক অবাক হন। কী হয়েছে সামান্য একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তো? তিনি তবু রাইসাকে পুত্রবধূ করতে রাজী ছিলেন। এর জন্য একটা বাচ্চা সুইসাইড করে ফেলল? কৌশিক সেদিনও ভেবেছিল, মানুষ, এই সমাজ শুধু বাইরেই আধুনিক, মনে আধুনিক নয়। যদি হত তবে সমাজের চাপে মেয়েটাকে আজকে মরার সিদ্ধান্ত নিতে হত না।
ঋতমকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিটা ঘন্টা, মিনিট সেকেন্ড যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে বুকে চেপে বসছে। রান্নাঘরে আলো জ্বলল না। ডাইনিঙে কোনো প্লেটের শব্দ হল না। চারটা মানুষ যেন চারটা পাথরের মতো নিশ্চুপ। এর মধ্যেই ভোরবেলা কৌশিকের ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নাম্বার। তাঁর হাত কাঁপছে দেখে ঋতমের মামা ফোন তুললেন। পুলিশ। ঋতমকে ছেড়ে দিচ্ছে ওরা। এসে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু স্টেশন লিভ করা চলবে না, যেন ডাকলেই থানায় হাজিরা দিতে পারে। এতক্ষণে কৌশিক হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। নিজেকে আর পুরুষসুলভ গাম্ভীর্যে ধরে রাখতে পারেন না।
আসলে ঋতমের ফোন ল্যাপটপ চেক করে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি সন্দেহজনক। ঋতম বারবার একটাই কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে, রাইসা তো খুব ছবি ভিডিও পোস্ট করত বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকেই হয়ত কোনো বদমাশ লোক আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে ওর ভিডিও থেকে ন্যুড ভিডিও তৈরি করেছে। করতেই পারে। যথারীতি পুলিশ বিশ্বাস করেনি। এগুলো গাল-গল্প ছাড়া কিছুই মনে হয়নি তাঁদের। অপরাধীর নিজেকে আড়াল করার চিরচরিত পন্থা। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত তো ঋতমকে ছাড়তেই হল। ছাড়ার সময় অফিসার দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিল সুইসাইড নোট দেখে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সম্ভবত আপনার ছেলে নির্দোষ। তবু তদন্ত শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কিছু বলা যায় না। ভিডিওটা কোথা থেকে কীভাবে ছড়িয়েছিল জানার জন্য আমরা এথিক্যাল হ্যাকারের সাহায্য চেয়েছি। তাঁরা কিছু প্রমাণ ধরিয়ে দিলে কিন্তু আপনার ছেলেকে আবার তুলে আনব।
তখন থেকে আবার আর এক রকম ভয়ে ভয়ে বাঁচা। কখন কী প্রমাণ আসে! কিন্তু ঋতম প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী, নিজেকে বারবার নির্দোষ বলেছে, ও বিমর্ষ, তবে দেখে ভীত মনে হচ্ছে না। ছেলে ছাড়া পেলেও এখন ঋতমের মায়ের আবার দুঃখ পারিবারিক সম্মান নষ্ট হল বলে। আড়ালে আবডালে কৌশিকের কাছে সে কথা বলারও চেষ্টা করেছে।
ছেলের গাম্ভীর্য দেখে কৌশিক মনে মনে ভয় পান। চরম নাস্তিক মানুষটা এখন মনে মনে সারাক্ষণই ঈশ্বরকে স্মরণ করেন। অথচ মন না চাইলেও অভ্যাসমতো পেপার পড়েন, শেভ করেন। স্নান করে অফিসে যান। কেমন যেন যন্ত্রের মতো হয়ে গেছেন। এর মধ্যে নিয়ম করে দিনে কয়েকবার ছেলেটার পাশে বসে অকারণ হাবিজাবি কথা বলে সময় কাটান, ছেলের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন। অমন রাশভারী মানুষটাও কখনো কখনো নিজেকে জোকারের পর্যায়ে নামিয়ে আনেন। সেদিনও অন্যান্য দিনের মতো পেপার হাতে বসে প্রথম পাতাটায় চোখ বুলিয়েই লাফিয়ে ওঠেন। চিৎকার করে ঋতম আর ওর মাকে ডাকতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর মামার বাড়ি থেকেও ফোন আসে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই ফোন করে একটাই কথা জানায়, আসলে তারা আগেই জানতেন যে ঋতম নির্দোষ। ঋতমের মতো ছেলে এরকম করতেই পারে না। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী এথিক্যাল হ্যাকার রাইসার ভিডিওর রহস্য ভেদ করেছে।
ঋতম বাইরে আসে। কাঁপা হাতে পেপারটা তুলে নেয়। খবরের পাতাটায় চোখ বুলিয়েই শকড হয়ে যায়। রাইসার সহজ-সরল প্রাণোচ্ছল চেহারাটা মনে পড়ে। মেয়েটা কেন এমন করল? কীসের অভাব ছিল ওর? সরকারি চাকুরে বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা! কীসের লোভ ছিল মেয়েটার? প্রতিবেদন অনুযায়ী রাইসা নিজেই কিছু টাকার বিনিময়ে ভিডিওটি বিক্রি করেছে একটা পর্ণ সাইটে।
তবু তাকে ঘৃণা করতে পারল না ঋতম। ভালোবাসা তো সবকিছুই শুদ্ধ করে নেয়। মেয়েটা তাকে সেই সুযোগটাই দিল না। বাবা জড়িয়ে ধরতেই এতদিন পরে বাবার বুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সারা বিল্ডিং যেন নীরব দর্শক এখন এই কান্নার।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴