সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

একটি ঝাঁঝালো সফর এবং.../মনোলীনা রায় কুন্ডু

একটি ঝাঁঝালো সফর এবং...
মনোলীনা রায় কুন্ডু


       গন্তব্য কলকাতা, মাসে দু'বার যাতায়াতের সুবাদে উত্তর বঙ্গ থেকে কলকাতা গামী ট্রেনগুলি প্রায় নিকটাত্মীয়ের বাড়িই হয়ে উঠেছিল। সঙ্গীর হুকুম ছিল, 'ট্রেন শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মে না ঢুকলে ডাকবে না।' কারণ, একটা হাল্কা ব্যাগ নিয়ে নামতে যে সময় লাগে, তাতে ট্রেন আমাদের নিয়ে কার শেডে রওনা দেবে না..অতএব সকালের ঘুমটি যতটা সম্ভব বিঘ্নিত না হয়..এমনই নির্দেশ।
                      যাই হোক, যেকথা বলা! দার্জিলিং মেইল নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়েছে। আমি আর আমার সঙ্গী নিজ নিজ সিটে আসীন। একটি ক্যুপের আটজন যাত্রীর মধ্যে তারাও ছিল। তারা স্বামী স্ত্রী এবং নববিবাহিত। মনে মনে জরিপ করে  বোধ হল যুগলে উত্তরবঙ্গে এসেছিল মধুচন্দ্রিমা যাপনে।ছোট্টখাটো মেয়েটিকে দেখে মনে হয় ক্লাস টেন  কি নাইন, ছেলেটি কুড়ির কোঠায়, কথোপকথনে এবং হাবেভাবে বেশ একটা টক ঝাল মিষ্টি ভাব, আমি বেশ উপভোগই করছিলাম। তবে যত ছোট্টই তাকে মনে হোক না কেন তিনি যে রীতিমতো একটি ধানী লংকা, সেটা সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথেই মালুম পড়ছিল। যাই হোক, দার্জিলিং মেইল মানেই কিষাণগঞ্জ পেরোলে খেয়ে দেয়ে ঘুমের ব্যবস্থা।বেশিরভাগ যাত্রীই সারাদিনের কাজ সেরে ক্লান্ত এবং পরদিনটি গঙ্গার ঐ পারে কাজের জন্য নির্দিষ্ট... তাই মাঝের রাতটিতে বিশ্রাম নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে চান অধিকাংশ। তবে,অধিকাংশ বলতে সবাই তো নয়। আমার এই দুই সহযাত্রীও নন, তারা সদ্য বিবাহিত (অবশ্যই আমার ধারণা অনুযায়ী), চোখে মায়াঅঞ্জন! তাদের গল্প আর ফুরোয় না।
                এগারোটা বাজে, ক্লান্তি আমাদের চেপে ধরেছে, সারাদিন অফিস করে শনিবার রওনা হয়ে রবিবার পৌঁছে, কাজ সেরে আবার ঐদিনই রওনা হতে হবে। সোমবার নেমেই ছুট দিতে হবে কর্মস্থলে।তাই, মাঝের দু রাত ট্রেনের ঘুমটা বড্ড জরুরী। অবশেষে তাদের প্রস্তাব দেওয়া হল, তিন সহযাত্রী একদিকের তিনটে বার্থ নিয়ে নিলে ওরা পরে সুবিধে মতো উল্টো দিকে নীচের ও মাঝের বার্থদুটিতে শুয়ে পড়তে পারবে। ছেলেটি রাজী হবে কিনা ভাবার আগেই ধানী লঙ্কা দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ততোধিক দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন যে তারা নীচের দুটি মুখোমুখি বার্থেই থাকতে চান। সেই জোরের কাছে বশ মানতেই হল। অতএব, কি আর করা!! আরো মিনিট পনের ঝিমিয়ে, মোবাইল ফোন ঘেঁটে, অন্ধকার চরাচরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করার পর বিছানা করে শোয়ার যোগাড় করা গেল। শ্রীমতীর খুটুর খাটুর আর শেষ হয় না, ক্যুপের বাকী ছয় যাত্রী বাতি নেভাবার আশায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। শ্রীমতী ধানী লঙ্কার স্বামীর মুখেও অস্বস্তির ছাপ সুস্পষ্ট। যদিও শ্রীমতীর শারীরিক ভাষার দাপটে সে ইচ্ছে প্রকাশের সাহস কারো আর হয়ে উঠল না, শেষে বুঝি আমার সঙ্গী পার্থই সাহস করে বাতি নেভানোর আর্জি পেশ করে, শ্রীমান আর কালমাত্র বিলম্ব না করে দিল আলো নিভিয়ে। রাতবাতির হাল্কা নীল আলোয় দেখলাম, শ্রীমতী ক্ষেপচুরিয়াস..অচেনা মানুষের উপরে রাগখানাকে ঝাঁঝালো স্বরে উগরে দেয় স্বামীর উপর,--'বেশী সতীপনা!'-এক্ষেত্রে সতীপনার উদাহরণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ক্লান্তি আর সেসব বেশিক্ষণ ভাবতেও দিল না, শ্রীমানও দেখলাম আর কথা না বাড়িয়ে চুপ হয়ে গেল।
               হঠাৎ সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একটা অস্পষ্ট কথা কাটাকাটিতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি শ্রীমান শ্রীমতীর মতান্তর চলছে। আমার উল্টো দিকে মাঝের বার্থখানা নামানো এবং নীচের বার্থে দুজনের তুমুল তর্ক চলছে নীচু গলায়!! ঝগড়া হলে কার না কৌতূহল হয়!! আমিও কানকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে, চোখকে অনিচ্ছাতে অন্য দিকে সরিয়ে ঝগড়ার কারণ অন্বেষণে মনোনিবেশ করেছি। বুঝতে পারলাম, ট্রেন থেকে নেমে তারা কোথায়, কোন বাড়িতে যাবে...তাই নিয়ে মতান্তর। শ্রীমতী শ্রীমানের বাড়ি যেতে নারাজ, এমনকি তার বাড়িকে বাড়ি বলতেও নারাজ, বলছেন, "বাড়ি না বাড়ি!!চিলেকোঠা বাড়ি!'' শ্রীমান শান্ত, বলে, "মা যে অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।".."আমি যাবো না, বাবা আসবে স্টেশনে, আমি বলেছি তাকে আসতে, আমি বাড়ি যাব, তুমিও যাবে আমার সাথে।" কিছু কথা চালাচালির পর   শ্রীমান শেষে সমঝোতা করে, "ঠিক আছে, তুমি তোমার বাড়ি যাও, আমি আমার বাড়ি।" এরপরে চোখকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারলাম না, দেখলাম, জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল চিরুণী। তবু শুনতে পাচ্ছি, "ছি,ও রকম কোর না", কিসের কি!! ট্রেন  স্টেশনের আউটারে, এবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটির একপাটি জুতো। আমি আশা করছি, এই বুঝি একটি চড়ের আওয়াজ এবং তার কিছুকাল পরেই চারশো আটানব্বই ধারায় একটি মামলা। ভাবছি, একে নিয়ে সারাজীবন থাকা ভালো না কি চারশো আটানব্বই এর বোঝা ঘাড়ে নিয়ে জেলে যাওয়া ভাল!! না, তবে সেরকম কিছুই হল না। আমার আশা আশঙ্কা সমস্তই নস্যাৎ করে দিয়ে ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা শ্রীমান ব্যাগ থেকে আরেক জোড়া জুতো বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। শ্রীমতী তার সেই চেষ্টা সফল হতে দেবেনই না। বেশ একটা হাতাহাতি ব্যাপার,উত্তেজনা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত.. ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ছে.. হাতাহাতি অব্যাহত। শেষে ব্যর্থ হয়ে শ্রীমান লাগেজ কাঁধে, খালি পায়েই প্ল্যাটফর্মে নামার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, শ্রীমতীও!! আমি ও মাঝের বার্থে ঘাড় নীচু করে বসে পড়েছি,লাফিয়ে নেমেও পড়লাম.. আজ আমি তাড়াতাড়ি নামতে চাই ট্রেন থেকে,ঝগড়ার শেষটুকু দেখতে না পারা আর রহস্য গল্পের শেষ পাতাগুলো হারিয়ে যাওয়া,..এক ই ব্যাপার!!আমি পার্থকে ধাক্কা দিয়ে নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, সে তিনতলায় শুয়ে কেবলই উঁ আঁ করে।
...'আরে, ওঠো ওঠো, শেয়ালদায় ট্রেন ঢুকে গেল   যে!!''
.."আরে,থামে নি তো এখনো!!''
..."আরে,নামো না তুমি, তাড়াতাড়ি করো!"
..."হঠাৎ এরকম ব্যস্ত কেন হয়ে পড়লে?ট্রেন তোমাকে না নামিয়ে যাবেনা!"
..আমি এবার উত্তেজিত, রীতিমতো ঝগড়ার সুর আমার গলায়.."সব কিছুতে লেটলতিফ!"
..."এত ব্যস্ততা কেন?"
..সব কথা বলা যায় না,কেন ব্যস্ততা তাও বলতে পারি না!!তিনতলা থেকে নেমে তার যাবার প্রস্তুতি নিতে কামরা প্রায় শূন্য।আমার রহস্য গল্পের ছেঁড়া পাতা উড়ে চলে গেল...আমার আর জানা হল না মধুচন্দ্রিমা শেষে একসাথে তারা গৃহপ্রবেশ করতে পারল কি না!!
              এই অশান্তিতে আমাদের দুজনের ঝগড়া বেঁধে গেল, পার্থ বেচারা তো বোঝেই না এই  অভূতপূর্ব আচরণের কারণ কি!! নিজের গন্তব্যের পথটুকু গোমড়া হয়েই বসে রইলাম, তিনিও বিশেষ ঘাঁটালেন না।
                           কিন্তু রহস্য গল্পের শেষটুকু জানতে না পারার ব্যর্থতার জ্বালা আজও মাঝে মাঝে কুটকুট করে জানান দেয়...আর আমিও সেই অজানা পাতাকে ভরে দিই নিজের আখরে আখরে....হয়ত তারা এতদিনে একসাথে থাকার মতো একটি গৃহে প্রবেশ করতে পেরেছে...হয়ত এতদিনে মা হয়েছেন শ্রীমতী ধানী লঙ্কা..মা হয়ে হয়ত অনুভব করতে পেরেছেন মায়ের প্রতীক্ষার মর্যাদা..তার 'না'এর মাঝে লুকিয়ে থাকুক একটু "হ্যাঁ" ...যেমন করে বিরিঞ্চিবাবা গল্পে পরশুরাম বলেছিলেন, 'যাঃ, মানেই হ্যাঁ" !! দুটি প্রিয় মানুষের পারস্পরিক অনুরোধ না রক্ষা হলে হয়ত এখন তার খুব কষ্ট হয় তার, আজ সে হয়ত বোঝে সে কষ্টে তার অসম্মান...তার প্রতিটি " হ্যাঁ" বা "না"এর দেয়াল সবসময় নিরেট হয়না আর...যেখান থেকে ফেরৎ আসা বা ভাঙা ছাড়া আর কোন উপায় ই থাকেনা;বরং এখন হয়তো কোন কোন সময় বেড়ার দেয়াল বাঁধে সে .....যার ফাঁকফোঁকরে বাড়িয়ে দেওয়া যায় হাত!! ধানি লংকা তিনি, ঝাঁঝ ছাড়া তাকে মানায় না...তবে ঝাল যদি রান্নার বাকি সব উপকরণের স্বাদকে ছাপিয়ে যায় সমস্ত রান্নাটাই বরবাদ হয়ে যায়! তাই তার ঝাঁঝটুকুকে হয়ত স্বাদু করে তুলতে পেরেছেন এতদিনে....হয়তো..হয়তো..আরো অনেক  অনেক হয়তো..                             

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri