একটা না পাঠানো চিঠি/স্বর্ণজিৎ ভদ্র
একটা না পাঠানো চিঠি
স্বর্ণজিৎ ভদ্র
শ্রীচরনেষু
বাবা ও মা,
প্রায় দু মাস হতে চলল আমি দেশে এসেছি। শেষ যেদিন তোমাদের সঙ্গে কথা হলো তার ঠিক পরের দিনই আমি রওনা দিয়েছিলাম। তোমাদের বলেছিলাম সামনের কয়েকমাস খুব ব্যস্ত থাকব, যোগাযোগ সেভাবে রাখতে পারব না। আংশিক সত্য বলেছিলাম। আসলে ওখানকার পাততাড়ি আপাতত গুটিয়ে চলে এসেছি। ওরা নতুন করে চুক্তি করার বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী। আমি কিছু শর্ত দেওয়া সত্ত্বেও ওরা রাজি হয়ে গেল। তবে আমি কিছুদিন সময় চেয়েছি।
দেশে এসে প্রথম দুদিন কলকাতায় ছিলাম। একসময় এই শহরটা অনেক চেনা থাকলেও এখন খুব অচেনা লাগল। পুরোনো পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ভালো লাগল না। আসলে কলকাতাকে আমি কোনদিনও নিজের শহর বলে ভালোবাসতে পারিনি। হয়ত শুধু প্রয়োজনের তাগিদেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাই হোক এরপর একদিন রাতে পুরীর ট্রেনে উঠে পরলাম। কয়েকদিন সমুদ্র দেখে কাটালাম। সম্পূর্ণ নতুন এক জগৎ, এক নতুন পরিবেশ। মনে হলো এর অপেক্ষাতেই তো এতদিন ছিলাম। প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা, নতুন করে জানা। বিভিন্ন ধরণের লোকের সাথে পরিচয়। একদিন তো সারারাত বিচেই থেকে গেলাম। কিছু জেলে বন্ধু জুটিয়ে ছিলাম। ওরা ওদের তাবুতে থাকতে দিল। আর কি, মাছধরা নৌকার পাটাতনে শুয়ে চাঁদের আলোয় সমুদ্র দেখলাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, লিখে বোঝান যাবে না।
তোমাদের এই চিঠি আমি উত্তরাখন্ডের এক পাহাড়ি গ্রামে বসে লিখছি। এখানে আসার আগে অবশ্য উত্তর ভারতের বেশ কিছু জায়গার ছিলাম। আপাতত কিছুদিন হলো এখানে ঘাঁটি গেড়েছি। এখানে এখন রাত বেশি হয়নি, তবুও চারদিক খুব নিস্তব্ধ। আসলে পাহাড়ি এলাকা গুলি এমনই হয়। বৃষ্টি হাওয়াতে বাইরে আজ বেশ ঠান্ডা। আমার সামনে কাঁচের জানালাটা দিয়ে পাশের পাহারটা দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা রাস্তাদিয়ে গাড়ির আলোগুলি সরে সরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আজ খুব একা লাগছে। রোজ এই সময় বারান্দায় বসে হরিদার সাথে গল্প করি। অনেক রাতে হরিদা মাঝে মাঝে বাঁশি বাজায়। সম্পূর্ণ উপত্যকা ওর নেপালি বাঁশির সুরে ভেসে যায়। এক অপার্থিব সৌন্দর্য। পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলিকে দেখে মনে হয় ওরাও যেন চুপ করে সেই অতীন্দ্রিয় সুরে মোহিত হয়ে আছে। হরিদা হল এখন আমার সর্ব সময়ের সঙ্গী। চমোলির একটা মঠে ওর সাথে পরিচয়। এক অদ্ভুত গারোয়ালি মানুষ।পুরো নাম হরিরাম সেমওয়াল। কুমাযুন মন্ডল বিকাশ নিগমে কি একটা চাকরি করত। এখন সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামে জমি জায়গা আছে। দুই ছেলে দেখাশোনা করে। স্ত্রী গত হবার পর সেখানে আর খুব একটা যায়না। কবিতা লেখে, হিন্দিতে। একটি বইও বের করেছে৷ আজ সকাল সকাল বেরিয়ে নিচের গ্রামে গেছে। কোন এক পরিচিত বন্ধু আছে সেখানে। রামন না ওই রকম কি যেন একটা উৎসবের নাম বলল। আমাকে মাঝে মাঝে গাড়োয়ালি খাবার রান্না করে খাওয়ায়। সেদিন ছোলা দিয়ে একটা ডালের মতো জিনিস রান্না করেছিল। সেটার নাম নাকি ফানু। খুব যত্ন করে রান্না করে, তাই হয়তো অত ভালো লাগে খেতে। সেদিন হরিদার সাথে গেছিলাম কিছু জংলি গাছপালা সংগ্রহ করতে। ওগুলি আসলে মেডিসিনাল প্লান্ট। ছোট খাটো অসুখে ওরা এগুলিই ব্যবহার করে। ও এই অঞ্চলটা খুব ভালো করে চেনে। আসার সময় একটি বাড়িতে নিয়ে গেল খাবার জন্য। মাটির রান্নাঘরে নিচে বসে খেলাম। অনেকদিন পর দাদুর বাড়ির কথা মনে পড়ল। খেতে বসে কেন জানি দাদুর বাড়ির রান্নাঘরের সেই ধোঁয়া মেশানো সোঁদা গন্ধটা নাকে লাগছিল। আমাকে তোমরা ও বাড়িতে তেমন যেতে দিতে না। তখন তো আমাকে ঘড়ি কাঁটা ধরে চলতে হবে। ওসব গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সময় নষ্ট করার সুযোগ আমার ছিলনা। চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই সেই কাঠের দোতালা বাড়িটি। পেছনে বিরাট বাঁশ ঝোপ আর পুকুর। একদিন রাতে বোধহয় লাইট ছিল না, দাদু দোতালার বারান্দায় আমাকে কোলে নিয়ে নল-দময়ন্তীর গল্প বলেছিল। হ্যারিকেনের কালি মাখা চিমনির ঝাপসা আলো, আবছা ছবির মতো চোখে ভাসে। খুব টান ছিল ঐ বাড়িটার প্রতি। বড়ো হয়ে তো আর যাওয়াই হয়নি। তোমার মাধবীদির কথা মনে আছে? ঐ যে আমরা যখন জলপাইগুড়িতে থাকতাম, আমাদের পাশেই থাকত। মাধবী করবী দুই বোন, আমাকে ভাইফোঁটা দিত। যোশীমঠে হটাৎ সেই মাধবীদির সঙ্গে দেখা। একদিন সন্ধ্যাটা ওদের সাথেই কাটল। ওর বর খুব আড্ডাবাজ লোক। আমি একা এসেছি শুনে জোর করে ওদের হোটেলে নিয়ে গেল। ওরা দুটি ফ্যামিলি মিলে অনেকে জন এসেছে। একসাথে সবাই, কত আনন্দ। একঘর লোকের মাঝে নিজেকে ভীষণ একা মনে হলো।
তোমরা আমার এই বাংলায় লেখা চিঠি দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে। ওদেশে গিয়ে আমাকে ওদের ভাষা শিখতে হয়েছিল। না হলে পেরে উঠতাম না। তখন থেকেই নিজের ভাষার প্রতি এক আবেগ তৈরির হয়। দুর্ভাগ্য এই যে আমার নিজের দেশে সেই আবেগ তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ কোনোদিন পাইনি। ওখানে আমি ছাড়াও আর দুজন বাঙালি ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম নিজেদের মধ্যে সব সময় বাংলাতেই কথা বলব। আর আমি ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম। হ্যাঁ বাংলায়। একটা ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে বহু বছর ধরে সৃষ্টি হয়। অথচ কি সহজেই কত অবজ্ঞার সাথে আমরা তা ভোলার চেষ্টা করি। একটা কথা মনে পড়লে এখনও খুব লজ্জা লাগে। ছোটবেলায় বাড়িতে বন্ধুরা আসলে আমরা ইংরাজিতে গল্প করতাম। স্কুল থেকে তেমনই নির্দেশ দেওয়া ছিল। কি করবে, স্মার্ট ইংরাজি উচ্চারণ যদি শিক্ষা আর সামাজিক অবস্থার সূচক হয় তাহলে এমন হওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
এখানে আসার আগে কিছুদিন বেনারসে ছিলাম।অসি ঘাটের পাশেই থাকতাম। আজকাল অসি ঘাটেও সন্ধ্যাআরতি হয়। সেই সময় খুব ভিড় থাকে। আমি ঘাটে যেতাম খুব সকালে। তারপর সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে আবার একটু রাতের দিকে যেতাম। একদিন রাতে সেই অসি ঘাটে একটা লোককে দেখে ভীষণ চমকে গেছিলাম। অবিকল জ্যেঠুমনি। আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে ওই লোকটা আমার জ্যেঠুমনি নয়। জ্যেঠুমনির মতো ওই লোকটাও বোধহয় অসুস্থ ছিল। কেমন যেন ক্ষয়ে যাওয়া চেহারা। কোটরে ঢোকা চোখ দুটি দিয়ে একদৃষ্টে বয়ে যাওয়া গঙ্গা দেখছিল। জ্যেঠুমনিও শেষের দিনগুলিতে ঠিক এই ভাবেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। যেন এই পৃথিবীকে আর একটু ভালো করে দেখে নেওয়া, আরও একটু বেশি দেখে নেওয়া। জ্যেঠুমনি ওর নিজের অংশটা আমার নামে লিখে দিল। আমার তো কোনো কাজে লাগল না। কেন জ্যেঠু ওটা বিক্রি করে নিজের চিকিৎসা করালো না। তাহলে তো আরও কিছুদিন এই পৃথিবীটাকে দেখতে পারত। জ্যেঠুর নিজের বলতে তো আমরাই ছিলাম। অন্য কেউ থাকলে কি এমনই হতো?
তোমাদের বলা হয়নি, বিগত কয়েক বছর ধরে আমি স্বামীজি পড়ছি। ওদেশের বেদান্ত গেসেলশ্যাফ্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছি। না না, সন্ন্যাসী হবার ইচ্ছা আমার নেই। সব কিছু থেকে পালিয়ে হিমালয়ের গুহায় বসে ধ্যান করে ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ হয় না, একথা তো স্বয়ং তিনিই বলে গেছেন। Divinize the life itself, একেই পাথেয় করে বেড়িয়েছি। প্রতিটি উপাদানে ইশ্বরের অস্তিত্ব খোঁজাই এখন আমার কাজ। শুধু কামনা বাসনার প্রতি নিমগ্ন হয়ে উপার্জন, জীবনের অনেকটা তো এভাবেই চলে গেল। এবার মুক্ত বিহঙ্গম। যদি মনে হয় আমার কোনো কাজে সমাজ উপকৃত হবে, তাহলে আবার যাব। নতুন করে জীবন শুরু করা যাবে না, তবে যেটুকু বাকি আছে সেটাকেই একটু গোছানোর চেষ্টা করছি মাত্র। আবার একটা নতুন সফর। তবে এই সফরে নিয়মের কোনো বালাই নেই । যেদিন ইচ্ছা হবে থেমে পড়ব, যেখানে ইচ্ছা হবে নেমে পড়ব।
কেমন আছো তোমরা? দেখো, স্বার্থপরের মতো এত পরে জিজ্ঞেস করলাম। এর আগেও একটি চিঠি লিখেছিলাম, না পাঠানো হয়নি। ইচ্ছা করেই কি পাঠাইনি? নাকি মনে ছিল না? কতো বিষয় পড়ানো হয়, আফসোস শুধু বাদ যায় মূল্যবোধের বিষয়টা। সেই শৈশব থেকেই জড়বাদ আর বস্তুবাদের প্রতি নেশার মতো ছুটছে সবাই। মানুষের প্রতি মানুষের টান ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। তোমরা আমাকেও সেই প্রতিযোগিতায় সামিল করেছ। ছুটতে ছুটতে হাঁফিয়ে গেছি আমি। কবে যেন সম্পর্কের বাঁধনটা আলগা হয়ে গেছে। দুদিকের টানেই তো গিঁট লাগে। হয়তো সেই টানেরই অভাব।
রাত হলো অনেক। এখন আর ঘুম আসবেনা। অনেক পুরোনো স্মৃতির ভিড়ে মাথাটা ভার হয়ে আসছে। হরিদা ফিরে এসেছে। ওকে সেদিন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে তার মানে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সেটিই এখন বাইরে বারান্দায় বাজছে ওর মোবাইলে।
শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো ॥
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা--|
- তোমার আত্মাজ
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴