একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তার রেডিও/সুকান্ত নাহা
একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও তার রেডিও
সুকান্ত নাহা
“দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও, দ্য নিউজ বুলেটিন রেড বাই ফৈয়াজ খান...দ্য প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী হ্যাজ সেইড টুডে...”
চামড়ার কেসিং এ মোড়া পোর্টেবল দিল্লি-মেড রেডিওটা বেজে চলেছে ফুল ভলিউমে। দুর্বল মিডিয়াম ওয়েভ, থেকে থেকে শ্রবণযোগ্যতা হারিয়ে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ছিল। যন্ত্রটাকে কানের কাছে ধরে, এদিক সেদিক ঘুরিয়ে তরঙ্গ পাকড়াও করার চেষ্টা করছে জগলাল। দৃশ্যটা এখনও স্মৃতির গায়ে পোস্টারের মতো সেঁটে আছে।
বিবিধ ভারতী কিংবা জওয়ান ভাইদের জন্য অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বাজলে ওটা তাকের ওপর পড়ে পড়ে গোঙাতো। গানের সুর কখনও প্রবল, কখনও মৃদুস্বরে বেজে যেত একটানা । জগলালের তাতে কোনও হেলদোল ছিল না। ও বরং তখন যত্ন করে খদ্দেরের পানে চুন মাখাতে ব্যস্ত থাকতো। নয়তো দোকানের বাইরে চিলতে ছাউনির নিচে বাঁশের মাচায় বসে থাকা উটকো 'না-খদ্দের' গোছের লোকদের সাথে খুচরো আলাপে জড়াতো।
বাগানে ঢোকার মুখে তেমাথা মোড়, যেখানে দিনে তিনটে বাস এসে দাঁড়াতো, সেই বাস স্টপেজের পাশে যে তেকোণা জমিটা, তার গা ঘেঁষেই ছিল জগলাল ঠাকুরের ছোট্ট কাঠের পান দোকান। সামনে তিনভাঁজ করা কাঠের ঝাঁপ। জগলাল যদিও পাশের খুপরি জানালা মাপের প্রবেশদ্বার দিয়ে এন্ট্রি নিত দোকানে। সাতসকালে এসে সাইকেলটা দোকানের গায়ে ঠেস দিয়ে, হ্যান্ডেলে ঝোলানো নাপতে ব্যাগটা নামিয়ে, কোমরের ঘুনসিতে বাঁধা চাবি দিয়ে কপাট খুলে, মাথা গলিয়ে প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিতে ঢুকে পড়তো দোকানের ভেতর। তারপর ভেতর থেকেই শেকল নামিয়ে দোকানের ঝাঁপ খুলে দিতেই পূবদিকের রোদ এসে হামলে পড়তো দোকানের ভেতর।
আদতে জগলাল ছিল নরসুন্দর । নাপিতকে হিন্দিতে "ঠাকুর" বলা হয় অতি শৈশবে সেই সাধারণ জ্ঞানের অভাব থাকায় তাকে রবিঠাকুরের বংশধর ঠাউরে বসেছিলাম । বাগানের পূবলাইনে ছিল জগলালদের "ঠাকুর পরিবারের" বসবাস। তিন পুরুষের বাসিন্দা তারা। বড়ভাই বিলাস, জগলাল মেজ, সেজ অনুপলাল ছোট রূপলাল। ওরা সকলে মিলে সাহেব,বাবুদের চুল দাড়ি কাটত। 'ঠাকুর' এর দেখা পেলে শ্রমিকরা সাইকেল থেকে তাদের নামিয়ে যত্রতত্র রাস্তার ধারে বসে পড়তো ইট পেতে। রফা হতো তলব অর্থাৎ বেতন মিললে তবেই হাজামতির উশুল মিলবে।
জগলালের ঠাকুরদা চা বাগানে পা রেখেছিলেন সেই ধূসর অতীতে ইংরেজ সাহেবদের " হাজামতি" করতে। জগলাল ঠাকুরের বড় ছেলে চান্দু ভাইয়ের কাছে শোনা, তার বাবার ঠাকুরদা নাকি এক ইংরেজ সাহেবের দেশীয় মেমকে ইংরেজি শেখানোর কাজ করতেন। সেই সুবাদে বাগানে দু ফসলি ধানি জমি পেয়েছিলেন বকশিস বাবদ।
এই ঠাকুর ভাইদের প্রত্যেকের এক একজন করে সাহেব ,বাবু বাঁধা ছিল। এই ভাই ওই ভাইয়ের বাঁধা বাবুর "হাজামতি " করবে না কখনও । অবশ্য কোনো ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জায়গায় অন্য এক ভাই প্রক্সি দিতে কসুর করতো না। ঠাকুর ভাইরা সকলেই বেশ চালাক চতুর হলেও জগলাল ছিল এক কাঠি বেশি ফিকিরি। বড় সাহেবের খাস "বারবার" হওয়ার সুবাদে ফিকিরি জগলাল, সাহেবের গালে ফিটকিরি ঘষতে ঘষতে রাস্তার ধারের ঐ জায়গাটা কায়দা করে বাগিয়ে নিয়েছিল। সাহেবদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে বেশ কিছু ইংরেজি লব্জও শিখে গেছিল। আর সে কারণেই নিজেকে ইংরেজি জানা "এলিট ইটালিয়ান বারবার" প্রতিপন্ন করতেই কিনা কে জানে, জগলাল ঠাকুর রেডিওতে খুব মন দিয়ে ইংরেজি খবর শুনতো।
দুপুরের দিকে দোকানে খদ্দের আসত না বললেই চলে। খদ্দের যা থাকত মূলত সকাল আর বিকেল নাগাদ। সকালে কাজে বের হওয়ার আগে লোকজন ভিড় করতো জগলাল ঠাকুরের দোকানের সামনে। পান,বিড়ি, খৈনি, সিগারেট ছাড়াও রকমারি কমদামি বিস্কুট, চানাচুর, লজেন্স, তাসের প্যাকেট, মেয়েদের টিপ, কাঁচের চুড়ি, কমদামি নেল পলিশ, চুল বাঁধার রিবন, কলম, খাতা এসব সাজানো থাকত দোকানে। তবে আমাদের মতো বালখিল্যদের যেটা আকর্ষণ করতো সেটা হলো কাঁচের বয়ামে রঙবেরঙের মার্বেলগুলি আর প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া টক মিষ্টি চূরণ বা চূর্ণ। চূরণের প্যাকেটে লুকনো বর্ণময় কার্টুন চরিত্রের জলছবির স্টিকার গুলোর আকর্ষণ ছিল দ্বিগুণ। ঐ দুটোর লোভে আমরা কজন বন্ধু মিলে গুটিগুটি পায়ে হাজির হতাম জগলাল ঠাকুরের দোকানে।
কিন্তু ঐ ইংরেজি খবর শোনার সময় দোকানে গেলে আমাদের ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। যতক্ষণ না খবর শেষ হচ্ছে জগলাল ঠাকুর মাল দেবে না। তাতে খদ্দের চলে যায় যাক। খবর শুনতে শুনতে কখনো গম্ভীর মুখে ঘাড় নাড়ত, কখনও মুচকি মুচকি হাসত । রবি ছিল আমাদের মধ্যে বয়সে বছর কয়েকের বড়। ওর এসব দেখে সহ্য হতো না। ও বলত," এমন ভাব করে দ্যাখ্, যেন কত বুঝছে। জিজ্ঞেস কর খবরে কী বললো, দেখবি কিস্যু বলতে পারছে না।" কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতো, না বুঝলে অত মন দিয়ে কেউ শোনে! ঠিক সেই সময় বাবুদের কেউ আলটপকা সিগারেট কিনতে দোকানে চলে এলে অবশ্য তৎক্ষণাৎ রেডিও নামিয়ে মাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো জগলাল। দিতে দিতে বেশ থমথমে মুখে মন্তব্য করতো ," বুঝলেন কিনা বাবু, দেশের পরিস্থিতিটা বহুত গম্ভীর আছে। চাওল আটাকা ভাও আউর ভি বাড়বে মনে হৈতেসে। হুমম..."
বাবু বলতে আমাদেরই বাবা,কাকা জ্যাঠাদের কেউ। তাদের দেখেই আমরা আড়ালে সরে যেতাম। কেননা দলবেঁধে অদ্দূর দোকানে জিনিস কিনতে গেছি দেখলে বাড়িতে নালিশ চলে যেতে পারে। দূর থেকে জগলালের কথা শুনেই রবি ফিসফিস করে বলতো," দেখলি তো , কী বললো! খবরে চাল আটার দাম বাড়বে একবারও বললো? শুনেছিস? "
আমারা ঢোঁক গিলি। আমাদের ইংরেজি জ্ঞানের বহর জগলাল ঠাকুরের চেয়েও খারাপ। রবিরও যে তথৈবচ, তা বলাই বাহুল্য। ও বলতো ," না বুঝেই দেখলি ফস করে কেমন বিজ্ঞের মতো বলে বসলো কিনা চাওল আটা কা ভাও...যত্তসব ভাঁওতাবাজি।"
হবেও বা। না বুঝে আমরা রবির মন্তব্যে সায় দিয়ে ফেলতাম। ক্রেতা জিনিস কিনে সরে যেতেই আমাদের কেউ একজন ছুটে গিয়ে আর্জি পেশ করতাম," ঠাকুর চাচা, চার পেকেট চূরণ দিজিয়ে না।" ব্যাস, কেল্লা ফতে। চূরণ হাসিল হতেই দৌড় দৌড়।
ঠাকুরের দোকানের আরেকটা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমাদের অমোঘ আকর্ষণ ছিল। সেটি হলো ক্যাপ্সটেন, নাম্বার টেন আর কমলা রঙের চারমিনার সিগারেটের খালি প্যাকেটগুলো। ঠাকুরের বড় ছেলে চান্দু ভাইয়া মাঝে মাঝে এসে দোকানে বসতো। রবি কিভাবে যেন ওকে ফিট করেছিল। হয়ত বড়বাবুর ছেলে বলেই ওকে একটু বাড়তি সমীহ করতো চান্দুভাইয়া। সেই খালি প্যাকেট দিয়ে লুকিয়ে তাস খেলতে গিয়ে বাবার হাতে উত্তম মধ্যম এখনও পিঠে মিঠে বেদনার মতো জাগরূক হয়ে রয়েছে।
জগলাল ঠাকুরের দোকানে সিগারেটের শাঁসালো খদ্দের বলতে ছিলেন কম্পাউন্ডারদাদু রাকেশ রঞ্জন ধর আর গুদাম দাদু অতুল বিশ্বাস। রাকেশদাদু ছিলেন চেন স্মোকার । দিনে দু তিন প্যাকেট সিগারেট হাপিস করে ফেলতেন। তিনি আবার ছিলেন এ অঞ্চলের একজন ডাকসাইটে শিকারিও। দাদুর দুই নাতি ছিল আমার বাল্যবন্ধু। ওদের কোয়ার্টার্সে গেলে দেখতে পেতাম দেয়াল জোড়া বাঘছাল, স্টাফড হরিণের মাথা, কাঁচের আলমারিতে সাজানো চিতার হাঁ মুখ। বাগানে বাঘ দেখা গেছে শুনলেই দাদু হাসপাতাল থেকে ফিরে আঁধার নামতেই টর্চ নিয়ে বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়তেন।
সেই সময়ে সন্ধ্যে নামতেই জংলী জানোয়ার বের হতো। তাই বেলা থাকতে থাকতে আগে ভাগেই বাড়ি ফিরে যেত জগলাল ঠাকুর। রাতে চান্দুভাইয়া দোকানে ঘুমোতো। এক এক দিন হয়তো কাছে পিঠেই কোথাও বাগানের ভেতর বাঘ শিকার করবেন বলে মাচা বেঁধেছেন দাদু। যাওয়ার পথে চান্দু ভাইয়ের কাছ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে গেছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা দাদু বসে আছেন । নিচে ছাগলের টোপ বাঁধা। কিন্তু বাঘের দেখা নেই। ততক্ষণে টেনশনে সিগারেটের প্যাকেট শেষ। সিগারেটের নেশায় একসময় বিরক্ত হয়ে মাচা ছেড়ে নেমে এলেন দাদু। সঙ্গীকে বললেন," আজ আর আসবে না রে। বকরিটা নিয়ে যা তোর ঘরে।" বলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিতেন। ফেরার পথে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন চান্দুকে," চান্দু, চান্দু রে, উঠ রে বাবা, এক পেকেট সিগারেট দে তো রে। নেশায় একেবারে পাগল হয়ে গেলাম। " চান্দুভাইয়া ঘুম চোখে উঠে দরজা খুলে বাড়িয়ে দিত সিগারেটের প্যাকেট।
জগলাল ঠাকুরের সেই দোকান ঢের আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দিনে দিনে চা বাগান অঞ্চলের শান্তির বাতাবরণ যখন কলুষিত হতে শুরু করেছে, একদিন পুজোর আগে নাগরাকাটা থেকে সাইকেলে মাল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইবাজের পাল্লায় পড়ছিল জগলাল ঠাকুর। ছিনতাইবাজরা ঠাকুরকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। রক্তাক্ত জগলাল ঠাকুরকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন তিনি বেহুঁশ। মাথায় অনেকগুলো সেলাই পড়েছিল। তার পর থেকেই কেমন যেন গুটিয়ে যায়, ঠাকুরচাচা। কিছুদিন পর রোগে ভোগে মারাও যায় সে। রাকেশ দাদু,অতুল দাদুরাও একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। চান্দুভাই আর তার ভাই কিছুদিন দোকানটা চালালেও বাপের মতো কেউ পারে নি। জগলাল ঠাকুর চলে যেতেই সেই রেডিওটাও আর বাজত না দোকানে। দোকানের জায়গাটা একজনকে বেচে দিয়ে চান্দুভাই সেলুন খোলে হাটখোলায়। আজও সে ঐ সেলুন খোলে নিয়ম করে। কিন্তু এখন আর কেউ বাড়ি বাড়ি এসে চুল দাড়ি কেটে যায় না। বাবুরা হাল ফ্যাশনের চুল কাটতে এখন ঝাঁ চকচকে সেলুনে যায়। তবু সুযোগ পেলে এখনও আমি চান্দু ভাইয়ের সাদামাটা সেলুনটাতেই গিয়ে বসি। ও যখন গায়ে সেলুন rapper টা জড়িয়ে দেয়, সেই কাপড়ে চেনা গন্ধ নিয়ে অতীত যেন ফিরে আসে। চুল কাটানোর ফাঁকে ওর মুখে পুরনো দিনের গল্প শুনতে বেশ লাগে। আর আজও কখনও বাগানে ঢোকার মুখে তেমাথা মোড়ে, জগলাল ঠাকুরের সেই হারিয়ে যাওয়া দোকানঘরের জায়গাটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কেন যেন স্পষ্ট শুনতে পাই " দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও, দ্য নিউজ বুলেটিন রেড বাই...."
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴