একই ভাষার দেশে/চিত্রা পাল
একই ভাষার দেশে
চিত্রা পাল
------------------------
অনেকদিন পরে দেখা তিনবন্ধুর। জমিয়ে গল্প চলছিলো আরামদায়ক বেতের চেয়ারে বসে। কিন্তু কে জানতো যে এখানে বসেই প্ল্যান হয়ে যাবে ভবিষ্যতের ভ্রমণের। কেউ জানতো না বলেই বোধ হয় প্ল্যানটা একরকমের পাকাপোক্তই হয়ে গেলো। প্রসংগটা উঠলো অদ্ভূতভাবে। একজন বলল এই বেতের চেয়ারগুলো কি আরামদায়ক। আমি কি জানি কেন বলে উঠলাম, এইরকম ভালো বেতের জিনিস আর এখানে পাওয়া যায় না। ওরা জিজ্ঞেস করলো,ক্যানো, এগুলো কোথাকার? আমি বললাম, এ একেবারে খোদ ত্রিপুরার।ওমা তাই নাকি? তারপরে অবধারিতভাবে কথা উঠে এলো আমি গিয়েছিলাম কিনা, আমি এককথায় বললাম, না, যাই নি। তারপরে দেখা গেলো, ওরাও কেউ যায়নি। কেউ যখন যায়নি, তাহলে, আমরা নিজেরাই তো এখন যেতে পারি। এবার একদিন সত্যিই আমরা তিনবন্ধু আর সংগে একজনের বোন সেও আমাদের বন্ধুই বলা যায়, এই চারজনে দমদম বিমানবন্দর থেকে আকাশপথে পাড়ি দিলাম ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়।
বিকেল নাগাদ এসে পৌঁছলাম আগরতলায়। এখান থেকে আমরা যাবো কুমিল্লা ভিউ লজ, যা একেবারে শহরের অন্যপ্রান্তে। তাই পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে বেশ রাত হয়ে গেলো। সময় ও লাগলো প্রায় সোয়া ঘন্টা দেড় ঘন্টা। ছোট ছোট জনপদ ঘন অন্ধকার ভরা ঝোপঝাড় পেরিয়ে,শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছনো গেলো কুমিল্লা ভিউ লজে।
এটি একটি বিশাল বাড়ি, বোধ হয় রাজবাড়ি বা ওই রকম কিছু একটা ছিলো, এখন ত্রিপুরা টুরিজমের হোটেল হয়েছে। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন পুরোদমে রাজমিস্ত্রিদের কাজ চলছে প্রতিদিন। তাই ওখানকার কেয়ারটেকার ওখানে থাকতে না দেবার অছিলা করছিলো। অনেক বুঝিয়ে শেষে আমরা দুটো ঘর পেয়েছিলাম। এটা হয়েছিলো রিপেয়ারের কাজের জন্য, ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ওদের ঠিকঠাক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায়। অসাধারণ ভাবে রাতের খাবার সাঙ্গ হলো, গরম ভাত, মুসুরডাল,বেগুনি পাঁপরভাজা,এঁচোড়ের ডালনা,মাছভাজা, মনে হলো অমৃত।তারপরে একঘুমে রাত কাবার।
নিটোল ঘুমের পরে অমল ভোর স্বর্গসুখের সমান। একেবারে পাখীর কূজনে কূজিত ভোর হলো।কতরকমের পাখী যে ডাকছে। পাখী দেখবো বলে এ বাড়ীর ছাদে গেলাম। ছাদে গিয়ে পাখীর সঙ্গে দেখা পেলাম রেলগাড়ির। শুনলাম ওই যে রেলগাড়িটা যাচ্ছিলো বাংলা দেশের,ঢাকা মেল। কাছেই বাংলাদেশের কসবা রেলস্টেশন। পাশেই কসবা কালীবাড়ি। দুইই এতো কাছে, এমন পাশে যে মনে হচ্ছিলো না স্টেশন টা আর কালীবাড়িটা দুটো দেশের। সকালে বেরিয়ে আগে গেলাম কালী বাড়ি।
এই কসবা কালীবাড়ির অবস্থান একেবারে ভারত বাংলা দেশ সীমান্তে ।এই মন্দিরের সামনে রয়েছে কমলা সাগর দিঘী।এই দিঘী মন্দির পনের শতকে সবই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা ধন্যমাণিক্য।তাঁর রাণী কমলা দেবীর নামেই নামকরণ দিঘীর। যখন দেশভাগ হয়ে ভারত পাকিস্তান দুটো রাষ্ট্র হয় তখন কালীমন্দির পড়ে ভারতে আর এই দিঘী কমলা সাগর পড়ে পাকিস্তানে। তারপরে দুদেশের মধ্যে অনেক কথাবার্তার পরে ঠিক হয় এই কমলাসাগর থাকবে ভারতে, পাকিস্তানকে তার পরিবর্তে অন্য কোথাও জায়গা দেওয়া হবে। সেইমতো কমলা সাগরের পরে তার ধার বরাবর দেখা যায় কাঁটা তারের বেড়া। আমরা দেখলাম কাঁটাতারের বেড়া দু দেশের সীমানা নির্দ্ধারণ করে চলে গেছে দূর হতে দূরে। দুদেশের সীমানার মাঝেই রয়েছে একটা হাট সেটা বর্ডার হাট । শুনলাম সেখানে দু দেশের জিনিসপত্রই কেনাবেচা হয়। এখানে এলে এক অদ্ভূত অনুভূতি হয়, মনে হয় এইসবইতো এক,তবে আর কেন ভাগ করা। সে কথা তো রাজা মন্ত্রীদের বোঝানো যাবে না, তাই সে কথা আর বলে লাভ নেই।
এবার আমরা বেরিয়ে পড়লাম অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখবো বলে। প্রথমে আমরা এলাম ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে। কথিত আছে, যযাতির পুত্র দ্রুহ এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আর দ্রুহর পুত্র ত্রিপুরের নাম অনুসারে এই রাজ্যের নাম হয় ত্রিপুরা। আমরা পৌঁছলাম একেবারে মন্দিরের কাছে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা ধন্যমাণিক্য। দেবী মূর্তি কষ্টি পাথরের কালী মাতার। এখানে আমরা পুজোও দিলাম। কিছুদূরে গিয়ে দেখা হলো মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যের তৈরি দেবী ভুবনেশ্বরী মাতার মন্দির । এইমন্দিরটি দেখলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। বিশ্বকবি রচিত বিসর্জন, রাজর্ষি নাটক উপন্যাস এই পটভূমিতেই রচিত।
এখান থেকে এলাম পিলক। পিলকে আছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। এখানে আছে প্রাচীন নানান মন্দির স্তূপ, প্রাচীন মুদ্রা এসব। বার্মিজ স্থাপত্যেরও নিদর্শন পাওয়া যায়।
এখান থেকে চলে এলাম নীর মহল। রুদ্র সাগর লেকের জলের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরমহল। নৌকো ভাড়া করে গেলাম নীর মহলে। এটি মহারাজা বীর বিক্রমকিশোর মাণিক্য তৈরি করেন প্রমোদ ভবন হিসেবে। রুদ্রসাগর লেকে প্রচুর পরিযায়ী পাখী দেখা যায়। তাদের কলতানে কোলাহলে মুখর রূদ্রসাগর। এই নীরমহল নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন জলেঘেরা রাজপ্রাসাদ কমই দেখা যায়।
ত্রিপুরা রাজ্যের এক দর্শনীয় স্থান ঊনকোটী। নীরমহল থেকে ঊনকোটি বেশ অনেকটাই দূরে তবু বেড়ানো দেশ দেখার আগ্রহ আমাদের নিয়ে এল এই পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড় কেটে খোদিত ও প্রোথিত মূর্তিময় পুণ্যতীর্থ ঊনকোটি। অরণ্যময় এই শৈব্য তীর্থ পুরো পাহাড়টাই মূর্তিময়। জটাজুটধারী শিবমূর্তির ভাষ্কর্যই প্রধান।এছাড়াও নানা পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তি সারা পাহাড় জুড়ে। ঊনকোটি নামের পেছনে কতগুলো গল্প আছে। কেউ বলে, কৈলাস থেকে কাশী যাওয়ার পথে এককোটি দেবতাদের নিয়ে এখানে রাত্রিবাস করেছিলেন। পরেরদিনসকালে দেবতারা তখনও ঘুমে অচেতন দেখে শিব একাই যাত্রা করলেন। এক কমে গেলে ঊনকোটি।আবার কেউ বলে কালু নামে এক কামারকে মহাদেব শর্ত দেন একরাত্রির মধ্যে এককোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করে দিতে হবে। কিন্তু কালু এক রাত্রে এক কম ঊনকোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হন। এমন নানাগল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে পাহাড়ে দেবদেবীর মূর্তি বিশেষ করে শিবের জটার ভাস্কর্য অনবদ্য।
এবার আমরা যাব আগরতলা।এখান থেকে অনেকটা দূর। পৌঁছতেই বিকেল হয়ে গেলো। আমরা যাব উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে।আগের রাজপ্রাসাদ ছিলো এখান থেকে দশ কি।মি দূরে। এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংস হবার পরে তৈরি হয় এই রাজপ্রাসাদ। মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য তৈরি করা এই প্রাসাদ যেমন বিরাট, তেমন স্থাপত্যেও অভিনব।এই মহারাজার সঙ্গে কবিগুরুর সখ্যতার কথা সকলেই জানে। এখানে তারই প্রমাণ অসংখ্য ছবির পরে ছবিতে। প্রাসাদের পাশে মন্দিরও আছে বেশ কয়েকটা। এই রাজপ্রাসাদ একেবারে শহরের প্রাণকেন্দ্রে, এখান থেকে দোকান বাজার সবই কাছে। সেখানেও ঘোরা হলো বেশ। এরপরে ঘরে ফেরা।
আগরতলায় এসে কখনও মনে হয়নি, যে আমরা অন্য কোথাও এসেছি। মনেহয় আমরা আমাদের ঘরে বা পাড়াতেই আছি। একতো দেশটা বাঙ্গালীর, সব জায়গায়, সর্বত্রই বাঙ্গালী। তার ওপরে এখানে বাড়ি ঘর গাছপালা লোকজন তাদের কথাবার্তা এমনকি আবহাওয়া পরিবেশ সবই যে আমাদের মতো। বাগানে দোলনচাঁপা গাছ, পথের ধারে কাঁঠাল গাছের সারি, সুপুরিগাছে ঘেরা বাড়ি সবই আমাদের বড় আপনার। ত্রিপুরার সব কিছু আমাদের বড় কাছাকাছি, বড় নিজের। যাক্ ঘরে ফিরে এলাম, আসার পরেই আবার সব জিনিসপত্র গুছোনো,বাক্স বন্দী করা। সকালে উঠেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে হবে। কারণ আমরা যাব ত্রিপুরার মনোরম হিল স্টেশন জাম্পুই, বেশ দূরত্ব আছে, সেটা আবার অন্য গল্প।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴