এক লহমায় অরণ্যে-২/মনীষিতা নন্দী
এক লহমায় অরণ্যে/২
মনীষিতা নন্দী
তোর্ষা ভেজা জলদা বুকে নিয়ন আলোর বক্সা
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট শেষ ক'রে ধূপঝোরার গাছবাড়ীদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ারের পথে। যেকোনো বিদায়ের সাথে স্বাভাবিকভাবেই একটা স্বতঃস্ফূর্ত মনকেমনের আত্মিক সংযোজন থাকে। আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। পেছনে পড়ে রইল আমাদের দু'দিনের সঙ্গী, গাছের মত বাংলো, বুকে নিয়ে একরাশ রঙীন বেরঙিন স্মৃতি - ছবি। গাড়ি চলছে। দু' পাশে রাশি রাশি চা গাছের সবুজ গালিচা। লাটাগুড়ির মহাকাল ছাড়িয়ে মালবাজার রোড ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। কখনও বাতাবাড়ি বা আইভিল চা বাগান, কখনও বা মঙ্গলবাড়ি অরণ্য আর চা বনভূমির মেশামেশি। চালসা অঞ্চলে চা গাছেদের বিরাট চাদরটাকে বাম দিকে রেখে চালসা মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরে সোজা যেতে যেতে মূর্তি নদীর আরও এক অংশের সাথে ভাব হল। নদীর এই অংশটিই মূলত সকলের ভীষণ পরিচিত এবং খুব পছন্দের সেই পিকনিক স্পট। আমরা যারা উত্তরবঙ্গে থাকি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এই জায়গায় একাধিকবার ঘুরতে আসার ও চড়ুইভাতির জম্পেশ অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফেরার স্মৃতি আছে। কখনও কখনও সে সংখ্যা এতই অধিক, যে, মাঝেমধ্যে কিছুটা একঘেয়েমির উদ্রেগ করে বৈকি! তবে আমাদের যাবার পথের এই আলতো ছুঁয়ে দেখাটুকুর মধ্যে আনন্দ আর জঙ্গল যাপনের উত্তেজনা মাখা কৌতূহল ছাড়া আর কোনো অতিরিক্ত অনুভব ছিলনা। মঙ্গলবাড়ি, দেব পাড়া, লাখিপাড়া, মোরাঘাট, তেলিপাড়া, ডিমডিমা, বীরপাড়া, দুমচি, রেডব্যাঙ্ক, ডায়না, গ্রাসমোড়, নাগরাকাটা, লুকসান, চেংমারি, ক্যারন, গাটিয়া, কুর্ত্তি, নয়াসাইলি, হিলা, বানারহাট, হলদিবাড়ী ইত্যাদি নানা রঙের নামী অনামী চা বনভূমির শ্যামল রূপচ্ছায়া আমাদের প্রাণের ও চোখের আরাম হয়ে সাথে ছিল পুরো পথ জুড়ে। গালিচার বুকে মাঝে মাঝেই আলতো তুলি বুলিয়ে সবুজ ফ্রেমে আকাশনীল রেখাছবি এঁকে দিচ্ছিল, ভালোবাসার জলঢাকা। ক্রমে শিশুবাড়ী, রাঙ্গালীবাজার, খয়েরবাড়ী, মাদারীহাট পেরিয়ে রওনা হ'বার প্রায় দেড় ঘন্টা সময় পর পৌঁছলাম তোর্ষা পাড় ঘেঁষা জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্কের ঠিক প্রবেশমুখে। এবার আবার থমকে দাঁড়ানো। জি পি এস অন ক'রে গন্তব্য রিসোর্টখানি খোঁজার চেষ্টা। ন্যাশনাল পার্কের গেট ছেড়ে হাইরোড ধরে আরও খানিকটা যাবার পর আমাদের রথ বামদিকের আর একটি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত কাঁচা রাস্তা ধরে চলতে লাগল। ঘড়িতে দুপুর দুটো। এদিকে আমাদের জিপ সাফারি শুরু হ'বে ঠিক বিকেল চারটেয়। হাতে দু' ঘন্টা সময়। চা বাগানের পর কিছু বাঁশ বাগান, কলা বাগানের ঘেরাটোপ পেরিয়ে মূল সড়ক থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে আমাদের বাংলোর দেখা মিলল। যাত্রাপথের সামান্য ক্লান্তি আর জি পি এস চালিয়ে বাংলো খুঁজে নেবার বিরক্তি, এক নিমেষে জল হ'ল যখন অবশেষে তার দেখা পেলাম। একটা বড় সবুজ লনের ওপর ছোটো ছোটো কটেজ। এক একটিতে এক এক রকম বন্যপ্রাণের ছবি। আমাদের জন্য একটি স্পটেড ডিয়ার অর্থাৎ শরীরে সাদা সাদা বিন্দুযুক্ত একটি হরিণের ছবিওয়ালা কটেজ নির্ধারিত করা ছিল। অসম্ভব মন ভালো করা এক পরিবেশ, সাথে পরিচ্ছন্নতা, খোলামেলা চারপাশ ও শৌখিনতার ছোঁয়ায় পরিপুষ্ট ঘরের ভেতর - বাহির। দু' ঘন্টার কিছু কম সময় হাতে তখন। তাড়াতাড়ি স্নান, লাঞ্চ শেষ করে তৈরি হয়ে নিলাম। তখন যে জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক লেখা গেটটা ছেড়ে এদিক ওদিক করতে হচ্ছিল, এখন আবার সে'খানেই যাব এবং সুড়ুৎ ক'রে গেট দিয়ে ঢুকে পড়ব ভেবে বেশ মজা হ'ল। বাংলো থেকে বেরিয়ে মেইন রোড ধরে সেই গেটের কাছে এসে আবার সেই থমকে দাঁড়ানো! আমাদের রথ ঢুকবেনা ওই পথে। উল্টো দিকেই আছে নানান মাপের হুডখোলা জিপ গাড়ীদের দাঁড়ানোর জায়গা। প্রায় প্রতিটি জিপেই সর্বোচ্চ ছ'জন একসাথে যেতে পারেন। আমরা দু'জন আর সাথে আরও চারজন সহযোগে আমাদের জন্য একটি নতুন রথের ব্যবস্থা হ'ল। "এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না"। জীবনে প্রথমবার হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে সত্যি মনে হ'ল (খুব সাময়িকভাবে), জীবনটাই যেন একটা আস্ত রথ। ঘোড়া নেই, বদলে স্টিয়ারিং সহ চালক আছেন। জিপ চলেছে উড়িয়ে ধুলো। দু'দিক জুড়ে মূলত শাল - শিমূলের ছড়াছড়ি। বসন্তের সূচনালগ্ন। তাই খুব কাছের গাছগুলিতে বেশী রকম সবুজের সমাহার নেই। তবে শিমূল - পলাশ গাছে গাছে রাঙা শিমূল আর আগুন পলাশ ছেয়ে রয়েছে। শাল গাছে কিছু সবুজ পাতা আর কিছু পাতায় কমলা সবুজ মেশানো রং ধরেছে অর্থাৎ ঝরে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত, আবার কিছু কিছু বাদামী হয়ে ঝরেও পড়েছে কিংবা পড়ছে। থেকে থেকে ময়ূরের দল অথবা একলা নিঃসঙ্গ রাজা - রাজকুমার অপরূপ নীল রঙে সেজে এদিক ওদিক ঘুরছে, আর একটু একটু জলপিপাসাও মিটিয়ে নিচ্ছে মাঝেমধ্যে। হঠাৎ কখনও খুব ভয়ে বা কোনও তাড়নায় মেলে দিচ্ছে পেখমখানি। তাদের কাছে ভয়ের হ'লেও, আমাদের চোখে বড় অপূর্ব সে দৃশ্য। ময়ূরীরা ঘুরছে দলবেঁধে। কখনও দেখা যায়, একলা রাজা তাঁর অসংখ্য গোপিনী, নিভৃতচারিণী ময়ূরীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। খুব দূরে হঠাৎ গন্ডার রাজ একঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলেন সবুজের দেশে। এ'ভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর পৌঁছলাম এক স্বপ্নের মত সবুজ কাঠের বাংলোর কাছে। সামনে ঘন সবুজ আর সেই সাথে নানাবিধ পাতাবাহার, অর্কিড, ফুলগাছেদের নান্দনিক সমাহার। একটু দূরে দেখলাম, একটা জলাশয়ের মত অংশে একটা দুটো বাইসন এসে বেশ শান্তিতে জল খাচ্ছে। আমাদের জিপ সারথি বলছিলেন, এই সবুজ স্বপ্নের হলং বাংলো থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাইসন ছাড়াও নাকি আরও অনেকের দেখা মেলে। তবে, সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হ'তে হ'লে, অন্ততপক্ষে পাঁচ - ছ'মাস আগেই বুকিং করা জরুরী একে। না হ'লে ঘর পাওয়া দুষ্কর। সেই সময়ই ঠিক ক'রে ফেলেছিলাম, এরপর কোনোদিন, বেশ আগে থেকে এই সরকারি বাংলো বুক করে রেখে আসব আমরা, শুধুমাত্র এ'খানেই থাকতে ও রাতের অরণ্যকে উপভোগ করতে। আজ যখন ঘরে বসে এই লেখা লিখছি, তখন না আছে সেই সবুজ বাড়ী, না বেঁচে আছে আমাদের সেই স্বপ্ন। কোনও এক রাতের গভীরে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে সবটুকু। বিপণনের কাছে মাথা নুইয়ে বিকিয়ে গেছে এত মানুষের এত বছরের হাসিকান্না মেশা, স্বপ্নছবির জলরঙে ভেজা স্মৃতিমেদুরতা। এরইসাথে পাশের বাংলায় চলছে একের পর এক ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা। সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে কলমের আঁচড়ে ........
"কাঠের বাড়ীর অবশেষ ভেঙে বয়ে যায় ছোটো নদী,
দ্বন্দ্ব দ্বিধার আঁকাবাঁকা, ভিজে নিরাপত্তার গদি।
সবুজ বিকেল সাথে ক'রে চলে অপেক্ষা ধুলোখেলা,
জল খেতে এসে হতবাক চোখে বারুদ বিষের জ্বালা।
ওরা তো বোঝেনি আগুন কী হয়, কাকে বলে মেঘ রোদ,
ওরা তো শেখেনি মিছে কথা মেশা ছদ্মবেশের ক্রোধ।
ওরা তো জানেনা কার ঘাড়ে ক'টা মাথা এসে ছিঁড়েকুড়ে,
গুলিবৃষ্টির জলে মেখে দেবে কলিজাটা তেড়েফুঁড়ে।
বন্যেরা বনে সুন্দর তবু রেললাইনের ধার,
কাটা পড়ে থাকে বজ্র দাঁতাল, রক্তিম সারে সার।
মাতৃক্রোড়ের ওম থেকে টানা ঝাঁপ দেয় শিশু পাঁকে,
রাজপথে ভয় হীন চলে ওরা, শ্লোগানকে চেপে বুকে।
ইসকুলে রোজ তালা ঝোলে, ঘরে উনুন জ্বলে না ভোরে,
মাভৈ ছেলে, ছুটে গিয়ে ধরো টুটি চিপে রাজাটারে।"
যাইহোক, আবার ফিরি জঙ্গলের জার্ণালে। হলং বাংলোর সামনে কিছু ছবি তোলা হ'লে আমরা আরও গভীরের সবুজ পথে পাড়ি জমালাম। চতুর্দিকে সম্বর হরিণের ছড়াছড়ি। সেইসঙ্গে ময়ূরের রাজত্ব তো আছেই। জঙ্গলের বুকে বয়ে চলেছে এক চিলতে বুড়িতোর্ষার জল। তার ওপর দিয়েই আমাদের সাথে নিয়ে এগিয়ে চলল জিপ ছলাৎছল। অনেকটা ঘোরাঘুরির পর যখন প্রায় শেষ বিকেলে এসে পৌঁছেছি, আমাদের নিয়ে আসা হ'ল জঙ্গলের ভেতরেই কোদাল বস্তি নামের একটি জনবসতি এলাকায়। মূলত, মেচ ও টোটো জনজাতিগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। ওদেরই একটি প্রাথমিক স্কুলঘরের সামনে এল ই ডি জ্বালিয়ে ওরা পরিবেশ করল পাঁচরকমের মেচ ভাষার সঙ্গীত ও নৃত্য। এ ব্যবস্থা বিশেষত পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য। সবুজ জঙ্গলে শেষবিকেলে এমন রঙবেরঙের উপস্থাপনা, সাথে খাবারের দোকান আর মানুষের জমায়েতে সত্যিই মনে হচ্ছিল সেই ছোটবেলায় শেখা ছড়ার গানটার কথা.... "জলদাপাড়ার জঙ্গলে এক মেলা বসেছে"। পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ আবার আমরা এসে পৌঁছলাম ন্যাশনাল পার্কের গেটে। যাবতীয় চেকিং শেষ ক'রে আমাদের গাড়ীতেই হলং বাংলোর সামনে এলাম। ওখান থেকে আজ হাতির পিঠে চড়ে সাফারির সূচনা হ'বে। উদ্দেশ্য সবুজ ভেদ ক'রে আরও গভীরে যাও, যেখানে ঢোকেনা জিপ। পাঁচ - ছ'জন সাফারিতে বের হবে। এক - এক জনের পিঠে চারজন ক'রে বসবেন এবং সেইমত পথ চলা শুরু। তো যাত্রা শুরু হ'ল। অপূর্ব শিল্পসুষমায় লাইন দিয়ে দুলকি চালে চলেছে বাধ্য হাতির দল। পিঠের ওপর হাওদা। সেখানে বিন্দুর মত বসে আছে সভ্য দেশের, কালের, মুখোশ পরিহিত, ক্ষুদ্র, নগণ্য মানুষের দল। এখানেও হাতিরা প্রত্যেকেই সরকারি বেতনভোগী। সভ্য মানুষেরা কর্মী বানিয়েছে তাদের। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম আর প্রত্যেক নামে নামে আলাদা ক'রে খাতা রয়েছে। আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত মা যখন চাকরীতে যাবে, শাবক হাতিটিকেও তার সাথে সাথে যেতে হ'বে। অর্থাৎ দেখে দেখে শেখা। এক্সপিরিয়েন্স গ্যাদার করা। তিন বছর বয়স থেকে শুরু হ'বে তার ফর্মাল ট্রেনিং। তার মধ্যে রয়েছে, পর্যটকদের জঙ্গল সাফারি করানো, সরকারি মালপত্র বহন - ইত্যাদি নানান বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজকর্মের প্রথাগত তালিম। আমাদের যাত্রাপথেও এমন একটি শিশু 'যাত্রামঙ্গল', ছুটে চলেছিল তার মায়ের পিছু পিছু। বিভিন্ন বামদিক, ডানদিক হয়ে হয়ে ঘন জঙ্গল শেষে আমরা এলাম ঘাসের জঙ্গলে। অনেক দূরে দেখলাম সার বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইসনের পাল। এই এলাকায় জঙ্গল বেশী গভীর নয়। চলতে চলতে দুই বিশালাকার গন্ডারের মুখোমুখি হ'লাম। আক্ষরিকভাবেই গন্ডারের চামড়া গায়ে তারা ঘাসপাতা খাচ্ছে। পিঠের ওপর বক, পাখী আরও কত কিছু এসে বসছে আবার নিজেদের মত সময় কাটিয়ে বিদায় নিচ্ছে কিন্তু তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই তাতে। এত বড় বড় হাতির পিঠে চেপে মানুষেরা এসেছে তাদের দেখতে, তাতেও কিছুই আসে যায়না যেন। ঢুলুঢুলু চোখ দুটোয় ভরপুর ক্লান্তি। যেন বলতে চাইছে, "আবারও চলে এসেছ তোমরা? রোজ রোজ কী দেখে যে এত মজা পাও, কে জানে! নতুন তো কিছুই নেই। দ্যাখো, আর কী!" এই ভাবতে ভাবতেই আরও বেশী করে খাবারের দিকে মনোনিবেশ করল। এরই মধ্যে সেলফি স্টিক হাতে হাতির পিঠে বসে আপন মনে কথা বলতে থাকা, উত্তেজনায় ডগমগ কিছু লোকজন দেখে মনে মনে হয়তো বেশ খানিক হেসেও নিল তারা। ঘাসজমির ওপর গন্ডারের এই দেখা পাবার বিষয়টা বড্ড বেশি প্রত্যাশিত বলে মনে হয়েছিল। হঠাৎ দেখা বা আনপ্রেডিক্টেবলিটির কিছু খুঁজে পাইনি সেখানে। মনে হ'ল, মূলত, দর্শকের চাহিদা মেটাতেই ওদের এ'খানে সাজিয়ে গুছিয়ে এনে রাখা হয়েছে হয়তো। সে যাইহোক, হাতির পিঠে দুলতে দুলতে জঙ্গল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মোটের ওপর বেশ ভালোই হ'ল। এবারে আবার ব্যাক টু হলং বাংলো। হাতিদের সাথে ছবি তোলা। সেখান থেকে গাড়িতে আমাদের থাকার জায়গায় ফিরতে ফিরতে কেন জানিনা বার বার গুন্ গুন্ ক'রে উঠছিলাম প্রতিমা বড়ুয়ার সেই গান, "হস্তীর কন্যা, হস্তীর কন্যা বামনের নারী, মাথায় নিয়া কাম কলসি ও, সখী হাতে সোনার ঝাড়ি ...... ও মোর দান্তাল হাতির মাহুত রে, যেদিন মাহুত ভূটান যায়, নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে ..... ও মোর হায় হস্তীর কন্যা রে, খানিক দয়া নাই, মাহুত........"। কটেজে ফিরে ব্রেকফাস্ট শেষে বেরিয়ে পড়লাম বক্সার পথে। উত্তর মাদারিহাট ধরে বেশ কিছুটা যাবার পর তোর্সার সাথে দেখা হ'ল। হাসিমারা ফ্লাইওভারের সাথেই, মাঙ্গোলি, মধু, দিমা চা গালিচা পেরিয়ে পৌঁছলাম রাজাভাতখাওয়া চা বাগানের খুব কাছেই। বক্সা টাইগার রিসার্ভ ফরেস্টে ঢোকার যাবতীয় অনুমোদন গ্রহণের পালা শেষ ক'রে, আবার শুরু এক নতুন ঘন সবুজের উপাখ্যান। তবে সত্যি বলতে কী, জলদাপাড়ার জঙ্গল দেখে ফিরে সবুজকে ঠিক সে'ভাবে কাছে না পাবার যে দুঃখ ছিল, বক্সার অরণ্যের মহিমা এক মুহূর্তেই আমাদের সে সব কষ্ট মুছে এক অদ্ভুত কচি পাতা ও শুকনো পাতার মিশেল গন্ধে মন মাতিয়ে দিল। বিকেলে জিপ সাফারিতে বের হ'লাম। এবারের হুডখোলা জিপটায় কেবল আমরা দু'জন আর আমাদের শিশু সারথি ছিলেন। বক্সার এই জঙ্গল ভ্রমণে যে আনন্দ আর ঘন সবুজের দেখা আমরা পেয়েছি, তেমনটা সত্যিই আর গত দু' দিনে অন্য কোথাও পাইনি। আমাদের জিপগাড়ীটি দলছুটের মত একা একা, দু'পাশে ঘন সবুজের মাঝে গাড়ির চাকায় তৈরী কাঁচা রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে চলছিল। সাথে আবারও সেই রোমাঞ্চকর নিশ্চুপের উদযাপন। একটা গা ছমছমে অনুভব আর সেই মনকেমন করা পাতাদের গন্ধ। এই জঙ্গলে কোনো কৃত্রিম স্পর্শ নেই, কোনো প্রচেষ্টার ছন্দমিল নেই। আছে শুধুই এক বিপুল সহজ স্বাভাবিক নিস্তব্ধ গতিময়তা। খানিকক্ষণ চলার পর একটা জলাশয়ের কাছে এসে থামল জিপ। যদি কিছু দেখা যায়, সেই আশায়। এখানে যেহেতু কৃত্রিমের লেশমাত্র প্রায় নেই, তাই যেটুকু দেখব, তা অবশ্যই হঠাৎ দেখা। সাথে না দেখাটুকুও ভীষণরকম স্বতঃস্ফূর্ত। আর সেই সহজ স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দেই জলাশয়ের ধারে কাছেও কেউ এলো না আমাদের দেখা দিতে। কিন্তু কিছুটা দূর থেকে অন্য একটি জিপের চালক, আমাদের চালককে নির্দেশ দিলেন, তাঁকে অনুসরণ করবার জন্য। কারণ, সামনেই কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল। খানিকটা এগিয়ে দাঁড়াল আমাদের জিপ। আর তার থেকে কিছুটা দূরত্বে আরও একটি। দুইয়ের মাঝখান দিয়ে দলে দলে পার হয়ে যেতে লাগল বন্য দাঁতাল। এরা কিন্তু সেই তথাকথিক শহুরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয়। তাই একটু এদিক থেকে ওদিক হ'লেই একমুহূর্তে উল্টে যেতে পারে সবগুলো জিপ; সেইসাথে ভেতরের মানুষগুলোর চিহ্নমাত্রও সারাজীবনের মত সমূলে উৎপাটিত হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর বুক থেকে। খুব সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে এই ধাপে আমাদের উত্তরণ ঘটল এক অপার বিস্ময়, ভালোলাগা, রোমাঞ্চ সাথে কিছু প্রশ্ন নিয়ে। আনসিভিলাইজড বনাম সিভিলাইজড এর দ্বন্দ্ব নিয়ে। যে মুহূর্ত থেকে আমি সভ্যতার আওতায় আসছি, সে মুহূর্ত থেকে আমার স্বাধীনতার জল ঠিক কোন্ খাতে বইছে? সে কি এক জায়গাতেই থেমে থাকছে? না, একটু হ'লেও খর্ব হচ্ছে তার ডালপালা, গতিপ্রকৃতি? রাজনীতি যেমন সিভিলাইজেশনের একটা অন্যতম উপাদান, তেমনি, আনসিভিলাইজড জীবনচর্যার ক্ষেত্রে রাজনীতির গুরুত্ব কতটা? বা আদৌ কি কোনও গুরুত্ব আছে? সর্বোপরি, এই সভ্য - অসভ্যের বিচারের চাবিকাঠিটাই বা কী এবং এই বিভাজনের অর্থ ও প্রয়োজনীয়তাটাই বা কোথায়? আনসিভিলাইজড ও সিভিলাইজড ক্ষেত্র দিয়ে অস্তিত্বের সংকটকে কোন্ কোন্ ভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়? এই 'অস্তিত্ব' কথাটির নিগূঢ় সারমর্মখানি কীই বা হ'তে পারে বা হওয়া উচিত? ..... না না। ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, এবার থেমে যাও। এখানে "আনকনশাস ফ্রিডম" বিষয়ে কেউ ভাবতে দেয়নি তোমায়। তাইতো, কী যে করি.... শুধু কথায় কথায় তিলকে তাল করা অভ্যেস !..... ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। আমরা এসে পৌঁছলাম জয়ন্তী নদীর কাছে। বনের রাজার দেখা পেলামনা। তবে নদী আর ঘনজঙ্গলের ঠিক মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে তাঁর গল্প শোনাচ্ছিলেন আমাদের জিপ সারথির এক কৃষ্ণসখা। কীভাবে জঙ্গল জুড়ে জায়গায় জায়গায় লুক্কায়িত ক্যামেরা বসিয়ে তাঁর উপস্থিতি অনুমান করা হয়, কি বিরাট তাঁর পায়ের ছাপ, সে'সব নানা রঙের গল্প। ফেব্রুয়ারীর জয়ন্তীতে জল ছিলনা। একেবারে শুকনো, খটখটে একটা সাদা - ধূসরের এবড়োখেবড়ো - ঘুমন্ত - নির্জীব চাদর। লোকালয়ের ওপর দিয়ে যাবার সময় বাসন্তীরঙা শাড়ীতে সেজে কিছু নতুন কুঁড়িকে দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। অগত্যা বাড়ীর জন্য মনকেমন। ফেব্রুয়ারীর চৌদ্দ, সরস্বতী পুজো। আজ ফিরতেই হ'বে। সোজা জলপাইগুড়ি। একরাশ সবুজ পরিতৃপ্তির হাওয়ায় ভেসে যেতে যেতে, এ যাত্রায় শেষবারের মত, জঙ্গলের বুক চিরে আমাদের রথ এগিয়ে চলল বাড়ীর পথে।।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴