এক মুঠো ছাই/পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
এক মুঠো ছাই
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
"আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়/আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি, আমার পিয়াসী বাসনায়......"
কবিকে স্মরণ করে বলতে ইচ্ছে হয় সারাজীবন ধরে নিজের থেকে ও প্রিয়জন বা প্রিয় বস্তুটি কি তা না জেনেই সেই "প্রিয় " শব্দে যুক্ত কিছু একটা খুঁজতে জীবন কাটিয়ে দিলাম। যা নেই সেই জিনিসকে পাওয়ার জন্য অর্থাৎ, "কোথায় পাব তারে?" মায়ের আঁচল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সারা জীবন ধরে ভালোবাসা নামক শব্দকে ঘিরে হাঁতড়ে বেড়ালাম। ভালোবাসা শব্দটা হাটে বাজারে বহুল আলোচিত। পৃথিবী থেকে ভালোবাসা কমে গেছে। আর ভালোবাসা নেই বলেই এই শব্দের এত বাড়বাড়ন্ত, বা এত তাকে শোনা যায়। ভালোবাসা অর্থাৎ মনের যোগ্য বাসস্থান খুঁজে পাওয়া খুবই দুস্কর বিষয়। সাময়িক কিছু অনুভূতি এবং উপলব্ধির কারণে কখনো কখনো কারো কারো প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু ভুলে যাই প্রেম মানে আংশিক কারো শরীর বা মন বা অর্থ সম্পত্তি নয়। প্রেম মানে ভালো লাগা নয়। ভালো লাগা এবং ভালো বাসা দুটি ভিন্নার্থক শব্দের টানাপোড়েনে জীবন কেটে গেল। আমি নিজে কি, সেটা সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি করতেই এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলাম। এই প্রসঙ্গে ছোটবেলায় শোনা সেই রাজা ও সন্ন্যাসীর গল্প অনেকটাই মানানসই।
"...সে সন্ন্যাসী এমন সন্ন্যাসী যিনি মৃত মানুষকে প্রাণশক্তি দিয়ে জীবিত করছেন, আগ্নেয়গিরির আগুনে পুড়ে যাওয়া বিশাল অরণ্য, কেবলমাত্র বাঁ হাতে কমুন্ডলে রাখা সামান্য জলের ছিটেয় সবুজ বনানীতে পরিণত করেছেন। রাজা পেয়াদা পাঠিয়ে সেই সন্ন্যাসীকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু সন্ন্যাসী রাজপ্রাসাদে গেলেন না। রাজা সিপাহি, সান্ত্রি পাঠালেন, সন্ন্যাসী রাজপ্রাসাদে গেলেন না। রাজা তার মন্ত্রী পাঠালেন, সন্ন্যাসী রাজপ্রাসাদে গেলেন না। বিরক্ত হয়ে রাজা এলেন সন্ন্যাসীর কুটিরের সামনে। রাজা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, "ওহে ক্ষুদ্র মানব, তুমি কি জানো আমি কে?" কুটিরের বাইরে বেরিয়ে এসে সবিনয়ে সন্ন্যাসী বললেন, "তুম এক মুঠঠি শ্মশানকি রাখ হো" অর্থাৎ তুমি কেউ নও কিছু নও কেবলমাত্র শ্মশানের একমুঠো ছাই। মুহূর্তে অহংকারী রাজার উপলব্ধি হল এবং সন্ন্যাসীর পায়ে এসে পড়ল। আসলে আমরা তো সবাই একমুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই নই।
যার জন্য আমাদের এই পৃথিবীতে আসা সেই "মা"কেই আমরা ভালোবাসতে পারি কোথায়? মায়ের ঋণ শোধ করবার নয়। আমার ভিতরের আমিকে চিনতে, অনুভব করতেই সারাজীবন কেটে গেল । আমি নিজেই জানি না কিসের জন্য, কিসের খোঁজে এই জীবন? কি এই জীবনের উদ্দেশ্য। আত্মা কি? পরমাত্মাই বা কি ইত্যাদি ইত্যাদি। মানব মানবীর প্রেম, ইঁট কাঠ, পাথরে বানানো বহুমূল্যবান প্রাসাদের নিস্প্রান ছন্দহীন স্পন্দন হীন ভাবে সারা জীবন অন্ধকারে প্রিয় বস্তুটির সন্ধানে জীবন কাটিয়ে দিলাম। এই টুকু বুঝলাম ভালোবাসতে গেলে সর্বপ্রথমে ত্যাগ করতে হবে। যাকে ভালবাসছি প্রয়োজন হলে তাকেও ত্যাগ করতে হতে পারে। এটাই বাস্তব উপলব্ধি যখন হ'ল, তখন গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে।
জীবনের এই প্রান্তে এসে মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই একটা লড়াই এবং সব থেকে বড় লড়াই নিজের সাথে নিজের। জীবনটা কখনোই শান্ত নয়। বরং একটা উনুনে বসানো দুধ জাতীয় কিছুটা তরল পদার্থ। কখনো ফুলছে, কখনো ফুঁসছে, কখনো আবার উথলে পড়ছে। সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে চাই একটু শান্তি। ভালোবাসা বলতে সামগ্রিক ভালোবাসাই এখন আমার একান্ত কাম্য।
" মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।"
সেই মানুষের সাথে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে কবির কথায় বলতে হয়,
"এবার পুজোয় তাকে,
আপনারে দিতে চাই বলি,
ভালো মন্দ মিলায়ে সকলই।"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴