এ নামেই ডাকব/অরিন্দিতা বিশ্বাস
এ নামেই ডাকব
অরিন্দিতা বিশ্বাস
জানো তো দাদা কয়েক লাইন লেখার পর আর ইচ্ছে করছিল না লিখতে। তবুও লিখতেই নিলাম, নইলে যে তোমার খুব অভিমান হত। তোমাকে নিয়ে লিখব এই ইচ্ছে যদিও অনেক দিন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এরকম লেখা লিখতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি!! এরকম লেখা লিখতে চাইনি দাদা, যে লেখা তুমি পড়বে না। ভুল ত্রুটিগুলো সংশোধনে তোমার ছোঁয়া থাকবে না। বারবার মোবাইল বাজবে না আর ওপার থেকে বলবে না এটা ঠিক কর বাবু, আরেকটু পড়। এত তাড়াহুড়ো কেন করিস বলত? সেই বকুনিগুলো আর কোনও দিন আসবে না জেনেও লিখতে বসেছি। বসতেই হবে। তুমি তো সবই জানো দাদা। যখন তুমি শব গাড়িতে চেপে রাজার মতো যাচ্ছিলে, কেঁদে ভাসিয়ে বলেছিলাম আর কলম চলবে না। আর অক্ষর বুনন হবে না। তুমি যে আমার সাহিত্যগুরু ছিলে। গুরুর ছোঁয়া ছাড়া ছাত্রীর আর কী মূল্য থাকে। যখন এই একই কথা বারবার বলছিলাম দেবাশিসদাদা, স্মিতাদি বলেছে কলম চালাতেই হবে বোন, সৃজনে থাকতেই হবে, তোমার। "রোববারের সাহিত্য আড্ডা" বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আমাদের চোখে তোমার স্বপ্ন দেখতে হবে, তোমার দেখা স্বপ্ন বাস্তব করতেই হবে। নইলে আর তোমায় ভালোবাসলাম কোথায়!! তোমার দেখা রোববারের সাহিত্য আড্ডার স্বপ্ন, তোমার সৃজনশীল বীরপাড়া গড়ার স্বপ্ন আমাদের চোখেই বেঁচে থাকবে এই আশীর্বাদ কর।
হ্যাঁ পারিনি, দুদিন কী করেছি মনে নেই, চোখের কালি শুধুই জানে। তুমি চলে যাওয়ার ঠিক দুইদিন বাদে মধুর সাথে দেখা হয়েছিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তুমি তো কোনওদিন চাওনি তোমার ছোট বোনগুলোর এমন বেহাল দশা হবে। খুব অভিমান আমরাও পুষে রেখেছি ঈশ্বরের ওপর ঈশ্বর রূপের মানুষগুলোকে ধরাধামের থেকে কেড়ে নেওয়ার কিসের এত তাড়া থাকে ওনার বুঝিনা!! ওর মুখ এমন হয়েছিল যেন পিতৃবিয়োগ হয়েছে। তুমি তো আমাদের পিতাই ছিলে।
এই যুগে সবাই যখন আমরা সামনের সারি চাই, তখন তুমি বরাবরই সবাইকে সামনে রেখে সবটা পরিচালনা করে নিজে লুকিয়ে থাকতে মুক্তোর মতো। আমরা কত সাধনা করে হাতে গোনা দু তিনবার তোমায় মঞ্চে ওঠাতে পেরেছি। আমরা তোমার বেঁধে বেঁধে থাকার মন্ত্র রক্তে মেশাতে বারবার চেষ্টা চালাচ্ছি, তুমি শক্তি দিও।
জানো দাদা, তোমায় বিদায় দিয়ে তিনদিনের মাথায় তোমাকে নিয়ে ছন্দ গেঁথে একটি কবিতা লিখেছি। রাজর্ষি দাদা পাবলোকে সুর দিতেও বলেছি। আবেগে ভেসে বলেছি রোববারের সাহিত্য আড্ডায় তোমার স্মরণে মাঝে মাঝে গাইব। সে তুমি ভালোই জানো সে গান- কবিতা কিছুই হয়ত হয়নি! ভুলে ভুল........। আর সে কবিতায় সুর তুলবে এমন সাহস রাজর্ষি দাদা, পাবলোর কবে হবে তা জানো ঈশ্বর রূপে তুমি।
তোমার সাথে প্রথম পরিচয় "রোববারের সাহিত্য আড্ডার" দ্বিতীয় বৈঠকে। আড্ডার প্রথম দিন আমার যাওয়া হয়নি। আমার প্ৰিয় স্মিতা দিদি ছাড়া সবার সাথেই সেদিন আমার প্রথম পরিচয়। সেদিন সবার আগেই পৌঁছে নেতাজী পাঠাগারের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। তুমি আর দেবাশীষ দাদা হেঁটে হেঁটে আসছিলে। কোনোওদিন কথা না হলেও দেবাশীষ দাদা মুখ চেনা ছিল। কিন্তু তোমায় প্রথম দেখলাম। তোমার পাহাড় সমান ব্যক্তিত্ব তোমার চেহারায় ফুটে উঠত। দেখেই সমীহ করতে ইচ্ছে করল। তুমি প্রথম কথা বললে, কথার উত্তর দিলাম। তারপর আড্ডায় তোমার ক্যাপ্টেনশিপ মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। রোববারের সাহিত্য আড্ডাকে চিনলাম। সম্মানে তোমাকে স্যার বলে সম্বোধন করতে শুরু করলাম। পরে তুমি স্মিতা দিদিকে বললে ওকে জানিয়ে দিও ও যেন আমাকে কাকু, দাদা যা ইচ্ছে বলুক স্যার যেন না বলে।
সেই থেকে দাদা ডাকতে শুরু করলাম। এই দাদা ডাক যে সত্যিই সহোদরের মতো দাদা হয়ে যাবে সে জানত বোধহয় ঈশ্বর। কিন্তু তোমার যে অনেক দায়িত্ব ছিল দাদা, জেঠু জেঠিমার মুখের দিকে তাকাতে ভয় হয়, যদি ওরা আমাদের কাঁদতে দেখে সাহস হারায়। তোমার বোনের ব্যাক্তিগত জীবনেও যে তোমার খুব দরকার ছিল দাদা। রক্তের সম্পর্কে, চেনা সম্পর্কে অনেক দাদা আছে। কিন্তু মায়ের পেটের একমাত্র দাদা ছাড়া তোমাকে নিয়ে শুধুই দুইজনকে দাদা বলে ডাকি, যার আগে নাম আসে না বা অমুক দাদা তমুক দাদা আসে না। সেই সংখ্যা কমে গেল যে, না, না থুড়ি যায়নি। তোমাকে আমি সারাজীবন দাদা বলেই ডাকব। তুমি নিশ্চই শুনবে কিন্তু উত্তর দিয়ে বলবে না এটা বলিস না বাবু, আরও কয়েকবার পড় বাবু, তোর দোষগুলো শুধরে নে। তুই নিজের জন্য একটু ভাব, আর অন্য কোনোও চাকরির পরীক্ষা দে। এই কম মাইনের চাকরির বিকল্প কিছু ভাব।
ছোট বোনের অধিকারে তোমাকে খুব শাসন করেছিলাম সেদিন, যেদিন দেখলাম তুমি অফিসে বিকেল পৌনে চারটেয় দুপুরের খাবার খাচ্ছ। খুব বলেছি দাদা এই অসময়ে খাবার না খেয়ে এখন থেকে দুপুর ২টা থেকে ২.৩০ এর মধ্যে খেয়ে নেবে। নইলে শরীর খারাপ করবে তো। তুমি প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলে। সত্যিই এভাবেই এড়িয়ে গেলে, এভাবেও এড়িয়ে যাওয়া যায়!!! খাবার খাওয়ার সময় পরিবর্তন না করে খাবারের প্রয়োজন সরিয়ে নিলে। একদিন তোমার অফিস থেকে দেরিতে বেরোনোর রহস্য বের করলাম যে তুমি বিকেলে অনেকটা হেঁটে শরীর চর্চা করে তারপর বাড়ি ফেরো। মজা করে বলেছিলাম এই জন্যই তো এত সুন্দর শরীরের গঠন ধরে রেখেছ। মজাটা তোমার এতই খারাপ লেগেছিল দাদা যে আর ঠাট্টাই করতে দিলে না।
আরও অনেক কিছু মনের মধ্যে গেঁথে আছে। থাকবে... আজীবন। তুমি আছো। তোমার বাঁধানো ফটো দেখতে ইচ্ছে করে না। তোমার ছবি আমাদের মনের রং দিয়ে আঁকা রয়েছে, থাকবে। তুমি শুধুই আশীর্বাদ ও সাহস দিও আমাদের চোখে যেন তোমার দেখা ছবি আঁকতে পারি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴