এ কালের বাল্যবিবাহ ও কিছু কথা/সুনীতা দত্ত
এ কালের বাল্যবিবাহ ও কিছু কথা
সুনীতা দত্ত
বাল্য বিবাহ কথাটা শুনলে সবার হয়তো কিছু বিশেষ বাংলা অথবা হিন্দি সিনেমার দৃশ্য মনে পড়ে। এ অনুভূতির সাথে আমি নিজেও পরিচিত।তবে এ অনুভূতির থেকে সরে কিছু অন্য চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়,যা আমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের জীবনে দেখে থাকি।
1929 সাল, বাল্যবিবাহ নিরোধক আইন কার্যকর হয়েছিল ভারতীয় ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে। সেই সময় থেকে প্রায় শতবর্ষ পার করে এসেছি।তখন নারী পুরুষের আইনগত বিয়ের বয়স ছিল 14 ও 18 বছর। শতবর্ষ পরেও ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে এই চিত্র ক্রমবর্ধমান।1929 সালের পরবর্তী সময়ে 1978 সালে PCMA অনুযায়ী বিয়ের বয়স মেয়েদের ও ছেলেদের জন্য 18 এবং 21 বছর হিসাবে সংশোধন করা হয়েছিল।এই বয়স নির্ধারণের প্রধান উদ্বেগ ছিল সেই সময়ের "মাতৃমৃত্যুর হার বৃদ্ধি"।পরিসংখ্যান গত তথ্য জানানো বা আইনি জটিলতা নিয়ে কিছু বলার জন্য এই লেখা নয়। 1929 সালের নির্ধারিত বয়স যুব সমাজে ফিরে আসছে।অনেকের মনে হতে পারে 30-35 বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।এই দেখা আর না দেখা চিত্র গুলো বড় গোলমেলে। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা বিচার করে আর ইউনিসেফ তার মানদণ্ডে মেয়েদের স্বাস্থের উপর আলোকপাত করে।গ্রামীণ পরিবেশে সেখানকার মানুষের বিচার বিবেচনার নিরিখে বলা যায় ছাত্রাবস্থায় এই সব এলাকায় প্রায় ষাট ভাগ ছেলে মেয়েরাই কম বয়সে বিয়ের দিকে পা বাড়ায়।বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে হত দরিদ্র বলে কেউ নেই। কিন্তু বাস্তব বলে দারিদ্রতা ও চরম অশিক্ষার কারণে মেয়েরা কম বয়সে বিয়ে করছে,কিছু মেয়ে রঙিন জীবনের নেশায় পারি দিচ্ছে দূরদেশে।2009 সালে পুরুলিয়ার 16 বছরের একটি মেয়ে নিজের বিয়ে আটকে নজির সৃষ্টি করেছিলেন এবং তদানীন্তন মহামহিম রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
গ্রাম ও শহরের পরিবেশে ঘটে যাওয়া বাল্যবিবাহের পরিপ্রেক্ষিত গুলো আলাদা হলেও পরিণাম গুলো প্রায় এক। প্রথম ও প্রধান পরিণাম বিয়ের পর অনিচ্ছা বা ইচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক মা হয়ে যাওয়া।ফলস্বরূপ মা ও বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক অবক্ষয়,সমাজে ছেলে ও মেয়ের উভয়ের স্থান নির্ধারণ হয় নিম্নস্তরে।তারা পিছিয়ে পড়ে কর্মকুশালতায়।শৈশবের পরিসমাপ্তি ঘটে।দারিদ্রতা, পরিবারে নিজের জায়গা শক্তভাবে তৈরি করতে না পারা এবং শেষে বধূ ও নারী নির্যাতন। যার ফলস্বরূপ আত্মহত্যা, হত্যা বা পাচার চক্র পা বাড়ায় সুযোগ বুঝে।
এই বাল্যবিবাহ গুলো এত সহজে কি করে ঘটে যায়?যান্ত্রিক জীবনে মুঠোফোন কিশোর কিশোরীদের এই এই পথে পা বাড়াতে সাহায্য করে।বিশেষত ডুয়ার্সের চাবাগান এলাকায় চরম দারিদ্রতা থেকে বাঁচতে, একটু ভালো থাকার লোভে বা আশায় বিয়ের পথে পা দেয়।চায় সুখী হতে আর কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে। জীবনে সঠিক দিশা খুঁজে পায় না বলে সঠিক শিক্ষা থেকে দূরে চলে যায়-বাড়িতে বাবা মায়ের মধ্যে দাম্পত্য কলহ,যৌণ জীবনের প্রতি চরম আকর্ষণ,পরিবার বা বাইরের কোনো পুরুষের করা শ্লীলতাহানি থেকে বাঁচতে (যা হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারে না)।
অকালে জীবনের কাছ থেকে অনেক না পাওয়া আর হতাশা ,সন্তানের জন্মের পর পারিবারিক দায়িত্বের বোঝা ,এসব কিছু শৈশবকে কেড়ে নেয়। কিশোর কিশোরীদের জীবন অতিদ্রুত নিতান্ত বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে বাধা পড়ে হারিয়ে ফেলে জীবনে কিছু করার চাহিদাকে।এক্ষেত্রে পরিবারগুলোর কিছু পদক্ষেপ অপরিণত বয়সে করে ফেলা ভুলকে শুধরে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।এছাড়া পঞ্চায়েত বা বাড়ির পাশের বা পাড়ার কোনো দায়িত্ববান ব্যাক্তিত্ব মাথা তুলে দাড়াতে পারেন।কিন্তু সমাজ কি বলবে এই কথা ভেবে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ এক পা এগিয়ে গিয়ে দু পা পিছিয়ে যান - প্রশাসন চাইলেও কেস রেজিস্ট্রেশন না হওয়ার দরুন তারা তাদের ভূমিকা থেকে অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত থাকেন।
আইন তো রয়েছেই তা সত্বেও অভিভাবকরা এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করেন নাবালক নাবালিকার।কারণ কোনো ক্ষেত্রে মেয়েটি হয়তো অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়।তখন সামাজিক উপায় একটাই বিয়ে !সমাজ বাকি দায়িত্ব নেবে না কিন্তু বিয়ের দায়িত্বটা সঠিক ভাবে পালন করে।
আমার অভিজ্ঞতায় বারবার বহু বাল্যবিবাহ উঠে এসেছে।স্বাস্থ্যকর্মী হবার দরুন কর্মক্ষেত্রের বাড়ি গুলোর (গ্রামীণ বা চাবাগান)দরজা আমার জন্য খোলা।কমবয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া বা পালিয়ে যাওয়া শুনে এলাকার পঞ্চায়েত,গ্রামীণ পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেই সমস্ত বাড়িতে গিয়ে অনেক অসস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তবুও 20-25টি এই ধরণের বিয়ে চাইল্ড লাইন (1098), জেলা শিশু সুরক্ষা বিভাগ এর সহায়তায় রোধ করতে পেরেছি।
কিন্তু সেই চেষ্টাও মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়েছে অভিভাবকদের অপরিণামদর্শী আচরণের জন্য।সেক্ষেত্রে তাদের মনে ভয় কাজ করেছে,ভয় ছেলে মেয়েকে হারানোর।রাতে বিয়ে বন্ধ করেও পরের দিন ছেলে মেয়ে বাইরে পালিয়ে বিয়ে করেছে।
আমাদের পূর্বসূরিদের চেষ্টা, আইন সবকিছুকে পিছনে ফেলে ছেলেমেয়েরা অতিদ্রুত এগিয়ে চলেছে।সভ্যতার সঠিক দিশা তারা জ্ঞানার্জনে নয় সংসার ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছে।এই দৃশ্য যে সর্বত্র বিরাজমান সেটা নয়, কিছু ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে বা অন্য স্থান থেকে প্রতিবাদ আসছে কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুব কম। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটি শুক্রবারকে বেঁধে দিয়েছে টিনএজ মায়েদের নিয়ে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য - এই কাজ অবশ্যই আলোর দিশা কারণ বিয়েটা করে নিলেও যাতে বাচ্চাটা কিশোরী বয়সে না আসে।আর বছরের শেষ প্রান্তে এসে হিসেব বলে সত্তর জন পঞ্জিকৃত মায়ের মধ্যে বারো জন মা এর বয়স আঠারোর নিচে।এই দৃশ্য ডুয়ার্সের গ্রামীণ বা বাগান এলাকার প্রতি বছরের।তবে আইন কি করলো,অভিভাবকরা কি করলেন,দীর্ঘদিন স্কুলে না যাওয়া ছাত্র বা ছাত্রীটির জন্য তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি করলেন ? কন্যাশ্রী, রুপশ্রী, বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও কি করলো?সর্বোপরি ছেলেমেয়ে দুটো জানতেও পারলো না তারাই একদিন কষ্টের জ্বালায় গর্জে উঠবে!সচেতনতার সভায় প্রতিনিধি হয়ে জানাবে "আমাদের মত ভুল যেনো কেউ না করে!"
হয়তো আমাদেরও হুস হবে সেদিন যেদিন পনেরো ছুঁই ছুঁই মেয়েটাকে দুপুর থেকে বা সদ্য উনিশ পার হওয়া ছেলেটাকে সকাল থেকে পাওয়া যাবে না।আমাদের সবার চোখে ভেসে উঠবে নিজের আত্মজর মুখ - সেদিন আমরা কোথায় মুখ লুকাবো সেটা আমারও জানা নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴