এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো/অমিতাভ গোস্বামী
"এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো"
অমিতাভ গোস্বামী
----------------------------------------------------
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীচরণকমলেষু
পরম শ্রদ্ধেয় গুরুদেব,
আমাকে আপনি চিনবেন না । আমি আপনার গুণমুগ্ধ অগণিত পাঠকের অতি ক্ষুদ্র ও নগণ্য একজন।আপনার চিন্তা ও চেতনার বিস্তৃত জগতের অজস্র মুনিমুক্তাই আমার দৈনন্দিন চলার পথের পাথেয়।হে মহামানব, অক্লান্ত সৃষ্টির মাধ্যমে আপনি যে মানব ধর্মের জয়গান করেছেন ,যে সংহতি চেতনার আবাহন করেছেন তা আজ বিপন্ন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মৌলবাদী শক্তি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আজ তৎপর। যে ভারতবর্ষ চিরদিন শক হুনদল পাঠান মোগলকে এক দেহে লীন করার সাধনা করে গেছে তা আজ বিঘ্নিত।এই দুর্যোগের মাঝে আপনার লেখনিই পারে আমাদের আলোর সন্ধান দিতে। আপনার গানে, কবিতায়, গল্পে ,উপন্যাসে ,নাটকে, প্রবন্ধে আপনি যে বৌদ্ধিক চর্চা করেছেন তাই আজ আলোর দিশারী।
আপনার লেখা বিভিন্ন অবিস্মরণীয় গানের গভীরে রয়েছে এক সার্বভৌম চেতনার প্রকাশ । 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা' বা 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।' এখানে দেশ' শব্দের মধ্যে এক সার্বভৌম চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। যে কোন দেশের মানুষই এই গান গাইতে পারেন।
ভারত ইতিহাসের মূলগত চেতনা যে ঐক্যবোধ তা আপনিই আমাদের বলেছেন-'ভারতীয় ঐতিহ্যের মূল প্রণোদনা ঐক্যমূলক..... ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কি, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন সে উত্তর আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই পথের অভিমুখীন করিয়ে দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে উপলব্ধি করা, বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতিীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা।'
আপনার লেখা গোরা উপন্যাসে দেখতে পাই সংহতি চেতনার উজ্জ্বলতম প্রকাশ। গোরা যতদিন নিজেকে শুধুমাত্র একজন কট্টর হিন্দু বলে ভেবে এসেছেন ততদিন ব্যর্থ হয়েছেন। নিজের জন্ম বৃত্তান্ত জানার পরে গোরা মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। আনন্দময়ীর স্বরূপ উপলব্ধি করে তার পায়ে মাথা রেখে বললেন,'তুমি আমার মা!...... তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই-শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা! তুমিই আমার ভারতবর্ষ!'
উগ্র জাতি প্রেম যে মানুষকে স্বার্থপর এবং অসহিষ্ণু করে তোলে তা আপনিই বলে গেছেন-'জাতি প্রেম নাম ধরি প্রচন্ড অন্যায়/ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।'
ইউরোপে যে উগ্র জাতি প্রেম সারা বিশ্বের আকাশ বাতাস কে কলুষিত করেছিল তার বিরুদ্ধে আপনি লিখেছিলেন,'দানবের মূঢ় অপব্যয়/গ্রন্থিতে পারে না কভু ইতিবৃত্তে শাশ্বত অধ্যায়।'
রাশিয়ার চিঠিতে আপনি লিখেছেন,'সমস্ত পৃথিবীতেই যে কোন বড় বিপদের জাল বিস্তার দেখা যাচ্ছে তার প্রেরণা হচ্ছে লোভ-সেই লোভের সঙ্গে যত ভয় যত সংশয়; সেই লোভের পিছনেই যত অস্ত্র সজ্জা, যত মিথ্যুক ও নিষ্ঠুর রাষ্ট্রনীতি।'
আমাদের দেশে আজও ধর্মের নামে হানাহানি চলেছে। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে বহুকাল পূর্বে 1910 সালের 4ঠা জুলাই কাদম্বিনী দেবিকে পত্রে আপনি লিখেছিলেন, 'আমাদের দেশে ধর্মই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে। আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেছি, স্ত্রীলোককে হত্যা করেছি, শিশুকে জলে ফেলেছি, বিধবা কে নিতান্তই অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেছি, নিরীহ পশুদের বলিদান করেছি এবং সকল প্রকার বুদ্ধি যুক্তিকে একেবারে লঙ্ঘন করে এমন সকল নিরর্থকতার সৃষ্টি করেছি যাতে মানুষকে মূর্খ করে ফেলে।' চিত্তের এই মূঢ়তা এবং তামসিকতার বিরুদ্ধে ই 'নৈবেদ্য ' কাব্যে আপনি লিখেছেন শাশ্বত মূল্যবোধের কবিতা 'চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য উচ্চ যেথা শির'.......'যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি/বিচারের স্রোত:পথ ফেলে নাই গ্রাসি/পৌরুষেরে করেনি শতধা...'
স্মরণ করি অচলায়তন নাটক সম্পর্কে অমল হোমকে লেখা চিঠির কথা,'ধর্মের নামে যে বিরাট কারাগার আমরা আমাদের চারপাশে গড়ে তুলেছি সেই বন্দিশালা থেকে আমাদের সংস্কার কে, অভ্যাসকে মুক্তি দেবার আহ্বানই অচলায়তনের আহ্বান।'
আপনি ছিলেন বিশ্ব মানবতার পূজারী। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্রতা আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অন্যের স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্র্য ধ্বংস করে কখনোই জাতীয় ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয় তা আপনি বলেছিলেন ঐক্যতত্ত্ব প্রসঙ্গে-'একাকার হওয়া এক হওয়া নয়, যারা স্বতন্ত্র তারাই এক হতে পারে। ইমপিরিয়ালিজম হচ্ছে অজগর সাপের ঐক্য নীতি, গিলে খাওয়া কেই সে এক করা বলে প্রচার করে।... মানুষ যেখানে স্বতন্ত্র সেখানে তার স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করলে তবেই মানুষ যেখানে এক সেখানে তার সত্য ঐক্য পাওয়া যায়।'
সমস্ত রকম ক্ষুদ্রতা ও নীচতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে সার্বজনীন শিক্ষার গুরুত্ব আপনি তুলে ধরেছিলেন-'এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।'
আপনি লিখেছেন,'দেশের যে ক্ষুদ্র অংশে বিদ্যা বুদ্ধি ধন মান, সেই শতকরা পাঁচ পরিমান লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধান এর চাইতেও বেশি। আমরা এক দেশে আছি অথচ আমাদের এক দেশ নয়।'
১৯৩০ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণের সময় আপনি সে দেশে শিক্ষা সংস্কৃতির আলোকে আলোকিত মুসলিম সমাজের অগ্রগতিতে বিস্মিত হয়ে নন্দলাল বসু কে লিখেছিলেন-'আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতুম না যে অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে...... ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে? দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে? মানুষকে যারা কেবলই ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনখানে আছে?'
আমরা লজ্জিত গুরুদেব। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের মধ্যে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশ অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত।আমরা এখনো 'সভ্যতার সংকট' এবং 'মানুষের ধর্ম' প্রবন্ধের মর্মকথা উপলব্ধি করতে অক্ষম। আমরা ভুলে গেছি 'ধর্মের অধিকার' শীর্ষক আপনার লেখা,'ধর্মের দোহাই দিয়ে কোন জাতি যদি মানুষকে পৃথক করতে থাকে একশ্রেণীর অভিমানকে আরেক শ্রেণীর উপর চাপিয়ে দেয় এবং মানুষের চরমতম আশা ও পরমতম অধিকার কে সংকুচিত ও শত খণ্ড করে তবে সে জাতিকে হীনতার অপমান থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোন সভা সমিতি কংগ্রেস কনফারেন্স এমন কোন রাষ্ট্রনৈতিক ইন্দ্রজাল নেই ।এই বিকারেই গ্রীস ও রোমের পতন হয়েছে এবং আমাদের দুর্গতির কারণ ও রয়েছে তথাকথিত ধর্মাচরণের মধ্যে।'
তবু আপনি বলে গেছেন- 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।'তাই আমরাও আশাবাদী। আপনার সারা জীবনের সাধনা বিফলে যাবে না। সমস্ত রকম অমানবিকতার অবসান হবে। প্রিয় স্বদেশ ভূমি অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে।'মহামানবের' আগমনে আমরা প্রত্যক্ষ করব-'আজি অমারাত্রীর দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।' সেই নতুন দিনের পদধ্বনি ধ্বনিত হোক এই ২৫শে বৈশাখে। আমাদের সমস্বরে উচ্চারিত হোক - 'ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো / এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।'
শ্রদ্ধাবনত,
আপনার একান্ত অনুগত
অমিতাভ গোস্বামী
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴