ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য -এর আলোচনায় কৌশিক জোয়ারদার-এর বই 'অখ্যাতনামা'
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য -এর আলোচনায়
কৌশিক জোয়ারদার-এর বই 'অখ্যাতনামা'
“আমি তো সময়েরও পিতা। কর্মে ও ভাবনায় আমি আমার মতো করে সময়ের জন্ম দিই।“
কবি, দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ও বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক শ্রীকৌশিক জোয়ারদারের চণ্ডাল বুকস থেকে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ অখ্যাতনামার ভূমিকার এই ক'টি বাক্যেই বোধহয় ধরা আছে গোটা কাহিনীটির বীজ। এ কাহিনীর প্রারম্ভে লেখক যথার্থই বলেছেন, সব মানুষের জীবনেই গল্প থাকে, শুধু সবাই তা লিখে যেতে পারে না। বইখানি পড়া শেষ হলে পাঠকেরও বোধহয় এমনটাই মনে হতে বাধ্য। যেমন করে আদুরে মায়ায় জড়িয়ে সময়ের গর্ভে ঘুমিয়ে থাকা শৈশব, কৈশোর ও যৌবনবেলাকে আবারও অক্ষরে অক্ষরে এ বইটিতে জাগিয়ে তুলেছেন লেখক, পাতার পর পাতা উল্টোতে উল্টোতে তার সাথে এক আশ্চর্য সময় পরিক্রমা ঘটে যেন বইটির পাঠকেরও, অন্য এক জীবনের গল্প পড়তে পড়তে নিজের ফেলে আসা টুকরো টুকরো অতীতকেও যেন ছুঁয়ে ফেলা যায় অনায়াসে, লেখকের জীবনকথার সাথে সাথে আবারও এক সমুদ্র জীবন বাঁচে বইটির পাঠকও, আর, সেখানেই বোধহয় এ বইটির প্রকৃত সার্থকতা।
একশো কুড়ি পাতার সুসম্পাদিত এই বইটিতে অধ্যায় সংখ্যা মোট সতেরো। মূলত লেখকের শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে কাজের জগতে প্রবেশের সময়কালটিকে পর্বে পর্বে ধরা আছে এ বইয়ে। হয়তো পরবর্তীতে এর পরের জীবনকথাও কখনও কোথাও উঠে আসবে কারণ অখ্যাতনামা শেষ হচ্ছে প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘোষণার মাধ্যমে। অখ্যাতনামা বইটির আসল নায়ক জীবন। জীবনের জোয়ার ভাঁটার টানে ভাসতে ভাসতে এ জীবনকথার গল্প এগোয় তির তির করে। শৈশবের মনকেমন করা যৌথ পরিবারের আলোমাখা সোনার দিন, দক্ষিণবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত চন্দননগরের আনন্দমুখর ছেলেবেলা, মালদায় রামকৃষ্ণ পল্লীর পিতৃপুরুষের আদি বাড়ি, গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজো, মালদা জেলা স্কুলের স্মৃতি, আত্মীয় অনাত্মীয় বন্ধু প্রিয়জন বিজড়িত কত ছোট বড় ঘটনা যা একটু একটু করে গড়ে তোলে লেখকের জীবনকে, পরবর্তীতে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেল জীবন ও বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে অযাচিতভাবে অভাবিতভাবে পড়ে পাওয়া কত নিঃশর্ত নিখাদ ভালবাসা আর বন্ধুত্বের আখ্যান! আসলে অখ্যাতনামার এই ছোট ছোট অজস্র ঘটনার স্রোত পেরোতে পেরোতে মনে হয় এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং সময়বিশেষে কখনও বা নেহাৎই তুচ্ছ এই ঘটনাগুলো এবং তার সাথে জুড়ে থাকা মানুষগুলোই যেন শেষ অবধি লেখকের চরিত্র গঠন করে এবং এই ঢেউয়ের পর ঢেউ ভেঙে অবিরল বহমান স্রোত যা তাঁর শেকড় থেকে শুরু হয়, ফল্গুনদীর মতোই তাঁর অস্তিত্বের গহীনে প্রবাহিত হয় জীবনভর। সময়ের সাথে চলতে চলতে কিছু মানুষ রয়ে যায় জীবনে, কেউ বা যায় হারিয়ে, কিন্তু যে সময়টাকে নিজেদের আনন্দ শোক দুঃখ অবসাদ অবহেলা দিয়ে মূর্ত করে তুলেছিল তারা একদিন, সে স্মৃতিটুকু জীবনে রয়ে যায় অমলিন, নশ্বর হয়েই। এই সময় আর সেই সময়কে ধরে রাখা বহুবিচিত্র এবং বহুধাব্যাপ্ত স্মৃতির এক অসম্ভব সৎ, নির্মোহ অথচ একদম নিজস্ব রসবোধে জারিত আখ্যানই অখ্যাতনামা। আর, এই বিশুদ্ধ রসবোধের কৌতুকঘন বিভিন্ন উদাহরণগুলি কিন্তু ছড়িয়ে আছে গোটা বই জুড়েই। এর মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্টুমির উদাহরণস্বরূপ যেমন আছে কোনও এক সিনিয়র ছাত্র দাদার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও একটি অপ্রচলিত কবিতা একটু ‘ঠিকঠাক’ করিয়ে নেওয়ার মতো দারুণ মজার ঘটনা, তেমনই আবার কলকাতার রাস্তায় থিয়েটার রোডের নাম ভুলে গিয়ে ‘ড্রামা রোড’ খুঁজে খুঁজে হয়রান হওয়ার আজব স্মৃতিও। এই ছোট্ট ছোট্ট অসংখ্য রসময় ঘটনার উপস্থিতি বইটিকে আরও সজীব করেছে।
এখন কথা হচ্ছে এই আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সহজ বিষয় নয়, কারণ প্রথমত তাতে নিজের প্রতি সম্পূর্ণ সৎ ও নিরপেক্ষ থাকার একটা নিদারুণ দায় থেকে যায়। ভুল ভ্রান্তি দুর্বলতা অসাফল্য ব্যর্থতা আমাদের সবার জীবনেই থাকে। সেটা যতক্ষণ ব্যক্তিগত থাকে একরকম, কিন্তু সেইসব দাগওলা অস্বস্তিকর স্মৃতিগুলোকে সবার সামনে নির্ভয়ে বের করে আনতে গেলে যে এক ভীষণরকম আত্মবিশ্বাস, আত্ম নির্ভরতা, মানসিক দৃঢ়তা এবং চারিত্রিক স্বচ্ছতার প্রয়োজন হয় তা আজকের দিনে কেন, সব কালেই ভীষণ বিরল। সেই জায়গা থেকে এই বই কিন্তু দারুণ সফল, কারণ নিজের এবং নিজের শিকড়ের প্রতি এক অদ্ভুত নির্দয় অথচ মমতাময় সততা এই বইয়ে বজায় থেকেছে প্রথম থেকে একেবারে শেষ পৃষ্ঠাটি অবধি। এবং, লেখা ছাড়িয়েও লেখাটির প্রতি এই আশ্চর্য সত্যনিষ্ঠাই সবার ওপরে বইটির প্রতি পাঠকের নিঃশর্ত শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। আর, এর সাথে আছে ইতোমধ্যেই এতখানি বিস্তৃত একটি জীবন বেঁচেও জীবন সম্বন্ধে এক অদ্ভুত বিনয়ী নম্রতা যা লেখক তথা এ জীবনের অধিকারী মানুষ কৌশিক সম্বন্ধেও সবিশেষ শ্রদ্ধা আদায় করতে বাধ্য করে।
অখ্যাতনামা বইটি ভীষণরকম ব্যক্তিগত হয়েও অনেকখানি ব্যাপ্তি ধরে, বিশেষ করে যেখানে বইটির শেষদিকের যে দু তিনটি অধ্যায়ে লেখকের অধ্যাপনা ক্ষেত্রে যোগদানের আগের কর্মজীবন নিয়ে বেশ বিস্তৃত আলোচনা আছে। সাংবাদিকতা ও তার সাথে যুক্ত কিছু গবেষণামূলক কাজের জন্য সেসময় দেশের স্বাধীনতার সময়কার কাগজপত্র ও সংবাদপত্র ঘাঁটতে গিয়ে উল্লিখিত অশান্ত উত্তাল রক্তাক্ত ওই অন্ধকার সময়ের নানা খবর, সূত্র ও তারিখসহ উল্লিখিত যুদ্ধকালীন, দাঙ্গাবিধ্বস্ত ও দেশভাগ সংক্রান্ত পরিস্থিতির ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাসমূহ অনুসন্ধিৎসু পাঠককে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীকে যে প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করা হত একটা দীর্ঘ সময় অবধি এ তথ্য সত্যিই চমকপ্রদ। আবার আজকের মিড ডে মিল ব্যবস্থার বিজ্ঞপ্তি যে সরকারি তরফে প্রস্তাবিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালেই তাও বেশ কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য। এ বইয়ের আরও এক সম্পদ এর শেষে সংযুক্ত প্রাসঙ্গিক নানা ছবি ও চিঠির দুর্লভ সম্ভার। এছাড়া এখানেই আছে তাঁরই মায়ের তরফের পরিবারের এক আত্মীয়ার ঊনিশশো ঊনচল্লিশ সালে নিজের হাতে লেখা বেশ জটিল এক উইল বা ইচ্ছাপত্রেরও প্রতিলিপি যা সেসময়ের হিসেবে যথেষ্টই বিরল এক সংযোজন।
‘আজ যদি কোনো মন্ত্রবলে আমার শৈশব কেড়ে নেয় কেউ, আমার সমস্ত কবিতা থেকে খসে পড়বে শব্দ, গল্প থেকে বাক্য। গম্ভীর প্রবন্ধ হারিয়ে ফেলবে সমস্ত যৌক্তিকতা। আমার প্রলম্বিত শৈশব আসলে নিজেকেই লিখে চলেছে। পিছন ফিরে আমি আমার মায়ের দুঃখকে প্রণাম করি, পিতার দুর্বোধ্য অবহেলাকে প্রণাম করি, মাতামহ তোমার ধ্বংসস্তুপে প্রণাম রাখি, দিদার গোপন চিঠি, ঠাকুমার দীর্ঘ বৈধব্যকে ধারণ করে আছে যে ধর্ম, অফিস ফেরৎ মধ্যবিত্ত শরীরের ঘাম, হলুদ আলো ও মাসের শেষ, যৌথ পরিবারের অন্ধকার বারান্দার নিষিদ্ধ আলো, জীবন জুড়ে বন্ধুদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত এবং সামান্য কিছু খুচরো পয়সা, তোমাদের সকলকে প্রণাম করি। অর্জন বলতে আমার তো এই, আর কিছু অক্ষর।‘ অখ্যাতনামার শেষের এই কটি কথাতেই বোধহয় আসলে এ বইয়ের মূল সুরটি ধরা পড়েছে। এক আশ্চর্য কৌতুহলী অনুসন্ধিৎসু নির্মল শিশুমনই এই বইটির চালিকাশক্তি। তাই বোধহয় এ জীবন আলেখ্য এত অনায়াসে ছুঁতে পারে যেকোনও পাঠককেই, কারণ জীবনস্রোতের ঠেলায় যত দূরেই ভেসে আসি না কেন, সেই ছোট্ট শিশুটা তো আজও ঘুমিয়ে আছে আমাদের সকলের অন্তরেই, যার অবাক বিস্ময়ভরা চোখ আজও ফিরে দেখতে চায় তার পেছনের ফেলে আসা, প্রাণপণে ছুঁতে চাওয়া অথচ ছুঁতে না পারার মধ্যেকার জাদু সময়টাকে। সেই আরামটুকু, চাওয়া পাওয়ার মাঝের এই দুর্লঙ্ঘ ব্যবধানটুকু কিছু সময়ের জন্য মেটানোর আরেক নামই বোধহয় অখ্যাতনামা। বইটি ভীষণরকম পাঠকপ্রিয় হোক, এটুকুই একজন পাঠক হিসেবে এই বইয়ের জন্য আমার একমাত্র চাওয়া। বইটি যথার্থই কালজয়ী হোক।
বই : অখ্যাতনামা
লেখক : কৌশিক জোয়ারদার
প্রকাশক : চণ্ডাল বুকস
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴