সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
14-July,2024 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 338

উত্তরের কুনকি হাতিদের সুখ দুঃখের কথকতা/গৌতম চক্রবর্তী

উত্তরের কুনকি হাতিদের সুখ দুঃখের কথকতা
গৌতম চক্রবর্তী

তখন আমি ডুয়ার্সের একটি তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকা “এখন ডুয়ার্স” এ লেখালেখি করি এবং সেই সূত্রে ঘুরে বেড়াই ডুয়ার্সের জলা জঙ্গল, বন, চা বাগান, জনপদের অন্দরে-কন্দরে। সেবার বাগিচা সফরে রাত্রিযাপন করছিলাম লাটাগুড়িতে। পরদিন যাবার কথা মেটেলি সার্কিটের বাগিচা সফরে। রাত্রেই রিসর্টে খবর পেলাম ধূপঝোরার দুই কুনকি হাতি পাড়ি দিচ্ছে ‘প্রথম সূর্যের দেশ’ জাপানে, দীনবন্ধুর হাত ধরে। কৌতূহল হল। ছিলাম তাপসদার ধূপঝোরা সাউথ পার্কে। এক্সক্লুসিভ স্টোরি হবে ভেবে তাপসদাকে অনুরোধ করি বনদপ্তরের এই ইভেন্টটা প্রত্যক্ষ করে এটা নিয়ে স্টোরি করতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে ফোন এবং তাপসদার বদান্যতায় অনুমতি। ধূপঝোরা যখন পৌছলাম তখন হিমেল পরশ গায়ে মেখে, ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া ডুয়ার্সের ধূপঝোড়া গ্রাম সহ সমস্ত এলাকাটাই মধ্য শীতের আয়েশি বিলাসিতায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু বিট অফিসের আঙিনায় তখন ছিল চরম ব্যস্ততা। কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল বনকর্মীদের। রাহুল আর দেবী রওনা হবে। ধূপঝোরার দুই কুনকি হাতি। রাহুল-দেবীর প্রথম বিদেশ যাত্রা, আবার শেষ যাত্রাও বটে। দীনবন্ধু ওদের নতুন খেলাঘরে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসবে ধূপঝোড়ার শ্যামলিমায়। দীনবন্ধু বর্মন পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগের প্রথম শ্রেণির মাহুত, গজরাজরা যার কথায় ওঠে-বসে, দর্শকের মন মাতায়, ডুয়ার্স রানীর আকর্ষণ বাড়ায়, উপেক্ষিত ডুয়ার্সকে অর্থবহ করে তোলে বঙ্গের মানচিত্রে। দীনবন্ধুর আদি বাড়ি মাথাভাঙায়। বাবা প্রয়াত দীনেশ বর্মনও বন বিভাগের হস্তিপালক ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে বাবার প্রশ্রয়েই তার হস্তীপ্রেম। হাতির প্রতি তার ভালোবাসার শুরু। তারপর হাতিদের শুঁড় ধরেই বেড়ে ওঠা। দারিদ্রের জাঁতাকলে পড়াশুনার পাট চুকেছিল প্রাথমিকের গন্ডিতেই। গোঁফের রেখা দেখা দেবার শুরুতেই আঠাশ বছর আগে মাহুতের জীবিকা চয়ন। কোনও অজানা ক্ষণে জীবনটাও সম্পৃক্ত হয়ে যায় জীবিকার সঙ্গে। সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপ পায়। 

বড়ই আশ্চর্য ডুয়ার্সের অরণ্যের এই গজরাজদের জীবনগাথা। বন্যপ্রাণ নিয়ে কাজ করা আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম মানুষের ছোঁয়া পেলে দলে শাবককে নেয় না হস্তীকুল‌। বৈকুন্ঠপুরের এক বনকর্মীর কাছ থেকে শুনেছিলাম এই গল্প। রাতে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে বৈকুন্ঠপুর জঙ্গল লাগোয়া সেবক সেনা ছাউনির পরিত্যক্ত কুয়োতে পড়ে গিয়েছিল একটি হাতির বাচ্চা। সেনাবাহিনীর তরফে খবর দেওয়া হয় বৈকুন্ঠপুর বনবিভাগের কর্তাদের। রাতেই মহানন্দা বন্যপ্রাণ বিভাগের এলিফ্যান্ট স্কোয়াডের একটি উদ্ধারকারী দল এবং সেনা জওয়ানেরা এসে উদ্ধারে হাত লাগায়। এরপর হাতির বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়। একটু ধাতস্থ করে বাচ্চাটিকে জল খাওয়ানোর চেষ্টা করেন জওয়ানেরা। ফেরত পাঠানোর সময় নজরে আসে মাদি হাতিটির অদ্ভূত আচরণ। একাধিকবার বাচ্চাটিকে মায়ের সঙ্গে ছেড়ে রাখা হলেও সেটিকে সে সঙ্গে নিচ্ছিল না। বাচ্চাকে ছেড়েই জঙ্গলের দিকে পা বাড়ায় মা হাতি। উদ্ধারের সময় যেহেতু লেগে গিয়েছিল মানুষের ছোঁয়া, তাই দেড় বছরের বাচ্চাকে ফেলে রেখে জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল মা হাতি। তখন বাচ্চাটিকে গরুমারা উদ্ধার কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। অনেক সময় বড় হাতির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় মানুষের ছোঁয়া পেলে তারা বাচ্চাকে আর ফেরত নিয়ে যেতে চায় না। তাই উদ্ধারের সময় মানুষের ছোঁয়া যতটা সম্ভব এড়িয়ে কাজ করতে চেষ্টা করে বনদপ্তর। তবে অল্প হলেও তো মানুষের ছোঁয়া লেগে যায়। তা একেবারেই এড়িয়ে কাজ করা সম্ভবপর হয় না। সেক্ষেত্রে এই ধরনের পরিত্যক্ত হাতির সন্তানদের নিয়ে চলে আসা হয় গরুমারা অথবা জলদাপাড়ার কুনকি হাতিদের ডেরাতে। একটু বড় হলেই শুরু হয় এদের ট্রেনিং। ঠিক এই ধরনের একটি হাতির বাচ্চা গিয়েছিল বেঙ্গল সাফারিতে। 

যেকোনো বাচ্চা হাতির মা মারা না গেলে সাধারণত তারা দলছুট হয় না। কিন্তু ব্যাংডুবি এলাকা থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় অনেকখানি এলাকা জুড়ে একটা বাচ্চা হাতি ঘোরাঘুরি করছে। বনকর্মীদের নজরে এলে তখন থেকেই বাচ্চা হাতিটিকে তারা নজর রাখতে শুরু করে। লক্ষ্য করে দেখা যায় নাওয়া-খাওয়া ভুলে উদভ্রান্তের মতো ওই এলাকার জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাচ্চা হাতিটি। তার কিছুদিন পরেই এলাকা থেকে একটি পূর্ণবয়স্ক হাতির দেহ উদ্ধার করে বনকর্মীরা। একাংশের সন্দেহ হয় ব্যাংডুবি থেকে যে পূর্ণবয়স্ক হাতির দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল সেটির বাচ্চা হতে পারে এই শিশু হাতিটি। বাচ্চাটিকে স্বাভাবিক রাখতে বেঙ্গল সাফারি পার্কে নিয়ে আসা হয়। আরো দুই কুনকি হাতি লক্ষী এবং উর্মিলার সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে যাতে দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় এবং তাকে খাবার খেতে দেওয়া হয়। উদ্ধারের সময়তে টানা হ্যাঁচড়াতে একটু দূর্বল হয়েছিল বাচ্চাটি। পরবর্তীকালে সে বেঙ্গল সাফারিতে দিব্যি মানিয়ে নেয় এবং থাকতে শুরু করে। এখন সে রীতিমত নামকরা কুনকি। জেনেছিলাম হস্তিশাবককে বড় করে তুলতে কমপক্ষে তিন বছর মায়ের দুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মা হারা হাতির বাচ্চারা মায়ের দুধ পাবে কেমন করে? জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের হলং সেন্ট্রাল পিলখানার কুনকি হাতি চম্পাকলি ছিল অনাথ হস্তিশাবকদের মা। চম্পাকলির মাহুত ছিল রবি বিশ্বকর্মা। জানিনা এখনও আছে কিনা। সেবার হলং বনবাংলোতে রবির সঙ্গে পিলখানাতে যখন গল্প করছিলাম তখন দেখেছিলাম চম্পাকলিকে। পিলখানার ছবি তুলতে নিষেধ করেছিল রবি। জেনেছিলাম এক অদ্ভূত মাতৃস্নেহের গল্প। পর্যটন এবং বন সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করার জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে কর্ণাটক থেকে আটটি হাতি আনা হয়েছিল জলদাপাড়াতে যেগুলির মধ্যে একটি হাতির নাম ছিল মেরি। সে ছিল অন্তঃসত্ত্বা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মেরি একটি মেয়ে শাবকের জন্ম দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর মেরি মারা যাওয়ার ফলে শাবকটিকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে বনদপ্তর।

এর আগে অনাথ হস্তি শাবকদের দুধ খাইয়ে হস্তীশাবকদের প্রাণ বাঁচানোতে রেকর্ড করেছিল চম্পাকলি। ইতিমধ্যে চম্পাকলিও একটি মেয়ে শাবকের জন্ম দেয়। যেহেতু চম্পাকলি এর আগে একটি অনাথ শাবককে দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিল সেই জন্য বনদপ্তর নিশ্চিত ছিল এই শাবকটির ক্ষেত্রেও অন্যথা হবে না। কিন্তু প্রথম দুবার চম্পাকলি ওই শাবকটিকে কাছে আসতে না দিতে চাইলে বনকর্তাদের উদ্বেগ বেড়ে যায়। চম্পাকলির ব্যবহারে তারা অবাক হয়ে যায়। তখন চম্পাকলির মাহুত রবি বিশ্বকর্মা বনকর্তাদের আশ্বস্ত করেন। বারে বারে চেষ্টা চালানো হলে তৃতীয় বারের চেষ্টায় সমস্যার সমাধান হয়। চম্পাকলি নিজের শাবকের পাশাপাশি ওই অনাথ শাবককেও কাছে টেনে নিলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বনদপ্তর। রবির কাছ থেকে শুনেছিলাম চম্পাকলি এর আগে ছটা অনাথ শাবককে নিজের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে। মেরির শাবকটিও চম্পাকলির স্নেহ এবং শাসনে তখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। চম্পাকলির শাবকের সঙ্গে মেরির শাবকটি সারাদিন ধরে নাকি খুনসুটি করত। পরবর্তীকালে রবি বিশ্বকর্মার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম শাবক দুটি সুস্থ রয়েছে। চম্পাকলি দুই সন্তানকে কাছে টেনে নিয়মিত নিজের দুধ দিয়ে চলেছে। আসলে হাতিদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য ব্যাতিক্রমী। বিশিষ্ট হস্তিবিজ্ঞানী পার্বতী বড়ুয়ার লেখা থেকে পড়েছিলাম হাতিদের চরিত্রে স্নেহপরায়ণ ঘটনা দেখা যায় যেটাকে বিরল বলা যায় না। জলদাপাড়াতে ইতিপূর্বে মধুমালা নামে একটি মা হাতিও অনাথ শাবকদের নিজের দুধ দিয়েছে। তবে এতগুলি অনাথ সন্তানকে অন্য কোনো মা হাতি নিজের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে কিনা সেটা বনদপ্তরেরই অনেকের জানা ছিল না। 

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গলে হাতিদের গতিবিধি ইদানীংকালে খুব বিপদজনক হয়ে গেছে। বহুক্ষেত্রে দাঁতাল হাতিরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম অথবা এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে, ভাঙচুর করছে এবং অনেক জায়গায় প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। এরকম ঘটনা সাম্প্রতিক নয়, অতীতেও ঘটেছিল। জঙ্গলের হাতিদের গতিবিধির ওপর কড়া নজরদারির দায়িত্ব বনদপ্তরের। প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে কমানো যায় সেই বিষয়ে নজর দেওয়ার দায়িত্ব বনদপ্তরের। তাই হাতির দলের নেতা অর্থাৎ বনদপ্তরের ভাষায় যাদেরকে হার্ড বলে তাদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে বনদপ্তরকে। তবেই একমাত্র এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। জলদাপাড়া থেকে বক্সা পর্যন্ত এই এলাকায় একাধিক হাতির দল রয়েছে। এইরকমই একটা দুটো হাতির দলের ওপর নজরদারি করতে সুন্দরী এক হাতিকে রেডিও কলার পরিয়ে জঙ্গলে ছাড়লো বনদপ্তর। হাতিটির নাম সুকন্যা। বয়স ৩০ বছর। কারণ এই হাতিটির দিকে একাধিক পুরুষ হাতি আকৃষ্ট হত মাঝেমাঝেই। জলদাপাড়া সহ মাদারিহাট, কালচিনি, বীরপাড়া এলাকায় প্রায় শ’দুয়েক হাতি একাধিক দলে ঘুরে বেড়ায় বিশেষ করে ধান পাকার সময়। বনের বখাটে দাঁতালদের বশে রাখতে সুন্দরী হস্তিনীদের কাজে লাগাতে বনদপ্তর রেডিও কলার পড়ানোর মাধ্যমে জলদাপাড়া সহ সংলগ্ন বনাঞ্চলে হাতিদের দলের ওপর নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বনদপ্তরের এই ধারণা কাজ করেছিল যে জঙ্গলে ওই হাতিটির দিকে যাবে অনেক পুরুষ হাতি অথবা দাঁতাল। এই অবস্থায় হাতির দলের বাকিরাও সেদিকেই ছুটবে। তখন জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে মহিলা হাতিটি কোথায় যাচ্ছে এবং কোন জঙ্গলে রাতে থাকছে অথবা কোথায় দিনের বেলায় থাকছে সেই বিষয়ে চব্বিশ ঘন্টা নজরদারি করা সম্ভবপর হবে।

এর ফলে অনায়াসেই সুন্দরী সুকন্যাকে কেন্দ্র করে বাকি দাঁতাল এবং হাতির দলকে নজরদারিতে রাখা সম্ভবপর হয়েছিল। জলদাপাড়া জঙ্গলের শিসামারাতে বনদপ্তরের এক বিশেষ দল ঘুমপাড়ানি ইনজেকশন দিয়ে বশ করে সুকন্যাকে রেডিও কলার পরিয়ে বিকেলের দিকে জঙ্গলের দিকে ছেড়ে দিয়েছিল। বনদপ্তরের এই পরিকল্পনা কিন্তু সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল। তবে সুন্দরী হাতিকে রেডিও কলার পড়ানোর সিদ্ধান্ত কিন্তু প্রথমবার নেওয়া হয়নি। এর আগে মহানন্দা এবং গরুমারাতে বাছাই করা হাতিকে রেডিও কলার পড়ানো হয়েছিল শুধুমাত্র হাতিদের গতিবিধির ওপর নজরদারির কথা মাথায় রেখে। জলদাপাড়াতে এই অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুকন্যাকে কাজে লাগিয়ে তার সহযোগিতায় হাতিদের গতিবিধিতে নজর রাখার পরিকল্পনা কিন্তু ব্যাপকভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়। জলদাপাড়াতেই কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছিল প্রিয়দর্শিনী আর গৌরীর সঙ্গে। জলদাপাড়াতে যে সকল কুনকি হাতিগুলো রয়েছে প্রিয়দর্শিনী তাদের একজন। প্রিয়দর্শিনীর তৃতীয় সন্তান গৌরী। এসেই দেখেছিলাম গৌরীকে। গৌরীকে যখন দেখেছিলাম তখন ওর বয়েস মাত্র দেড়বছর। এই দেড়টা বছর মায়ের কোলেই কেটেছিল ওর। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই খেলাধূলা করে সময় কাটানোর দিন শেষ হয়ে গেল একসময় তার। আর সেই কারণেই যেহেতু সে মেয়ে তাই নিয়ম মেনে নামকরণ হয় গৌরী। বনদপ্তর এর নিয়ম অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্তান মায়ের দুধের উপর নির্ভরশীল থাকতে পারে। যেদিন সে দুধ ছাড়বে সেই দিন তার নতুন জীবন শুরু হবে, তার নামকরণ হবে, পাঠশালায় ভর্তি হতে হবে। কুনকি হবার পাঠশালা। এর আগেও তার অপর দুই সন্তান পৃথ্বীরাজ এবং দর্শন নিয়ম মেনে বন এবং বন্যপ্রাণী রক্ষার কাজে নিযুক্ত থেকে কুনকি হিসাবে বনদপ্তর এর কর্মী হয়েছিল। গৌরীকেও সেই চাকরি করতে হবে ভবিষ্যতে। তারই প্রস্তুতি হিসাবে গৌরীকে সেদিন পাঠানো হচ্ছিল মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের পাঠশালা হলং সেন্ট্রাল পিলখানায়।

প্রিয়দর্শিনীর মাহুত রতিলাল ওঁরাও এর কাছ থেকে শুনেছিলাম সেই বিচ্ছেদ পর্বে জলদাপাড়ার দুই কুনকি মীনাক্ষী এবং মধুমালাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিয়দর্শিনীর কাছে। তখনো মা এবং মেয়ে একসঙ্গেই ছিল। কুনকি দুটি কাছে যাওয়ার পর মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় গৌরীকে। তারপর টেনে হিচঁড়ে মায়ের থেকে আলাদা করা হয় গৌরীকে। মা-মেয়ের চিৎকারে বনভূমি বিদীর্ণ হয়ে যায়। আধঘণ্টার মধ্যেই গৌরীকে নিয়ে সবার চোখের আড়াল হয়ে যায় দুই কুনকি। সেখানে উপস্থিত বনকর্তা, বনকর্মী এবং মাহুত সকলের চোখেই তখন ছিল জল। প্রিয়দর্শিনীর মাহুত রতিলাল ওঁরাও এর খুব কষ্ট হচ্ছিল ওকে ছাড়তে। রতিলালের কাছ থেকে জেনেছিলাম ওর মাকে সামলাতে কিছুদিন একটু বেগ পেতে হবে। কিন্তু বনদপ্তরের নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। কারণ পড়াশুনা অর্থাৎ ভবিষ্যতে কুনকি হওয়ার পাঠ নেওয়া শুরু না করলে মুশকিল। প্রিয়দর্শিনীর আগের দুই সন্তান পৃথ্বীরাজ এবং দর্শন কুনকি হিসাবে বন এবং বন্যপ্রাণী রক্ষার কাজে নিযুক্ত ছিল। সেদিন প্রিয়দর্শিনীর তৃতীয় সন্তান গৌরীকে নামকরণের পর পাঠানো হলো পাঠশালায়।  গৌরীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল জলদাপাড়ার হলং রেঞ্জে। এই প্রশিক্ষণ পর্ব চলবে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত। তখন গৌরীর চাকরি হবে কুনকি হিসাবে জঙ্গল পাহারা দেওয়া। ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করার পর অবসর। তখন অবশ্য মিলবে পেনশন। হ্যা, অবাক হবেন না। হাতিরাও সরকারি কর্মচারি। চাকরি করে। রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন পান সরকারি কর্মচারীরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবনের ওপরই যবনিকা পড়ে যায়। গজরাজ যদি পেনশন পান শুনে অবাক হবেন না কিন্তু। গরুমারার তৎকালীন বিট অফিসারের সৌজন্যে দেখেছিলাম মেঘলালকে। মানুষের যেমন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সের সীমারেখা বাধা থাকে, তেমনি গরুমারার কুনকি হাতিদেরও কাজের বয়স বাঁধা রয়েছে মানুষের মতো। গরুমারার কুনকি হাতিরাও ৬০ বছর বয়সের পর কাজ থেকে অবসর নিয়ে নেয়। তখন তাদের নিজের কাজটুকু ছাড়া আর কোনকিছুই করতে হয় না। 

মেঘলাল এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল মেঘলাল এর বয়স তখন ছিল ৬২ বছর। সরকারি নিয়ম অনুসারে বছর দুয়েক আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছিল সে। তবে সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছেদ হয়নি। ২০১৪ সালে কর্মজীবন থেকে অবসরগ্রহণ করলেও তার নিজের খাবার নিজেকেই সংগ্রহ করতে হত। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন জঙ্গলে যেতে হত বর্ষীয়ান এই কুনকিকে। নিজের খাবার নিজে সংগ্রহ করলেও মেঘলাল এর সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিল বনদপ্তর। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর দুইবছর কেটে গেলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খাবার যোগাড় করা, মূর্তি নদীতে স্নান করা থেকে শুরু করে দিনের অধিকাংশ সময় সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছে গরুমারার সবচেয়ে বয়স্ক কুনকি মেঘলাল। গরুমারার জঙ্গলের ভেতরে মেদলার পিলখানায় অবসর জীবন কাটিয়েছে সে। নয় এর দশকে গরুমারার জঙ্গলে এসেছিল মেঘলাল। মূলত বেআইনি পাচার আটকাতে গিয়ে মেঘলালকে পাওয়া গিয়েছিল। উত্তর পূর্ব ভারত থেকে গাড়িতে করে এই পুরুষ হাতিটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার বৈধ কাগজ না থাকায় হাতিটিকে গরুমারার জঙ্গলে আটকে দেওয়া হয়। তারপর সেখানে কিছুদিন রাখার পর তাকে কুনকি করে তোলার তালিম দেওয়া শুরু হয়। মাত্র এক বছরের মধ্যেই তালিম শেষ করে কুনকি হয়ে ওঠে মেঘলাল। তারপর থেকেই দীর্ঘদিন গরুমারার অভিজ্ঞ কুনকির দায়িত্ব পালন করে সে। পিঠে পর্যটককে নিয়ে জঙ্গল ঘোরানোর কাজ থেকে শুরু করে বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায় মানুষকে উদ্ধারের কাজ অথবা লোকালয়ে কোন বন্যপ্রাণী বেড়িয়ে পড়লে তাকে বাগে আনা সমস্ত ক্ষেত্রেই ডাক পড়তো মেঘলালের। অবসর নিলেও মেঘলাল অনেকদিন অতিথি ছিল বন্যপ্রাণ বিভাগের। ২০১৪ সালে  কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খাবার যোগাড় করা, মূর্তি নদীতে স্নান করা থেকে শুরু করে দিনের অধিকাংশ সময় সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছিল গরুমারার সবচেয়ে বয়স্ক কুনকি মেঘলাল। গরুমারার জঙ্গলের ভেতরে মেদলার পিলখানায় অবসর জীবন কাটিয়েছে মেঘলাল। জানিনা আজও আছে কিনা।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri