সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
09-April,2023 - Sunday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 345

উত্তরের অরণ্যে গন্ডারকুলের গপ্পোসপ্পো /গৌতম চক্রবর্তী

উত্তরের অরণ্যে গন্ডারকুলের গপ্পোসপ্পো 
গৌতম চক্রবর্তী
-------------------------------------------------

পশুপাখীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে গেলে তাদেরকে নিয়ে রীতিমত চর্চা করা প্রয়োজন। জঙ্গলমহলের পশুদেরও আছে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, হাসি, গান, মান অভিমান। এসব অনুভব করতে গেলে জঙ্গলমহলে ঘোরাফেরা করতে হবে। জানতে হবে বুনোদের জীবনযাপনের বিভিন্ন কাহিনী। বিভিন্ন সময়ে লেখালেখি এবং ভ্রমণের কারণে যতবার গরুমারা এবং জলদাপাড়াতে এসেছি ততবার এখানকার গাইড, বনকর্মী, জিপসি ড্রাইভার, মাহুত, বিট অফিসারদের কাছ থেকে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছি লেখালেখির স্বার্থে। জঙ্গলমহলের গল্পই একদম অন্যরকম। মানুষের পাশাপাশি পশুদেরও যে সুখ, দুঃখ, রাগ, অভিমান, প্রেম ভালোবাসা, অনুরাগ, বীতরাগ আছে সেটা জঙ্গলমহলে না ঘোরাফেরা করলে বোঝা যায় না। লেখালেখির সূত্রে উত্তরের জঙ্গলের বিভিন্ন ফরেস্ট বিটে বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত বনকর্মীদের কাছ থেকে জেনেছিলাম কালু, ঘাড়মোটা সহ গন্ডারকুলের গল্প। এরা উত্তরের অরণ্যের গন্ডারকুল। আজ সেই গল্পই শোনাবো বলে কলম ধরলাম। 

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের শালকুমার গেট লাগোয়া চত্বর থেকে মাদারিহাটমুখী গেটের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। আকাশের মুখ ভার হলেই ময়ূর তার পাখনা তুলে তাদের নৃত্যে তাক লাগিয়ে দেয় এই রাস্তাতে। কোথাও বা ময়ূর ময়ূরী খুনসুটি করে এবং আমাদের মত বেরসিকেরা হাজির হলে তারা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায়। ওই রাস্তাটিতে ময়ূরের আনাগোনা প্রায় সবসময় লেগেই থাকে বলে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের এই রাস্তাটি পিকক এভেনিউ বা ময়ূর সরণি নামে পরিচিত। ওই পথ ধরেই যাচ্ছিলাম হলং বনবাংলোর দিকে। জঙ্গল চিরে যাওয়া ওই ময়ূর পথের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট নদী। নদীর ওপরে রয়েছে কাঠের সেতু। শুনেছিলাম সেই নদীতে মাঝেমধ্যেই নেমে পড়ে গন্ডারেরা। গরমের সময় ওই নদীতে গা ভিজিয়ে থাকতে দেখা যায় গন্ডারদের। যদিও সেই বার আমরা গন্ডার দেখতে পারিনি। কিন্তু কার সাফারি শেষ হবার পর হলং বনবাংলোতে বসে বিট অফিসারের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম গন্ডারের গ্রামবাসীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার কাহিনী। সেই কাহিনী দিয়েই শুরু করছি। 

জলদাপাড়া পূর্ব রেঞ্জের অরণ্যঘেরা গ্রাম শিশাবাড়ি। সেই গ্রামের বাসিন্দা বিদুর বিশ্বাস, সাবিত্রী বিশ্বাস, নিরঞ্জন মিস্ত্রি ও দিপালী মিস্ত্রিরা। পুকুর আর গাছগাছালিতে ঘেরা গৃহস্থ বাড়ি। বিদুর বিশ্বাস প্রতিদিনের মত সেদিনও সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরের পাড়ে গিয়ে দেখেন একটা গন্ডার জলে শুয়ে ছটফট করছে। বনদপ্তরের জলদাপাড়া পূর্ব রেঞ্জে খবর যায়। জানা যায় দুটো পুরুষ গন্ডার এর মধ্যে সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে এই গন্ডারটিকে পেছন থেকে ফেড়ে দেওয়াতে গন্ডারটি ভয়ঙ্করভাবে জখম হয়েছিল। এরপরেই গন্ডারটি আশ্রয় নিয়েছিল পুকুরে। বনদপ্তরের জলদাপাড়া পূর্ব রেঞ্জের তৎকালীন রেঞ্জ অফিসার স্বপন মাঝি এবং শিসামারার বিটবাবু শ্রীবাস সরকারকে খবর দেবার পর দুই দিন ধরে চেষ্টা করে গন্ডারটিকে পুকুর থেকে জঙ্গলে ফেরাতে সক্ষম হয় তারা। বনকর্মীরা গন্ডারটিকে নিয়ে গেলেও কয়েকদিন বাদে আবার সেটি চলে আসে। সেই থেকে পুকুর আর সুপারি বাগানে আসা-যাওয়া শুরু হয়। কোনদিন ভোরে এসে সারাদিন থেকে আবার সন্ধ্যায় চলে যায়। আবার কখনো সন্ধ্যায় এসে ভোরে চলে যায়। অনেকদিন ধরে সেটাই ছিল গন্ডারটির রুটিন। কোন চোরাশিকারির নজর যাতে ওর ওপরে না পড়ে তার জন্য পালা করে রাত জেগে পাহারা দিত গ্রামবাসীরা। তবে সবকিছু একদিনে হয়নি। প্রথম দিকে সবসময় ভয় হতো কখন গন্ডারটি আক্রমণ করে বসে। সকলেই ওর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখত। 
স্নান করা, পুকুরে লুটোপুটি খাওয়া ছিল গন্ডারটির প্রিয় অভ্যাস। বিদুরবাবুর সুপারি বাগানকে গন্ডারটি শৌচালয় বানিয়ে ফেলে। তারপর থেকে ওকে কেউ আর বিরক্ত করত না। একদিন ওকে কালু নামে ডাকতে শুরু করার পর আশ্চর্য হয়ে গ্রামবাসীরা দেখে গন্ডারটি কান খাড়া করে তাকাচ্ছে। কিছুদিন পর থেকে সে বুঝে যায় তাকে ডাকা হচ্ছে। কালু বলে ডাকলেই কান খাড়া করে মাথা দোলাতো গন্ডারটি। কয়েকবার ডাকার পর পুকুর থেকে উঠে সোজা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকত। চলে যেতে বললেই পুকুরে গিয়ে লুটোপুটি খেত। মাত্র ছয় মাসেই যে কালু তাদের কাছে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি গ্রামবাসীরা। কালু যে এইভাবে তাদের বাধ্য হয়ে যাবে তা কল্পনাও করে নি গ্রামবাসীরা। গন্ডারটি যখন দুলকিচালে জলদাপাড়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পুকুর এবং সুপারি বাগানে আসত তখন তারা চারিদিকে সতর্ক নজর রাখত যাতে কেউ ওকে বাধা না দেয়। শৌচকর্ম সেরে পুকুরটিতে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা সে আবার জঙ্গলে চলে যেত। সে ছিল যেন ওই গ্রামের অতিথি। তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা এবং নিরাপত্তা পেয়ে কালুও যেন আলাদা জগৎ খুঁজে পেয়েছিল। মাঝে মাঝে জলদাপাড়া বিটের বনকর্মীরা যেতেন গন্ডারটির শরীর ঠিক আছে কিনা তার খবর নিতে। আসলে বন্যপ্রাণীরা যে সবসময় ভয়ঙ্কর নয় সেটার প্রমাণ ছিল কালুর চরিত্রে। ওদের কেউ অসুবিধা না করলে ওরা কাউকে কিছু করে না। 

কথায় বলে কারোর পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ। লকডাউনের সময় জলদাপাড়ার জঙ্গলমহল ছিল গন্ডারদের প্রেমকুঞ্জ। গন্ডারকুলের প্রেম নিবেদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রীতিমতো তাদের সামাল দিতে কুনকি হাতি দিয়ে পাহারা দিতে বনদপ্তর বাধ্য হয়েছিল। গরুমারার ঘাড়মোটার গল্প খুবই ট্র্যাজিক। গরুমারাতে গন্ডারদের অসম অনুপাতের জন্য সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে ঘাড়মোটাকে নিয়ে বনদপ্তর পড়েছিল বড়ই সঙ্কটে। মাঝেমাঝেই সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে হেরে গিয়ে গরুমারার জঙ্গল ছেড়ে বিবাগী হয়ে যেত ঘাড়মোটা। লাটাগুড়িতে একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক পেরিয়ে গরুমারা ছেড়ে লাটাগুড়ির জঙ্গলে আশ্রয় নিত বিশালদেহী ঘাড়মোটা। আসলে বয়স হয়ে যাওয়াতে আর বারেবারে প্রেমে ব্যর্থ হবার পরে প্রেস্টিজের খাতিরেই জঙ্গল ছড়তে হত ঘাড়মোটাকে। পশু বলে ওদের কি মানসম্মান থাকতে নেই নাকি? তখন কুনকি হাতি দিয়েও ঘাড়মোটাকে তার গরুমারার আস্তানায় ফেরাতে ব্যর্থ হত বনকর্মীরা। বাধ্য হয়ে ঘাড়মোটার নিরাপত্তার জন্য লাটাগুড়ির জঙ্গলে নিয়োগ করা হল বাড়তি বনকর্মী। ঘাড়মোটাকে গরুমারার জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে বেশিসংখ্যক কুনকি নিয়ে ময়দানে নামা হত সেইসময়। 

ঘাড়মোটা কি সহজে ধরা দিত নাকি? বনকর্মীদের সঙ্গে যেন তার শুরু হত লুকোচুরি খেলা। কখনো ঝোপঝাড়ের পেছনে, আবার কখনো বা জঙ্গলে সে লুকিয়ে পড়ত। লাটাগুড়ির জঙ্গলে চলে এলে ঘাড়মোটাকে নিয়ে বনদপ্তরের চিন্তা বেড়ে যেত। কারণ প্রথমত নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই লাটাগুড়ির জঙ্গলে। তার ওপর লাটাগুড়ির জঙ্গল থেকে খানিকটা পথ এগোলে নেওড়া নদী আর সেটা পেরোলেই লোকালয়। এই পথেই এর আগেও একাধিকবার গন্ডার লোকালয়ে বেড়িয়েছে। তাদের পুনরায় গরুমারায় ফেরাতে কালঘাম ছুটেছে বনদপ্তরের। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ জুড়ে চোরাশিকারিদের একটা চক্র সক্রিয় রয়েছে। চোরাকারবারীদের হাতে মৃত্যু হয়েছে গরুমারার দুটি গন্ডারের। যাতে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেই উদ্দেশ্যে ঘাড়মোটাকে গরুমারায় ফেরাতে উঠে পড়ে লাগত বনদপ্তর। বনকর্মীদের দিয়ে এবং গরুমারার দুই কুনকি হাতি রাজা এবং হিলারিকে দিয়ে ঘাড়মোটাকে জঙ্গলে ফের ঢোকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন বনকর্মীরা। 

একবার বেশি সংখ্যক কুনকি হাতি লাগিয়ে লাটাগুড়ির জঙ্গল থেকে তাড়িয়ে ঘাড়মোটাকে জাতীয় সড়কের খুব কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন বনকর্মীরা। তবে জাতীয় সড়ক পার করিয়ে গরুমারা ঢোকার কিছু আগেই বনকর্মী এবং কুনকি হাতিদের নজর এড়িয়ে ফের লাটাগুড়ির জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যায় সেটি। সন্ধ্যের পর বহু খোঁজাখুঁজি করে একঝলক দেখা মেলে গন্ডারটির। পরের দিন সকাল থেকে ফের গন্ডারটিকে গরুমারা ফেরত আনতে আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবশেষে সফল হয় বনকর্মীরা এবং বনদপ্তর থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা সকলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে খুবই দুঃখের কথা উত্তরের জঙ্গল মহলের ডন টারজান নামে এক গন্ডারের সঙ্গে লড়াইতে মৃত্যু হয় ঘাড়মোটার। তবে ত্রিকোণ প্রেমের লড়াইতে প্রতিপক্ষকে ছাড়েনি সে। সেই যাত্রায় ওই লড়াইতে টারজানও সাংঘাতিক রকমের আহত হয়েছিল। তবে গরুমারাতে সঙ্গিনী দখলের লড়াই দিন দিন বাড়ছে। বোতল সিং নামে একটি গন্ডারের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তার মৃত্যুও সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ে হয়েছে বলে বনদপ্তরের অনুমান ছিল। গরুমারাতে ডন নামে আরেকটি গন্ডারও সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে আহত হয়। তার পেছনের পায়ে গুরুতর আঘাত ছিল। গরুমারার জঙ্গলে ট্র্যাংকুলাইজার করে চিকিৎসা করা হয় ডনের। 

আসলে গন্ডারকুলের অবাধ প্রেমপর্ব শুরু হয় লকডাউনের সময়। লকডাউনের জন্য দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে এবং প্রতিবারের মত জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জঙ্গলে পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ ছিল। ফলে বর্ষার সময় সমস্ত অভয়ারণ্য বন্ধ থাকার সুযোগে নির্জন জঙ্গলকেই তাই নিজেদের বংশবিস্তারের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল গন্ডারকুল। প্রেম নিবেদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রীতিমতো তাদের সামাল দিতে কুনকি হাতি নিয়ে পাহারা দিতে বনদপ্তর বাধ্য হয়েছিল। ঠিক এই রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল রামসাই বাজার সংলগ্ন জলঢাকার চরে। এলাকার অনেক বাসিন্দা রাতেই বাঁধের পাড়ে দাঁড়িয়ে রাখি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দুই গন্ডারের খুনসুটি দেখতে পায়। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ গরুমারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দুটি গন্ডার চলে আসে জলঢাকার চরে। সেখানেই উদ্দাম প্রেমে তারা মেতে ওঠে। দুই গন্ডারের আওয়াজে আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। খবর যায় বনদপ্তরের রামসাই মোবাইল স্কোয়াডে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মেদলা থেকে কুনকি হাতি শিলাবতীকে নিয়ে আসা হয়। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে সঙ্গমে মেতে ওঠে গরুমারার ওই গন্ডার যুগল। যাতে ওই দুই গন্ডার লোকালয়ে বেরিয়ে না আসে তার জন্য বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে থাকেন বনকর্মীরা এবং কুনকি হাতি শিলাবতী। ঘন্টা দুয়েক পর গরুমারার গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে তারা। 

এমনিতেই গরুমারার নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদাই সচেতন থাকতে হয় বনদপ্তরকে। তার ওপর আবার গরুমারা সীমানা ছেড়ে জলঢাকার চরে অনেক সময় বিবাগী গন্ডার বাবাজি চলে আসে একাকী বিরহ যাতনা উপভোগ করতে। সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত এবং ক্লান্ত গন্ডারের কেউ কেউ মাঝেমধ্যেই গরুমারা সীমানা ছেড়ে ময়নাগুড়ি ব্লকের রামসাইতে জলঢাকা নদীর চরে চলে আসে। সেই গন্ডারদের গরুমারাতে ফেরত পাঠাতে হাতি নিয়ে টহল দেওয়া হয়। কুনকি হাতির তাড়াতে বেশিরভাগ গন্ডার আবার গরুমারাতে ফেরত চলে যায়। তবে কোনো কোনো সময় কোন কোন পুরুষ গন্ডার কিছুতেই গরুমারাতে ফিরতে চায় না এবং জলঢাকার চরকেই নিজের আস্তানা হিসাবে গড়ে তোলে। এতেই হয়ে যায় সমস্যা। তখন ওই গন্ডারটির নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রামসাই এবং পানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা, পুলিশ এবং বনকর্মীদের নিয়ে স্পেশাল টিম তৈরি হয়। তারা এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয় এবং সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার পাশাপাশি প্রশাসনকে খবর দেয়। ফলে গন্ডারের ভাব-ভালোবাসা, ঝগড়া বিবাদের কারণে তাদের নিরাপত্তার জন্য এলাকাতে একটি পুলিশফাঁড়ি তৈরি করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই বিবাগী গন্ডারদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে কুনকি হাতিদেরকে নিয়ে ওই জঙ্গলে গন্ডারের খোঁজে চালানো হয় তল্লাশী।


আসলে কারোর পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ। এই আপ্তবাক্যটি জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান এর ক্ষেত্রে যেন সত্যি হয়ে উঠেছিল লক ডাউন এবং লকডাউন পরবর্তী পর্বে। বর্ষার জঙ্গলে অফুরন্ত পাওয়া যায় গন্ডারের প্রিয় ঘাস ঢাড্ডা, চেপ্টি, পুরুন্ডি, খাগড়া এবং একরা। তোর্সার ভাঙ্গনে একদিকে যেমন বহু মানুষের ভিটেমাটি এবং কৃষিজমি তলিয়ে যায়, তেমনি জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে গন্ডারদের বংশবৃদ্ধিতে এই নদী এবং নদী ভাঙ্গন ভীষণভাবে কাজে লাগছে প্রতিবছর। প্রতিবছর এই নদীর পাড় ভাঙ্গার পর যে পলিমাটি জমে থাকে সেখানে গন্ডারের প্রিয় ঘাস জন্ম নেয়। নদী ভাঙ্গনের ফলে বড় বড় গাছ ভেসে যায়। সেই সব জায়গায় পলিমাটি জমে থাকে। ওই পলিমাটিতে প্রাকৃতিক উপায়ে গন্ডারের প্রিয় ঘাস ঢাড্ডা, চেপ্টি, পুরুন্ডি, খাগড়া এবং একরা জন্মায়। কৃত্রিম উপায়ে ঘাসের প্ল্যান্টেশনে আর্থিক ব্যয় প্রচুর। আর এই নদী ভাঙ্গনের ফলে যে প্রাকৃতিকভাবে ঘাস হচ্ছে তাতে খরচের ব্যাপার নেই। নদী ভাঙ্গনের ফলে যে ঘাস জন্মায় তার সবটাই গন্ডারের উদরস্হ হয়। খাদ্যের খোঁজে গন্ডারদেরকে আর সেভাবে পরিশ্রম করতে হয় না। বংশবৃদ্ধিতে মন দিতে পারে তারা। 

নিজেদের মধ্যে লড়াই করে গন্ডারের মৃত্যু হচ্ছে কেন? বনদপ্তর সূত্রের খবর, ২০১৫ সালে জলদাপাড়াতে গন্ডার শুমারিতে এই জাতীয় উদ্যানে ২০৭ টি গন্ডারের সন্ধান মেলে। চার বছর পর ২০১৯ সালে ফের জলদাপাড়াতে গন্ডার শুমারি হয়। সেই সময় গন্ডার শুমারি হয় গরুমারাতেও। সরাসরি দেখার পাশাপাশি গন্ডার শুমারিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে গন্ডারের মল সংগ্রহ করে তা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নেন বনকর্তারা। সেই শুমারি রিপোর্ট আসার পরেই উত্তরের এই দুই জঙ্গলে গন্ডারের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হন বনকর্তারা। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুসারে প্রায় ২৩৭ টি গন্ডার রয়েছে। ২০১৫ সালে পাওয়া গিয়েছিল ২১৬ টি। গরুমারা এবং জলদাপাড়ার গন্ডারের এই প্রেম নিবেদনে আগামী দিনে যে গন্ডারের সংখ্যা বাড়বে সেই আশায় বুক বেঁধেছেন পশুপ্রেমী থেকে বনদপ্তরের কর্তারা। 

তোরসা নদীর ভাঙ্গনের ফলেই জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে গন্ডারের এই বংশবৃদ্ধি বলে অভিমত বনকর্তাদের। কিন্তু পরিবেশ কর্মীদের অনেকের মনে সেই সময় থেকেই আশঙ্কা ছিল যে স্ত্রী গন্ডারের চাইতে পুরুষ গন্ডারের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে জঙ্গলে সঙ্গিনী দখলের লড়াই বাড়বে। সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে গরুমারার জঙ্গলেও গন্ডার এর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পছন্দের সঙ্গিনী দখল নিয়ে লড়াইয়ের জেরে অনেক সময় অন্যান্য বনাঞ্চলেও গন্ডারের মৃত্যুর তথ্য সামনে আসছে। প্রশ্ন উঠেছে গন্ডারের আদর্শ বিচরণের জন্য পুরুষ এবং স্ত্রী গন্ডারের আনুপাতিক হার নিয়ে। গন্ডারের অনুপাতের নিয়ম অনুসারে একটি পুরুষ গন্ডার পিছু তিনটে অথবা খুব কম করে হলেও দুটো করে স্ত্রী গন্ডার প্রয়োজন। বনকর্তা উজ্জ্বল ঘোষের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম পুরুষ গন্ডারের অনুপাতে স্ত্রী গন্ডারের সংখ্যা কম জলদাপাড়াতে। তাই জলদাপাড়া এবং গরুমারা সহ উত্তরের অরণ্যে স্ত্রী গন্ডারের সংখ্যা কম হবার ফলে সঙ্গিনী নিয়ে পুরুষ গন্ডারের লড়াই এর কাহিনী কারো অজানা নয় এবং সঙ্গিনী দখলের লড়াই বেড়েই চলেছে। 

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে প্রায় ১০ বছর ধরে রাজত্ব করছে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুবক গন্ডাররা। এরা এতটাই শক্তিশালী যে বৃদ্ধ পুরুষ গন্ডারদের এরা স্ত্রী গল্ডারদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। তাতে খুশি বনকর্তারা। কারণ যুবক গন্ডারদের দাপানোতেই গল্ডারদের বংশবৃদ্ধিতে ব্যালেন্স সম্ভব হয়েছে বলে বন দপ্তরের দাবি। আবার সদ্য যৌবনে পা রাখা গন্ডারদেরও স্ত্রী গল্ডারদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। শুধুমাত্র ওরাই স্ত্রী গন্ডারদের কাছে যায়। ফলে বংশবৃদ্ধিতে হৃষ্টপুষ্ট শাবকের জন্ম হচ্ছে। বৃদ্ধের কোটায় নাম লেখানো গন্ডারদের নিয়ে বনকর্তাদের মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা বনের বোঝা হয়ে যাওয়াতে তাদের দ্বারা যেমন বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না, আবার বসে থেকে খাবার খেয়ে ধ্বংস করে তারা। তাই যৌবনে পা রাখা পুরুষ ও স্ত্রী গন্ডারদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ওরা। তাই সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ে ওই বৃদ্ধ গন্ডারগুলো সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে বা জখম হচ্ছে। তবে অসম এই লড়াইতে একের পর এক গন্ডারের মৃত্যু সত্যিই চিন্তার বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এই ব্যাপারে কি করা যায় সেই চেষ্টা করা একান্তই প্রয়োজন বনদপ্তরের।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                          software development company in siliguri,no 1 software
                          development company in siliguri,website designing company
                          in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                          in Siliguri website design company in Siliguri, web
                          development company in Siliguri