উত্তরাখন্ডের পাহাড়ে ভ্রমণ/অতনু চন্দ
উত্তরাখন্ডের পাহাড়ে ভ্রমণ
অতনু চন্দ
---------------------------------
হটাৎ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই একদিন আমাদের পরিবারের ভাই/বন্ধু অতনু চৌধুরী ফোন করে বলল, "চলো 'কেদারনাথ' থেকে ঘুরে আসি!"
শুনে আমি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম! আরে ও বলে কি ! জুন মাসে উত্তরাখন্ডে বৃষ্টি থাকবে তাই এই সময়টা কি ওখানে যাওয়া আমাদের পক্ষে নিরাপদ হবে!
অনেকদিন আগে থেকেই অবশ্য আমাদের চারধামে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। নানান কারণে তা হয়ে ওঠেনি, তাই এ বয়সে এসে সে ইচ্ছে ত্যাগ করেছি কারণ এ বয়সে উত্তরাখন্ডের পাহাড়ের ঐ কষ্টকর উঁচু পথে হেঁটে অথবা ঘোড়ার চড়ে যেতে পারব না বলে সে সাহস আর করিনি। অতনু চৌধুরীর স্ত্রী শ্বেতা আমাদের মনের সে সুপ্ত কথাটি জানত। তাই শ্বেতা আর অতনু মিলেই আমাদের চারধাম দেখাবে বলে এবারের বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা সে ভাবে করেছে শুনলাম। আগেও ওদের সৌজন্যেই লাদাক, কাশ্মীর, পশুপতিনাথ ও বৈষ্ণদেবী দর্শন করেছি। তাই ওদের সঙ্গও ছাড়তে ইচ্ছে হল না। চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে গেলে আমাদের কোনও কিছুর চিন্তা করতে হয় না। সেই সময়টা আমাদের দু'জনের শরীরটাও ভাল যাচ্ছিল না কিন্ত পরে যদি আর কোনদিন যাওয়া না হয়ে ওঠে, সে কথাও আমাদের ভাবাচ্ছিল। যাওয়ার আগেই ওরা যেখানে যাবে তার রোড ম্যাপ ও থাকার জায়গার চার্ট তৈরী করে নেয় খুব আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। অতনুর সদাহাস্য সুযোগ্য স্ত্রীও এ ব্যাপারে ভীষণ পারদর্শী। কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে এটা শ্বেতা খুব ভাল জানে। আমার মেয়েরাও তাই ওদের শ্বেতা আন্টির সাথে বেড়াতে খুব ভালোবাসে। বেড়াতে গেলে দেখেছি, শ্বেতা একটা হাত ব্যাগ নিয়ে যায় তার মধ্যে "Alpine to Elephant" সব থাকে, যা দরকারের সময় আমাদের খুব কাজে লাগে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ওরাই আমাদের আদর্শ "Guide & Philosopher" এবং ভীষণ ভরসার জায়গা। তাই আমরা একটা শর্ত সাপেক্ষে যাব বলে কথা দিয়ে দিলাম। বললাম, কেদারনাথ অবশ্যই যাব যদি Helicopter Service-এর টিকিট পাই তবেই।
আমার বড় মেয়ের ক'দিনের নিরলস চেষ্টায় onlineএ Helicopterএর পাঁচটা টিকিট পেয়েও গেলাম! ( ভাড়া মোট ₹ 7,750/= পাঁচ জনের যাওয়া এবং আসা)। Helicopterএর আসন সংখ্যা, পাইলটকে নিয়ে আট।
আমাদের ভ্রমনসূচী ছিল এ রকম…..
১১ জুন ২০২২ আমরা দূর্গা দূর্গা বলে বাগডোগরা থেকে দিল্লীতে রওনা হলাম। দিল্লীতে পৌঁছে ওখান থেকে রাতের ট্রেনে হরিদ্বার রওনা হয়ে পরের দিন সকাল বেলা হরিদ্বার পৌঁছে গেলাম।
১২ জুন ২০২২ হরিদ্বার পৌঁছেই রেল স্টেশনের সামনের এক Tourist Center থেকে দিন হিসেবে ₹5000/= টাকা দিয়ে একটা 7 Seatter নতু গাড়ি এবং সঙ্গে খুব ভাল চালক ও সুরসিক সুদামাকে পেলাম। আমরা গাড়ি নিয়ে প্রথমে ঋষিকেশ গেলাম। ওখানে গঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ করে গঙ্গায় স্নান করে সীতাঝোলা ও লছমনঝোলায় গেলাম। ফিরে আসার পথে অবশ্য হর কি পৌরি-ব্রহ্মকুন্ডতে সন্ধ্যাআরতি দেখতে গেছি। আমার এক আত্মীয় হরিদ্বারের কাছে চাকরির কারণে ছিলেন তাই আমি ছোটবেলা থেকেই এদিকটায় অনেকবার গেছি কিন্ত এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্রচুর লোকের সমাগমের কারণে আগের সেই ধ্যানমৌন শান্ত সুন্দর শান্তির পরিবেশ খুঁজে না পেয়ে মনটা একপ্রকার খারাপই হয়েছিল! ঐ দিনই দেবপ্রয়াগে রাতে থাকব বলে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলের চওড়া বারান্দায় বসে এই ছোট শহর এবং সঙ্গমস্থল স্পষ্ট দেখা যায়। তবুও রাতে আমরা পায়ে হেঁটে তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে অনেকটা পথ নেমেছি দেবপ্রয়াগ সঙ্গমে। যেখানে ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদী মিলিত হয়েছে। সেখানে পায়ের পাতা ভেজানো জলে নেমে দেখেছি কিন্ত ভয়ে বেশি এগোইনি কারণ কি তার স্রোত ও গর্জন। অপূর্ব সে দৃশ্য ও পরিবেশ। দু'টি নদীর যে আলাদা আলাদা জলের রং এবং তা যে একটা সরলরেখায় এসে মিলিত হয়েছে,তা স্পষ্ট বোঝা যায়!
১৩ জুন ২০২২ দেবপ্রয়াগ থেকে রওনা হয়ে গুপ্তকাশী, সোনপ্রয়াগ ও গৌরীকুন্ড হয়ে আবার গুপ্তকাশীতেই রয়ে গেলাম।
১৪ জুন ২০২২ গুপ্তকাশী হেলিপ্যাড থেকে বাবা কেদারনাথের দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভীষণ রোমাঞ্চকর সে সফর। উপর থেকে পাহাড়ের অনেকটা দেখতে পেয়েছি এবং দেখেছি পিঁপড়ের সারির মতন কয়েক মাইল ধরে ভক্তদের হেঁটে বা ঘোড়ায় চলার দৃশ্য ! কেদারনাথ মন্দিরের থেকে হেলিপ্যাডর দূরত্ব হাফ কিলোমিটারেরও কম কিন্ত নেমেই দেখি দর্শনের বিরাট লাইন। যারা হেঁটে আসছেন তারাও ঐ লাইনে সামিল হচ্ছেন। এদিকে আমাদের নি:শ্বাস নিতেও একটু কষ্ট হচ্ছে তাই আগে ভাগেই আমার স্ত্রীকে 'পিট্টু'তে চাপিয়ে দর্শনের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলাম। আমরাও লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকের দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! এখানে যে একদিন আসতে পারব তা কোনদিন আশা করিনি। শ্বেতা ও অতনুর উৎসাহেই তা আমরা পেরেছি, এটা ঠিক। কিন্তু ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এই শামুকের গতিতে এগিয়ে চলা একটা সময় আমাদের কাছে কষ্টকর ও বেশ অসহনীয় হয়ে উঠল। অবশেষে তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ক'য়েক সেকেন্ডের জন্য, প্রায় দশ হাত দূর থেকে কেদারনাথ বাবার দর্শন হল! একটু দেখলাম যেন তিন কোনা ছোট্ট পাহাড়ের মাথা অথবা কিছুটা ষাঁড়ের কুঁজের মতন উঁচু পাথরের কিছু। একটা কথা আছে না "মানো তো দেবতা আর না মানো তো পাত্থর", তাই হাত তুলে প্রনাম করতে না করতেই রিংয়ের বাইরে ছিটকে গেছি! মহাভারতে পান্ডবদের নিয়ে একটা পৌরাণিক কাহিনী আছে, পান্ডবরা নাকি শিবঠাকুরকে খুঁজতে খুঁজতে উত্তরাখন্ডের এই পাহাড়ে এসেছিলেন তখন ভীম শিবঠাকুরকে এই স্থানে দেখতে পায় ইত্যাদি প্রভৃতি আর সেখান থেকেই কেদারনাথের এই মন্দির! সত্যি মিথ্যা জানি না। এবার আমরা সবাই ঐ ছোট্ট পরিসরে একটু ঘুরেফিরে দেখতে লাগলাম, যেখান থেকে Glacier ভেঙে নেমে এসে সব ধুয়ে মুছে সাফ করেছে সেসব চিহ্নও তখনও বর্তমান ছিল। অবশেষে "ভীমশিলা" নামক সেই বিরাট পাথর, যা কিনা উপর থেকে নেমে এসে কেদারনাথের মন্দিরের কিছুটা পিছনে স্থির হয়ে থেকে প্রবল জ্বলোচ্ছাসকে প্রতিহত করেছে। না হলে যা অবস্থা হয়েছিল (তা আমরা TVতেও দেখেছি) তাতে কেদারনাথ মন্দিরের অবস্থা কি হত তা ভাবা যায় না। শুনেছি, মন্দির পুরোহিত এবং যারা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাই শুধু রক্ষা পেয়েছেন। জানি না, এ কোন অদৃশ্য শক্তির হাত বা অলৌকিক কিনা !! বিদ্যা-বুদ্ধিতে এর সঠিক ব্যাখ্যা নেই আমাদের কাছে। এখানকার ধকলে ইতিমধ্যে বেশ ক্ষুধার্থ অবস্থা তাই এক জায়গায় আমরা বসে কিছু খেতে খেতেই ভাবছি যে খাওয়া হয়ে গেলেই আস্তে আস্তে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হব। খেয়েদেয়ে উঠেছি কি উঠিনি তার মধ্যেই আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হতে আরম্ভ করেছে! চারিদিকে হটাৎ করে অন্ধকার করে ঝড় বৃষ্টি নেমে এল! শীতের পোষাকেও আমাদের বেশ শীত লাগতে লাগল,সঙ্গে আমাদের রেইনকোটও ছিল। কোন রকমে হেলিপ্যাডে পৌঁছালাম বটে কিন্ত সেখানেও বিরাট লাইন। তাবুতে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ফেরার টোকন দেখিয়ে অবশেষে আমরা Helicopterএ উঠে বসলাম। আমি পাইলটের পাশের সিটে বসে দেখছি বৃষ্টির ফোঁটা wind screenএ যেন পাথর বৃষ্টির মতন শব্দ করে পড়তে থাকল। চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। এখানেই পাইলটের অপূর্ব পরিচালনা দেখে অবাক ও মুগ্ধ হলাম। আমরা তো ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছি,তারই মাঝে দেখলাম দক্ষ হাতে পাইলট দুই পাহাড়ের খাঁজে কখনো উপরে উঠে, কখনো অনেকটা নেমে, কখনো ঘোরা পথে helicapter নিয়ে বাজ পাখীর মতন এগোতে লাগলেন। মনে হয় সাত থেকে দশ মিনিটির মধ্যে আমরা সুস্থ ভাবে হেলিপ্যাডে অবতরণ করলাম!এখন সে কথা ভাবলে খুব রোমাঞ্চকর লাগে কিন্ত তখন প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম প্রায়!
১৫ জুন ২০২২ উখিমঠ থেকে চোপতা হয়ে বদ্রীনাথ গেলাম।
১৬ জুন ২০২২ বদ্রীনাথ দর্শন করে India-Tibet বর্ডারে ভারতের ছোট্ট সুন্দর 'মানা গ্রাম' দেখতে গেলাম। তারপর যোশীমঠ হয়ে ওখান থেকে রোপওয়েতে 'আউলি' গেলাম। ভারি সুন্দর সে অভিজ্ঞতা। অউলিকে শীতকলে সুইজারল্যান্ডের সাথে তুলনা করা হয় কারণ চারিদিকে নাকি শুধু বরফ আর বরফ থাকে।
১৭ জুন ২০২২ কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ হয়ে উত্তরকাশীতে রাত্রি বাস।
১৮ জুন ২০২২ উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী। ভীষণ সুন্দর জায়গা তাই আমাদের খুব ভালো লেগেছে। তবে আমার স্ত্রী সেই দামাল গঙ্গা বক্ষ থেকে বোতলে গঙ্গাজল সংগ্রহ করতে গিয়ে পা পিছলে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে ঐক্য (অতনুর ছেলে) ওর ভিক্ষা মায়ের (আমার স্ত্রী) সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে এবং ভীষণ যত্ন করে ছেলের মতন করে আমার স্ত্রীকে সাহায্য ও সুরক্ষা দিয়েছে।
১৯ জুন ২০২২ উত্তর কাশী থেকে মাসৌরী।
২০ জুন ২০২২ মাসৌরী থেকে দেরাদুন। দেরাদুনে দুপুরে সুদামার বাড়িতে আমরা খাওয়া দাওয়া করেছি। সুদামার পরিবার আমাদের উষ্ণ আপ্যায়ন ও খুব যত্ন করেছে, যা আমাদের উপরি পাওনা। তবে এখানে একটা কথা বলব যে Darjeeling Himalayan Sikkim রেঞ্জে যে সমস্ত ছোট বড় শহর ও গ্রাম আছে তা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে অনেক বেশি সুন্দর charming & colorful জনজীবনও অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম। অন্তত আমার তাই মনে হয়। রাস্তায় Laxman Sidh মন্দির দর্শন করেছি (ভারতবর্ষের আর কোথাও লক্ষনের নামে মন্দির আছে কিনা আমার জানা নেই! এ দর্শন শুধু ভক্তি নয়,স্থাপত্য শিল্পের প্রতি আমাদের একটা আকর্ষণ ও বটে) । মায়ের এক পীঠস্থান দর্শন করেছি তবে কোথায়/কখন ঠিক মনে করতে পারছিনা এখন! মায়ের সে পীঠস্থানে রোপওয়ে তে যেতে হয়। এই মন্দিরগুলি এখানে নাকি প্রসিদ্ধ।
২১ জুন ২০২২ হরিদ্বার থেকে দিল্লী।
২২ জুন ২০২২ দিল্লী থেকে বাগডোগরা ফিরে আসি।
এভাবেই আমরা ক'দিন পাহাড়ে বেড়িয়েছি। তবে তার সব কথা বিস্তারিতভাবে এখানে বলতে গেলে ইতিহাস ভূগোল বই হয়ে যাবে! সহজ উঠোনের এমাসের বিষয়বস্তুর মধ্যে থেকে আজ আমাদের এই পাহাড়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কথা বললাম। যারা এখনো ওদিকটায় যাননি তাদের কিছুটা ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি মাত্র। কতটা সফল হতে পেরেছি জানি না! তবে অনুরোধ করব এই বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার যদি বলার মধ্যে কোনও ভুল ক্রটি হয়ে থাকে তবে নিজ গুণে মানিয়ে নেবেন। আর ভালো লাগলে আবার কখনও আমাদের অন্য কোনও ভ্রমণ বৃত্তান্ত আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা যাবে। সে প্রশ্রয়ের আশা রেখে……..
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴