উত্তরপূর্ব ভারতের কাজের বাংলা/রণজিৎ কুমার মিত্র
উত্তরপূর্ব ভারতের কাজের বাংলা
রণজিৎ কুমার মিত্র
উত্তরপূর্ব ভারতে একসময় বাংলাই ছিল কাজের ভাষা। প্রশাসনিক গদ্য বলতে বাংলা গদ্যকেই বোঝাত। আজকের বাংলার সাথে সেই আদিম বাংলার অনেক পার্থক্য ছিলো। ষোড়শ থেকে আঠেরোশো শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত , সে বাংলা চলছিল কুণ্ঠার সঙ্গে, একান্তই প্রয়োজনের তাগিদে। আইন-আদালত, ক্রয়- বিক্রয় চুক্তিনামার কাজ সবই চলত ওই বাংলায়। দীনেশ চন্দ্র সেন ১৪৭৭ শকাব্দ (১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ)এ কোচবিহার মহারাজ নরনারায়ণের অহমরাজ স্বর্গদেবকে লেখা চিঠিটিকে "বাংলাগদ্যের আদিম নিদর্শন" বলে গ্রহণ করেছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে "প্রকাশিত প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য পরিচয়ে"। ভাষা গবেষকরা মনে করেন মহারাজ নরনারায়ণের এই চিঠির আগে অন্তত ২০০ বছর ধরে দৈনিক কাজকর্মে এই বাংলা গদ্যের ব্যবহার ছিলো। এই বাংলা কামরূপ, কাছাড়, মনিপুর, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, বিহার তো বটেই ভুটান, সিকিম নেপালেও প্রসারিত হয়েছিল। মহারাজ নরনারায়ণ নিজের ক্ষমতায় ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা শুক্লধ্বজের বীরত্বে সমগ্র পূর্বভারতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। অহম - কাছাড়- জৈন্তিয়ার রাজারা, কোচবিহারের দরবারে কর পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন । ওই সব রাজ্যগুলি ছাড়াও তিব্বত ভুটান প্রভৃতির বাজারে নরনারায়ণের নামাঙ্কিত নারায়ণী টাকা গৃহীত হত। এই টাকা কোচবিহার সন্নিহিত সমস্ত দেশের বাজারে চলত । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ রাজশক্তির নির্দেশে কোচবিহারের টাঁকশাল বন্ধ হয়ে যায়।
বাঙালি সবসময় শাসকের ভাষায় কথা বলতে চেয়েছে, তাই তারা ফার্সি শিখেছে, ইংরেজি শিখেছে সংস্কৃত বাংলা উত্তরাধিকার সূত্রে তারা জানতেন। বাঙালি উকিলদের উত্তরপূর্ব ভারতে খুব চাহিদা ছিল, তারাই রাজদরবারের প্রয়োজনের চিঠিপত্র লিখে দিতেন। সুরেন্দ্রনাথ সেনের প্রাচীন বাংলা পত্র সংকলনে কোচবিহার রাজবৃত্তের চিঠি সবচাইতে বেশি পাওয়া গেছে। দিল্লিতে মোগল শক্তির পতনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ভয়ঙ্কর সংকট তৈরী হয়। কোচবিহারেও তার প্রভাব পরে, রাজপরিবারের অভ্যন্তরেও শক্তিলাভের প্রতিযোগিতা, ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, আকস্মিক অভুথ্যান আত্মকলহ একসময় কোচবিহার রাজপরিবারের ছিলো নিত্যসঙ্গী। কোচবিহারের রাজমাতা কমতেশ্বরী, হরেন্দ্রনারায়ণ, দেবেন্দ্র নারায়ণ, রাম নারায়ণ, খগেন্দ্র নারায়ণ, ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ, রাজেন্দ্র নারায়ণ, রানী মরিচমতি, ও অন্যান্য রাজপরিবারভুক্ত ব্যক্তিবর্গ, নাজিরদেও , রাজপুরোহিত সর্বানন্দ সবাই ক্ষমতালাভের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। এমনকি ভুটানের দেবরাজ, কোচবিহারের সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তত্বাবধায়কের ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজা রাজমহিষীরা সাহায্যের জন্য কখনো রংপুর বা কলকাতায় ইংরেজ রাজকর্মচারী বা গভর্নর জেনারেলের কাছে চিঠি লিখেছেন বাংলায়। এই চিঠিগুলির যারা মুসাবিদা করতেন সেই সব উকিলরাও ছিলেন বাঙালি, জানকীরাম, সৃষ্টিধর রায়, জগন্নাথ তলাপাত্ররা বাংলাতেই চিঠি লিখতেন। ইংরেজ রাজসরকারের কর্মচারীরাও বাংলাতেই উত্তর দিতেন। বাংলাই ছিল কোচবিহার সহ উত্তরপূর্ব ভারতের কাজের ভাষা। রংপুরের কালেক্টর ইংরেজ সরকারের পক্ষে কুচবিহার তত্বাবধান করতেন, ভুটানের সঙ্গে মোড়াঘাট নিয়ে যখন কোচবিহারের বিবাদ বাধে তখন চামুর্চি মোরাঘাটে উকিল কৃষ্ণকান্ত বসু ইংরেজ সরকারের পক্ষে মীমাংসা করতে আসেন। এই কৃষ্ণকান্ত বসুর সহকারী ছিলেন বাংলা গদ্যের জনক বলে অভিহিত রাজা রামমোহন রায়। কৃষ্ণকান্ত বসু ও রাজা রামমোহন রায় এই কুচবিহারের পথ ধরেই ভুটানযাত্রা করেছিলেন।
এইসব রাজকীয় পত্রমালার সামান্য অংশ পেশ করছি - ২৭৭ রাজশকে (১৭৮৬ খিস্টাব্দ )তে কোচবিহার রাজ্ শ্রী শ্রী হরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ কলকাতায় লর্ড কর্নওয়ালিশকে সম্বোধন করে লিখেছেন - "স্বস্তি প্রাতরুদীয়মানাকর্মন্ডল নিজ ভুজবল প্রতাপতাপিত শত্রুসমূহ পূজিতাখিল রাজেশ্বর মহামহিম শ্রীযুত মাসির খাষ হুজুর মুলতানন ও ইংলিস্থান জব্দেয়ন বুনিয়ান: আজিমঃ সান সিপাহ ছালার আফুয়াজ বাদশাহী ও কম্পেনী কেশওরে হিন্দোস্থান গৌরনরজনবল চারলছ লারড কারণওয়ালছ বাহাদোর বিশমসমরাজ টবরি কুল করিকুম্ভ বিদারণ কেশবিবর মহোগ্রপ্রতাপেষু।" এইসব চিঠিপত্র যে সাহিত্যিক গদ্য নয় তা বলবার অপেক্ষা রাখেনা , সংস্কৃতর বাধাবুলি এবং ইসলামী শব্দ বাহুল্যের বিকট পাঠেও বাংলা গদ্য যে ক্রমশ লঘুভার হয়ে উঠেছিল অনুভব করা যায়। উত্তরপূর্ব ভারতের রাজারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মামলা-মোকদ্দমা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সালিশির জন্য ডেকে আনতেন । এইসব রাজারা পত্রে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে "গো ব্রাহ্মণ প্রতিপালক" বলে সম্বোধন করতেন। ইংরেজ কর্মচারীরাও দেশীয় লোকের সাথে পত্র ব্যবহারে বাংলার সাহায্য নিতেন , পত্রের শিরো ভাগে "শ্রীকৃষ্ণ" লিখে পত্র শুরু করতেন।
প্রাচীন বাংলা পত্র-সংকলক সুরেন্দ্রনাথ সেন লিখেছিলেন " বাঙ্গালা গদ্যসাহিত্যের তখন সৃষ্টি হয় নাই বলিলেও অন্যায় হয় না। কিন্তু তথাপি ভুটান , কুচবিহার , আসাম , মনিপুর ও কাছাড়ের নরপতিগণ এই ভাষায়ই পর্যস্পরের সহিত এবং ইংরেজ সরকারের সহিত পত্রালাপ করিতেন। বাঙ্গালাই যে তখন পূর্বোত্তর ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিলো আমাদের সংকলিত পত্রগুলি পাঠ করিলে তাহাতে আর সন্দেহ থাকেনা। । ………… কুচবিহার রাজকার্য বাঙ্গালা পরিচালিত হইত। ভুটানের দেবরাজ বাঙ্গালা ভাষায় অভিজ্ঞ মুন্সী রাখিতেন। (এই কর্মচারীকে কায়েতি বলা হইত )। ইংরেজ কর্মচারীরাও সাধারণত দেশের লোকের সহিত বঙ্গভাষায় পত্রালাপ করিতেন। মফঃস্বলের ফরাশী বণিক ও ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লিখিবার সময় কখনো কখনো বাঙ্গালা ভাষার সাহায্য গ্রহণ করিতেন। অনার্য রাজ-দরবারে শাক্ত ও বৈষ্ণবাচার্যগণের প্রভাবে বাংলার বহুল ব্যবহারের সুবিধা হইয়া থাকিলেও যদি এই ভাষার কতকগুলি নিজস্য গুন্ না থাকিত তবে ব্রম্মের সীমান্ত হইতে বালেশ্বর পর্যন্ত শিষ্ট সমাজে এই ভাষার ব্যবহার হইতো কিনা সন্দেহ । "
এর পরে ব্রহ্মপুত্র , তিস্তা-তোর্সা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। উত্তরপূর্ব ভারতের সর্বত্র বাঙালির মাতৃভাষা বজায় রাখা আজকাল দুরূহ হয়ে উঠেছে। হিন্দিকে বলা হচ্ছে "ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজে" যার চালু অনুবাদ “রাষ্ট্র ভাষা”। এমনকি কখনো কখনো অত্যন্ত অপমানকর ভাবে বলা হয়, "রাজভাষা"। বাংলা পশ্চিমবঙ্গের, ত্রিপুরার, আসামের কাছাড় জেলার অন্যতম সরকারি ভাষা, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে দার্জিলিঙের তিনটি সাব-ডিভিশনে দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পঙে নেপালি অতিরিক্ত সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে উর্দু ভাষাও সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। বর্তমানে উত্তরবঙ্গে কামতাপুরি ও রাজবংশী ভাষাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৬১ সালে আইন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হবে। তা কতটা সফল হয়েছে ভুক্ত ভোগী মাত্রই জানেন। ভারতীয় অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বাঙালি বোধয় সবচেয়ে বিপর্যস্ত। বাঙালি আজ জীবিকার প্রয়োজনে সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে একটি বিশেষ ভৌগোলিক খন্ডের ফসল যে ভাষা, তার প্রতি আনুগত্য ও প্রয়োজন বাঙালির জীবনে ক্রমবিলিয়মান। বাঙালির স্বভূমিই আজ যখন নেই , তখন বাংলা ভাষা ও বাঙালির সত্তা কিভাবে রক্ষা হবে ? শুধু উত্তরপূর্ব ভারতে নয়, আমরা যারা এখনো বাংলা বলি, বাংলা পড়ি, বাংলা লিখি যেখানে পা রাখি সেটাই আমাদের বঙ্গভূমি, সেখানেই আমরা টিকে থাকব আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে।
সবশেষে একটি কথা বলা অত্যন্ত জরুরি , পাশ্চাত্য মিশনারিদের ধর্ম প্রচার ও বিদেশিদের শাসন কাজের প্রয়জনেই যে বাংলা গদ্যের উদ্ভব, প্রচার ও প্রসারের অনিবার্য কারণ বলে মনে করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। প্রাচীন বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশে উত্তরপূর্ব ভারতের তথা কোচবিহারের রাজদরবারের অবদান কে যথোচিত গুরুত্ব না দিলে আমরা ইতিহাসের অমর্যাদা করব।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴